যুগধর্ম নাম সংকীর্তন ও স্বর্গীয় অধীর চন্দ্র ধর

প্রকাশিত: ৮:১৬ অপরাহ্ণ , অক্টোবর ১৩, ২০২০

স্বর্গীয় অধীর চন্দ্র ধর বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের একটি অন্যতম শক্তি হিসাবে পরিচিত। নেত্রকোণা জেলার বৃটিশদের বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী রাজনীতিবিদদের মধ্যে তিনিও একজন। গ্রাম্য জীবনেও তিনি খুবই সাহসী ও প্রভাবশালী ছিলেন। নেত্রকোণা জেলার সদর উপজেলার ৩নং ঠাকুরাকোনা ইউনিয়নে ঐতিহ্যবাহী সমৃদ্ধশালী বেতাটি গ্রামের সমভ্রান্ত ধর পরিবারে ১৯১৩ সালে জন্ম গ্রহণ করেন স্বর্গীয় অধীর চন্দ্র ধর। পিতার নাম স্বর্গীয় অমর চন্দ্র ধর।

স্বর্গীয় অমর চন্দ্র ধর অত্র এলাকার সু-পরিচিত একজন সু-চিকিৎসক ছিলেন। স্বর্গীয় অমর চন্দ্র ধর- এঁর প্রথম স্ত্রী জামিনী সুন্দরী ধর পরলোক গমন করিলে গীরীবালা ধর -এঁর সহিত দ্বিতীয় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর দম্পত্য জীবনে চার পুত্র ও এক কন্যার মধ্যে প্রথম সহধর্মীনির গর্ভে তিন পুত্র স্বর্গীয় নিখিল চন্দ্র ধর, স্বর্গীয় পরেশ চন্দ্র ধর ও স্বর্গীয় অধীর চন্দ্র ধর এবং দ্বিতীয় সহধর্মীনির গর্ভে শ্রী অমল রঞ্জন ধর ও স্বর্গীয়া রাণীবালা ধর জন্ম গ্রহণ করেন। স্বর্গীয় অধীর চন্দ্র ধর পিতা-মাতার তৃতীয় সন্তান। শিশুকাল থেকেই স্বর্গীয় অধীর চন্দ্র ধর বিদ্রোহের চেতনা নিয়ে বড় হন। সামাজিক অবক্ষয়, অন্যায়-অবিচার, গরীব-দুঃখী, নিজ প্রজা ও রায়তদের প্রতি সুখ্যাতি ধর বংশের কোন-কোন কর্তাদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে স্বর্গীয় অধীর চন্দ্র ধর একটি প্রতিবাদী নাম। তখনকার সময়ে বিদ্যালয়ের গন্ডি পার হয়ে মহাবিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ হয়নি তাঁর। অখন্ড ভারতবর্ষে স্বাধীনতার জন্য তিনি কংগ্রেস দলে যোগ দিয়ে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে স্বক্রিয় ভূমিকা রাখেন, এমনকি আন্দোলনের কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে একাধিকবার কারাবরণ করেন তিনি। শেষবার বাংলা ১৩২৬ সনের বাণে জেলখানা ভেঙ্গে পড়ায় সকল আটককারীদের সাথে তিনিও জেল হতে বেরিয়ে পরেন। তারপর পারিবারিক চাপে স্বর্গীয়া রেনুকা দেবী ধর এঁর সঙ্গে বিবাহবন্ধনের মাধ্যমে সংসার জীবন শুরু করেন।

সংসার জীবনে পা রেখেই তখনকার সময়ে জেলার সুসং দুর্গাপুর জমিদারদের অনুদানে প্রতিষ্ঠিত ও জেলা পরিষদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত একটি হাসপাতালে সহকারী চিকিৎসক হিসেবে দীর্ঘদিন কর্মরত ছিলেন। উক্ত হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসক ছিলেন তাঁর জ্যেঠতুত দাদা ডাঃ স্বর্গীয় জ্ঞানচন্দ্র ধর। স্বর্গীয় অধীর চন্দ্র ধর হাতে কলমে চিকিৎসার দায়িত্ব পালন করে, চিকিৎসা শাস্ত্রে অভিজ্ঞ হয়ে মাঝে মধ্যে গ্রামে এসে দরিদ্র গ্রামবাসী রোগীদের চিকিৎসা করতেন। এলাকার অসহায় সিংহভাগ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সেবায় সময়-অসময় তিনি তাঁর কর্তব্য কাজে রত থাকতেন। পরবর্তীতে ডাঃ স্বর্গীয় জ্ঞানচন্দ্র ধর চাকুরিতে বদলীর সুযোগ নিয়ে ভারতে চলে যাওয়ায় স্বর্গীয় অধীর চন্দ্র ধর নেত্রকোণা সদর উপজেলার গ্রামের বাড়ি বেতাটিতে এসে, স্থায়ী ভাবে বসবাস করে গ্রাম্য চিকিৎসক হিসেবে জেলায় সু-পরিচিত হন এবং চিকিৎসা সেবায় সুনাম অর্জন করেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন ব্যবসার সাথে জড়িত হন। এসময় পৈত্রিক সম্পত্তি দেখা-শুনার দায়িত্ব ভারও তাঁর উপর অর্পিত হয়। তিনি কংস নদের চরে নিজ চর জমিতে তরমুজ, ক্ষিরা, বাদাম ও মিষ্ঠিকুমড়া চাষাবাদে মনোযোগী হন। গ্রামের শিশুরা চরে গেলে তাদের “হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে” এই তারকব্রহ্ম নাম শিখাতেন এবং চরের তরমুজ, ক্ষিরা কেটে খাওয়াতেন এমনকি নিজেও খেতেন। শিশুরা ছিল তাঁর ভালবাসার পাত্র, তিনি সকল শিশুদের ভালবাসতেন।

জমি চাষাবাদ করাতে বর্গাদার ভাগীদার মরহুম আব্দুল জহুর, মরহুম দারগ আলী, মরহুম হেকমত আলীসহ আরও অনেকের মধ্যে মরহুম আব্দুল জহুরকে পুত্রবৎ ¯েœহ করতেন। এলাকায় আব্দুল জহুর ‘অধীর বাবুর পুত্র’ বলেই পরিচিত ছিল। তাদের সুখ-দুঃখে তিনি পাশে এসে দাঁড়াতেন। গ্রাম্য জীবনে চলার পথে স্বর্গীয় অধীর চন্দ্র ধর খুবই সহজ-সরল উদার মনের অধিকারী ছিলেন। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নিয়ে তাঁর কোন ভেদাভেদ ছিল না। তিনি সকল মানুষকে সমদৃষ্টিতে দেখতেন। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় তাঁর গ্রাম্য জীবন চালিত হয়। ধনী-দরিদ্র, দুঃখী-সুখী, উঁচু-নিচু সকল মানুষকে তিনি “সবার উপরে মানুষ সত্য” এভাবেই চালিত করতেন এবং তিনি নিজেও সেভাবেই চলাফেরা করতেন। সমাজে সেবামূলক সামাজিক কর্মকান্ডে স্বর্গীয় অধীর চন্দ্র ধর- এঁর পারদর্শিতা অতুলনীয়।

এছাড়াও তিনি অতিব ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি ছিলেন। সনাতন ধর্মের বৈষ্ণবাচারিত পথে তাঁর ছিল অগাধ বিশ্বাস ও ভক্তি। বৈষ্ণবীয় ভাবধারায় তিনি ছিলেন নিরহংকার। সরল, উদার, সমভাব প্রকাশে উদ্বুদ্ধ। ধর বংশের আভিজাত্যের ভাবধারার ধার ধারতেন না বলে অতি সাদামাটা জীবন-যাপন করতে ভালবাসতেন স্বর্গীয় অধীর চন্দ্র ধর। বাড়িতে থেকে প্রয়োজনের তাগিদে তালুকদারী রাজত্ব্যের আওতাধীন প্রজাদের কাছ থেকে ন্যায্য খাজনাদি আদায় এবং হাট-বাজার থেকে খাজনাদি আদায় করানোর সাথেও জড়িত ছিলেন জীবনের কিছু সময়, সে সময় প্রজারা তাদের সামর্থ অনুযায়ী যে পরিমান খাজনা দিতেন তাই নিয়ে খুশি থাকতেন স্বর্গীয় অধীর চন্দ্র ধর, কোনদিন কারও উপর কোনপ্রকার চাপ সৃষ্টি করতেন না। এভাবেই প্রজা রায়তদের শ্রদ্ধা ও ভালবাসা কুড়িয়েছেন তিনি।

পরবর্তীতে সহমর্ধীনি রেনুকা দেবী ধর- কে সঙ্গে নিয়ে তীর্থ ভ্রমণ ও ভারতে বসবাসরত আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে সেখানকার যান্ত্রিক পরিবেশে মন বসাতে পারেননি এই স্বভাব সুলভ মানুষটি। দেশের মানুষের ভালবাসার তাগিদে ভিসার জন্য সময় ক্ষেপন না করেই সহমর্ধীনিকে নিয়ে চলে আসেন বাংলাদেশে। বাংলাদেশের নিজ বাড়িতে ফিরে আধ্যাত্মিক চেতনায় মনোনিবেশ করে সনাতন ধর্মীয় চেতনায় বৈষ্ণবীয় শ্রাস্ত্রে নিজেকে এগিয়ে নিতে শুরু করেন। আপন ইচ্ছায় সাধুত্বের কৃচ্ছতা বরণ করেন। সে সময় তিনি হরি সভায় শ্রীমৎভগবদ গীতা পাঠ, নাম সংকীর্তণ, সাধুসঙ্গ ও বৈষ্ণব সেবা নিয়ে দিন কাটাতে শুরু করেন। এই সময় আনন্দ উল্লাসের পাশা-পাশি গ্রামের মানুষদের মধ্যে সনাতন ধর্মীয় চেতনা জাগরণের লক্ষ্যে নিজ গ্রামে গঠন করেন, নিমাই সন্যাস, কংসবধ, নৌকা বিলাস ইত্যাদি ধর্মীয় ডপ গানের দল। তাঁর ডাকে গ্রামের হিন্দু-মুসলিম সকলেই এ দলে অংশ নেয়। তখনকার আমলে মেয়েদের দিয়ে ডপ যাত্রার দলে অভিনয় করানোর রীতি ছিল না। ছেলেরাই মেয়ে সেজে মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করত। এমনকি নাচের জন্যও ছেলেরাই নিযুক্ত হত। গ্রামের মাতব্বর শ্রেণীর লোকজনকে নিয়ে তিনি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গ্রামে ধর্মীয় ডপ যাত্রাপালা পরিবেশন করতেন। ডপ যাত্রা পরিচালনার মধ্যে মরহুম জাহির তালুকদার, মরহুম হাবিবুর রহমান খান, স্বর্গীয় সুরেন্দ্র বর্মন, স্বর্গীয় মুকন্দ দাস, স্বর্গীয় যোগেশ দাস, মরহুম মিজাজ উদ্দিন, মরহুম নূর আহম্মদ তালুকার লোকদের নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখ যোগ্য। স্বর্গীয় অধীর চন্দ্র ধর- কে গ্রামের লোকজন ‘অধীর বাবু’ বলেই ডাকতেন। তিনি নিজেও ধর্মীয় পালায় মুনিবর, সন্যাসী, সাধুবাবা চরিত্রে অভিনয় করতেন। এলাকার হিন্দু-মুসলিম সকলেই অধীর চন্দ্র ধর (অধীর বাবু)- কে ভালবাসতেন ও শ্রদ্ধা করতেন। জীবনের শেষ দিকে শুধুমাত্র শ্রীমৎভগবদ গীতা পাঠ, বৈষ্ণব সেবা, হরি বাসরে নাম সংকীর্তন নিয়ে বেশি সময় কাটাতেন। সপ্তাহে এক দিন প্রতি বৃহস্পতিবার গ্রামের এক-এক বাড়িতে সন্ধ্যা হতে শুরু হতো হরি বাসর নাম সংকীর্তন। তাঁর মুখে কৃষ্ণনাম শুনে মেতে উঠতেন উপস্থিত সকল ভক্তবৃন্দ। বয়সের বার্ধ্যকতা কখনও বেঁধে রাখতে পারেনি এই ধর্মপ্রাণ মানুষটিকে।

ব্যক্তি জীবনে তিনি অত্যান্ত পরিশ্রমী ও শক্তিশালী ছিলেন। প্রবল ইচ্ছাথাকা স্বত্বেও বার্ধ্যকতার কারণে ১৯৭১ সনে মহান স্বাধীনতার যুদ্ধে তিনি সক্রিয় অংশ নিতে পারেননি। সে সময় পাকিস্তানী হানাদারদের তান্ডবে বাড়ি-ঘর, সম্পত্তি পুত্রবৎ মরহুম আব্দুল জহুর- কে দিয়ে চলে যান ভারতের বাঘমারা ক্যাম্পে। দীর্ঘ নয় মাস রক্ষক্ষয়ী যুদ্ধের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হলে মাটির টানে ফিরে আসেন লাল সবুজের পতাকা বেষ্টিত স্বাধীন মাতৃভূমিতে।

ধর্মের প্রতি প্রায় মধ্য বয়সে মনোনিবেশ করলেও তিনি গুরু দীক্ষা নেন শেষ বয়সে। বড় ছেলে সাংবাদিক শ্রী অরবিন্দ ধর এঁর ইচ্ছানুযায়ী গুরুদেব শ্রীমৎ মন্টু গোস্বামী এঁর কাছ থেকে কৃষ্ণ মন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে তিনি সম্পূর্নভাবে বৈষ্ণব আচারে আচারিত হলেন। তারপর সংসারে থেকেই তিনি সংসার বিবাগী ভাব অর্জনে সংসারের দায়িত্ব তুলে দেন প্রিয়পুত্র শ্রী অরবিন্দ ধর এঁর হাতে। পাঁচ মেয়েকে বিবাহ দিয়ে তিন ছেলে রেখে বৈরাগ্য মনে মেতে উঠেন কৃষ্ণনাম সংকীর্তন, সাধুসঙ্গ, ভক্তসঙ্গ ও গুরুসঙ্গ নিয়ে। ক্রমে-ক্রমে ছেড়ে দিলেন বৈষয়িক ভাবনা। সারাদিন বাহ্যিক বৈভব চিন্তা পরিহার করে শুধু ঈশ্বর চিন্তায় পরমার্থিব পথের সন্ধ্যান লাভে নামানন্দের প্রেমাবেশে মাতোয়ারা করে রাখেন নিজেকে। প্রতিদিন ভোরে উচ্ছস্বরে নাম কীর্তন করে নগর পরিক্রমা করতেন। স্বর্গীয় অধীর চন্দ্র ধর -এর কন্ঠে কৃষ্ণনাম শুনে প্রতিদিন ঘুম ভাঙ্গতো গ্রামের লোকজনদের। গ্রামবাসী ঘুমভেঙ্গে বাহিরে এসে দেখতেন স্বর্গীয় অধীর চন্দ্র ধর গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর আবেশে কৃষ্ণনাম বিতরণ করছেন।

বৃদ্ধ বয়সেও তিনি কোনরূপ রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে শষ্যাসায়ী অবস্থায় অন্যকে ভোগাননি। সর্বদা চলাফেরার মধ্য দিয়ে দিন-রাত নাম কীর্তন করে উজার করে দিতেন সকল প্রতিবেশীদের। এভাবে তিনি নাম মাহাত্মের আত্ম উপলব্দিতে নামাশ্রিত অবস্থায় ১৯৯২ সালে ৭৯ বছর বয়সে পুরো গ্রাম ঘুরে এসে সন্ধ্যায় শাস্ত্রজ্ঞ বিধি পালন রত অবস্থায় নাম করতে করতে সন্যাস রোগে আক্রান্ত হয়ে সহধর্মীনির কোলে দেহ ত্যাগ করেন। মৃত্যুর খবর জেনে ভারী হয় বেতাটির আকাশ-বাতাস। শোকের ছায়া নেমে আসে সারা ইউনিয়নে।

স্বর্গীয় অধীর চন্দ্র ধর বলতেন, “এ যুগে বেদাচার লোকাচার মতে দেব-দেবী পূঁজার নাই প্রয়োজন, সকলে কৃষ্ণ প্রেমে একাত্ম হয়ে পঞ্চতত্ত্ব অর্চনায় বর্ণ বৈষম্য ভুলে কর তারকব্রহ্ম নাম সংকীর্তনের আয়োজন। নাম ভজ নাম চিন্ত নাম কর সার। এ যুগে নাম বিনে গতি নাই আর। হাতে কর গৃহ কর্ম মুখে বল হরি শুদ্ধ চিত্ত্বে, বিশ্বাস ভক্তিতে, নামাশ্রয়ে পাবে গৌর গুণ মনি।” মৃত্যুর কাল দীর্ঘ হলেও অধীর চন্দ্র ধর (অধীর বাবু) আজও অত্র এলাকাবাসীর অন্তরে জাগ্রত ও চির ভার্স্কয্য হয়ে রয়েছেন মহৎ ও পরম বৈষ্ণবীয় ত্যাগী ব্যক্তিত্বের বহি প্রকাশে।

 

শ্রী প্রসেনজিৎ পাল রাজন,                                                                                                                                                                                              মোক্তারপাড়া, নেত্রকোণা

 

Loading