আমার রণাঙ্গনে কথা

প্রকাশিত: ৯:৩৮ অপরাহ্ণ , মার্চ ২২, ২০২৪

-দেবেশ চন্দ্র সান্যাল

উনিশ শ’ একাত্তর সাল। পাকিস্তানি হানাদারদের অতর্কিত আক্রমনের কারণে দেশে সশস্ত্র প্রতিরোধ ও মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। আমি তখন রতন কান্দি নি¤œ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। ২৫ মার্চ’৭১ কাল রাত থেকে শুরু হলো পাকস্তানি সৈন্যদের নৃশংসতা। পাকিস্তানি হানাদারেরা বিশে^র জঘন্যতম এই নৃশংসতার নাম দিল “অপারেশন সার্চলাইট”। ঘুমন্ত বাঙালিদের উপর চালালো বিনা বিচারে জ¦ালাও, পোড়াও, নির্যাতন, হত্যা ও অন্যান্য মানবতা বিরোধী কাজ। ২৫ মার্চ’৭১ কালরাত এর পর আস্তে আস্তে পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যরা সারা দেশের অধিকাংশ জায়গায় ক্যাম্প করলো। ১৯৭০ সালের জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে হেরে যাওয়া জামায়াতে ইসলাম, মুসলিম লীগ ও অন্যান্য ইসলামী রাজনৈতিক দলের অধিকাংশ নেতা কর্মীরা পাকিস্তানের পক্ষ নিল। পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যদের সহযোগিতার জন্য পীচ কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও অন্যান্য বাহিনী গড়ে তুললো। এ দেশের অধিকাংশ বিহারী অধিবাসিরা পাকিস্তানি সৈন্যদের পক্ষ নিল। পাকিস্তানি সৈন্যরা সারা দেশে ধর পাকড় করতো। পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের এদেশীয় দোসরদের সহযোগিতায় সারা দেশ ব্যাপী জ¦ালাও,পোড়াও, হত্যা, গন হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, জোর করে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তর করণ ও চাঁদা বাজি সহ বিভিন্ন মানবতা বিরোধী কাজ করতে থাকলো। পীচ কিমিটির লোক ও রাজাকারেরা পাকিস্তানি সৈন্যদের আওয়ামী লীগ নেতা কর্মী ও হিন্দুদের বাড়িঘর চিনিয়ে দিত। পাকিস্তানি সৈন্যদের রাস্তা চিনিয়ে নিয়ে গ্রামে যেতো। তারা চিনিয়ে দিত কোন বাড়ির লোক মুক্তিযুদ্ধে গেছে। তারা পাকি হানাদারদের তথ্যদিত, বাড়িঘর লুটতরাজ, আগুন দিত ও চাদাঁ বাজি করতো। তাদের এই নিষ্ঠুরতা দেখে জাতি স্বম্ভিত হয়ে পড়লো। প্রতিদিন পাকিস্তানি সৈন্যদের নৃশংসতার কথা জানতাম বিভিন্ন মানুষ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে। তখন স্কুল কলেজ সব কিছু বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ঢাকা সহ অন্যান্য শহরে অধিকাংশ চাকরি করা আমাদের এলাকার অধিকাংশ চাকুরী জীবী জীবন বাঁচাতে বাড়িতে বাড়িতে এসে আশ্রয় নিলেন। তাঁদের কাছ থেকে ও অন্যান্যের কাছ থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংস ভয়াবহতার কথা জানতে পারলাম। আমাদের এলাকার উল্লাপাড়া থানার চড়িয়া ও কান সোনা ঘোষ পাড়া, সাথিঁয়া থানার ডেমড়া (বাউস গাড়ি রুপসী) ও করঞ্জা গন হত্যা হলো। দেশের ভয়াবহ অবস্থা। পাকিস্তানি সৈন্যরা এক এক রাতে এক এক গ্রাম ঘিরে গন হত্যা চালায়। এদেশীয় স্বাধীনতা বিরোধী সহযোগীদের দিয়ে লুটতরাজ চালায়। বাড়িঘর ও দোকানে অগ্নি সংযোগ করে পুড়িয়ে দেয়। ২৫ মার্চ কাল রাতের অপারেশন সার্চ লাইট এর পর থেকে জীবন বাঁচানোর জন্য আওয়ামী লীগ নেতা কর্মী ও হিন্দুরা অনেকে ভারতে আশ্রয় নেয়। বাঙালি সৈন্য, ই.পি.আর পুলিশ, আনসার ও অন্যান্যরা প্রতিরোধ ও মুক্তিযুদ্ধ চালায়। বাঙালি সৈনিক, ই.পি.আর, আনসার ও অন্যান্য প্রশিক্ষিত বাহিনীর সাথে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয় এদেশের অধিকাংশ কৃষক, শ্রমিক,ছাত্র ও অন্যান্য নারী-পুরুষ। পেশাদার প্রশিক্ষন প্রাপ্ত আধুনিক অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বাঙালিদের কুলিয়ে উঠা সম্ভব হচ্ছিল না। প্রশিক্ষন, অস্ত্র ও অন্যান্য সহযোগিতার জন্য বাঙালি সৈন্য ও অন্যান্যরা ভারতে আশ্রয় নেয়। আমাদের গ্রামে করতোয়া নদী পাড় হয়ে আসতে হবে। নৌপথ ছাড়া গ্রামে পাকিস্তানি সৈন্যরা আসতে পারবেনা। আমাদের গ্রামের মুসলমানেরা খুব ভালো। আমাদের গ্রামের একজন মানুষও পীচ কমিটির সদস্য, রাজাকার ও স্বাধীনতা বিরোধী হয় নাই। সব মুসলমানেরা হিন্দুদের বিভিন্ন নিরাপত্তা দিয়ে ছিলেন। ডেমড়া গণহত্যা পর থেকে আমরা দিন রাত গ্রাম পাহাড়া শুরু করলাম। প্রতিবেশী মুসলমান যুবকেরা আমাদের সহযোগিতার জন্য সাথে থাকলো। আমাদের পরিবার কয়েক দিন রাতে প্রতিবেশী মুসলমানদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে ঘুমাতাম। আমাদের গ্রামের মুসলমানেরা এত ভালো যে,তাঁরা আমাদের জন্য ঘর ও বিছানা ছেড়ে দিয়ে নিজেরা বারান্দায় ঘুমাতেন। আমরা কয়েক দিন আমাদের গ্রামের বাড়ি ছেড়ে আমাদের অপেক্ষা আরো প্রত্যন্ত অঞ্চলে পিতার শিষ্যের বাড়ি বাচড়া গ্রামে আশ্রয় নিয়ে থাকলাম। একাকী মনে মনে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলাম। আষাঢ় মাসের প্রথম দিকে আমাদের পরিবার আবার গ্রামের বাড়িতে ফিরে এলাম। আমাদের গ্রামের আমরা ও অন্যান্য যুবকেরা নিজেদের উদ্যোগে রাত দিন পালা করে করে গ্রাম পাহাড়া দিতে থাকলাম। আর মুক্তিযুদ্ধের যাওয়ার পথ খুঁজতে থাকলাম। শ্রাবণ মাসের প্রথম দিক। দিনটি ছিল ৬ শ্রাবণ ১৩৭৮ ও ২৩ শে জুলাই’৭১ শুক্রবার। বর্ষাকাল। রাত ৮ টার দিকে দেখি আমাদের বাড়ির অদূরে পালেদের বিলে একটি ছই ওয়ালা নৌকা। নৌকা দেখে এগিয়ে গেলাম। বাচড়া গ্রামের আমার পরিচিত মো: আব্দুল ওহাব কে দেখতে পেলাম। জিজ্ঞাস করলাম। ওহাব কী হবে? ওহাব বললো এম পি এ. জনাব মো: আব্দুর রহমান স্যার এলাকার ইচ্ছুকদের মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং এর জন্য ভারত নিয়ে যাচ্ছেন। আমি বললাম তাহলে আমিও যাবো। আমি চলে এলাম বাড়িতে। গোপনে আমার জামা কাপড় গোছালাম তারপর আমার লেখার খাতার একটি পৃষ্ঠা ছিড়ে মাকে উদ্দেশ্য করে একটি চিরকুট লিখলাম। চিরকুট টি ছিলÑ“মা, প্রনাম নিও, বাবাকে আমার প্রনাম দিও। বড় দাদা, মেজদাদা, ও বৌদিকে প্রনাম দিও। ছোট ভাই বোনকে ¯েœহাশিষ দিও। আমি মুক্তিযুদ্ধে গেলাম। তোমাদেরকে বলে গেলে যেতে দিতে না জন্য না বলে চলে গেলাম। অপরাধ ক্ষমা করিও। আশীর্বাদ করিও। আমি যেন বিজয়ী হয়ে তোমাদের কাছে ফিরে আসতে পারি। ইতি- তোমার ছেলে দেবেশ।” আমি বাড়ির কাউকে না বলে গোপনে নৌকায় গিয়ে বসলাম। রাত ৮-৩০ মি: এর দিকে শাহজাদপুরের রাজ্জাক ও এরশাদ ভাই সহ কয়েক জনকে সাথে নিয়ে একটা নৌকায় এম.পি.এ জনাব মো: আব্দুর রহমান স্যার এলেন। এম.পি.এ স্যার কে দেখে আমি দেখা করার জন্য এগিয়ে গেলাম। সামনে দাড়িয়ে আদাব দিলাম। আমাকে দেখে স্যার বললেনÑ দেবেশ, তুমি কেন? এত ছোট মানুষকে তো মুক্তিযুদ্ধে নিবেনা। আমি অনুরোধ করলাম। এম.পি.এ স্যার বললেন-ঠিক আছে চলো। তারপর রতন কান্দি পালেদের বিলের ঘাট থেকে রাত ৯-০০ টার দিকে আমাদের নৌকা ছাড়লো। মানসিক ভাবে ভগবান কে প্রনাম করলাম। শুরু হলো এক কিশোরের জীবন পন যুদ্ধে যাওয়া। এই নৌকা রাতভর চালিয়ে ভোরে গিয়ে নামিয়ে দিল সুজানগর থানার সাতবাড়িয়া নামক স্থানে। ঐ দিন দিনের বেলা আমাদের গাইডারের পরামর্শে সুজানগরের এক আওয়ামী লীগ নেতার বাড়িতে থাকলাম। রাতে আমরা সুজানগর থানার সাত বাড়িয়া হয়ে পদ্মা নদী পাড় হয়ে কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর থানার চিলমারি ইউনিয়নের খারিজাথাক গ্রাম দিয়ে বাংলাদেশের বর্ডার অতিক্রম করলাম। আমরা ভারতের পশ্চিম বাংলার জলঙ্গী বর্ডার দিয়ে ভারতে ঢুকলাম। একটি বি.এস.এফ ক্যাম্পে ঢুকলাম। প্রাতঃক্রিয়াদি করে হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। বি.এস.এফ ক্যাম্পেএম.পি.এ স্যার ও আমাদের গাইডার কে চেয়ারে বসতে দিলেন। আমাদের সবাই কে এক লাইনে দাড় করালেন। আমাদের গণনা করা হলো। আমরা হলাম ২২ জন। এম.পি.এ স্যার যোগাযোগ করে আমাদের কে কামার পাড়া ইয়ুথ ক্যাম্পে যাওয়া ও ভর্তির ব্যবস্থা করলেন। এম.পি.এ স্যার আমাদের সাথে মালদহ পর্যন্ত গেলেন। এম.পি.এ স্যার মালদহ বাজার থেকে মুড়ি ও কাঠাল কিনে আমাদের খাওয়ালেন। তারপর আমাদের কে মুক্তিযুদ্ধের বাসে প্রশিক্ষনের জন্য কামার পাড়া ইয়ুথ ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে ব্যবস্থা করে দিয়ে তিনি অস্থায়ী প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের উদ্দেশে কোলকাতা চলে গেলেন। আমরা রাত ৯ টার দিকে কামার পাড়া ইয়ুথ ক্যাম্পে গিয়ে পৌছালাম। তাঁরা আমাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। পর দিন সকালে আমাদের সবাইকে ফলোইং করালেন। আমরা কামার পাড়া ইয়ুথ ক্যাম্পে ভর্তি হলাম। প্রাথমিক ট্রেনিং ক্যাম্পে আমাদের ফলইং করিয়ে জাতীয় সংগীত গাওয়ানো, পিটি প্যারেড করানো হতো। কদিন কামারপাড়া ইয়ুথ ক্যাম্পে থাকার পর আমাকে, রবীন্দ্র নাথ বাগচী, রতন কুমার দাস ও মো: নজরুল ইসলাম কে ট্রান্সফার করলো মালঞ্চ ট্রানজিট ক্যাম্পে। মালঞ্চ থেকে কুড়মাইল ট্রানজিট ক্যাম্পে। কুড়মাইল থেকে আমাদের কে আনা হলো পতিরাম ক্যাম্পে। পতিরাম ক্যাম্প থেকে এক যোগে ভারতীয় আর্মি লরিতে ২০/২২ জন কে নিয়ে আসা হলো দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি মহকুমার পানিঘাটা নামক ইন্ডিয়ান আর্মি ট্রেনিং ক্যাম্পে। পানিঘাটা ট্রেনিং ক্যাম্প টি ছিল ভারতের ৭ নং সেক্টরঅধীন। পানিঘাটা স্থান টি ছিল পাহাড়ের মধ্যে বনাঞ্চলে। এই বনাঞ্চলে বনমানুষ, নকশাল ও অন্যান্য খারাপ মানুষের বসবাস ছিল। স্থানটি ছিল কার্শিয়ান পাহাড় হইতে নেমে আসা একটি ক্যানেলের দক্ষিণ পার্শে¦র বনাঞ্চল। চাঁন মারি স্থানের বামপাশে পাহাড় থেকে নেমে এসেছে ঝর্ণার জল ধারা। ক্যাম্পে নিয়ে আমাদের তাবুর মধ্যে থাকার সিট করে দিল। আমাদের প্রত্যেক কে একটা মগ, একটা প্লেট, দুই টা প্যান্ট, ২টা গেঞ্জি, একটি মশারি, ও বিছানা পত্র দেওয়া হলো। ট্রেনিং শুরু হলো। আমাদের ২১ দিনের ট্রেনিং হলো। আমাদের কে থ্রিনট থ্রি রাইফেল, এল, এম,জি,এস,এল,আর, ষ্টেনগান, টুইঞ্চ মর্টার, হ্যান্ড গ্রেনেড চার্জ, এক্সপ্লোসিভের ব্যবহার, ফাষ্ট এইড সহ অন্যান্য ট্রেনিং দিল। যুদ্ধে সহযোদ্ধা আহত হলে বা শহিদ হলে করণীয় সর্ম্পকে সম্পর্কে ধারণা দিল। ভারতীয় কয়েক জন হিন্দু বিহারী ও শিখ সৈন্য প্রশিক্ষন দিলেন আমাদের কোম্পানীর। আমাদের কোম্পানীর নাম ছিল ডেল্টা কোম্পানী। প্রধান প্রশিক্ষক ছিলেন শিখ সেনা ক্যাপ্টেন ডি.এস. ভিলন। বিদায়ের সময়ে জানতে পারলাম আমার এফ.এফ নং-৪৭৪২। ট্রেনিং শেষে ইন্ডিয়ান আর্মি ট্রাক যোগে আমাকে, রবীন্দ্র নাথ বাগচী, মো: নজরুল ইসলাম রতন কুমার দাস ও অন্যান্য প্রায় ৫০ জন কে নিয়ে আসা হলো ৭ নং সেক্টরের হেডকোয়ার্টার কালিয়াগঞ্জ থানার তরঙ্গপুরে। তরঙ্গপুর এনে সিরাজগঞ্জ জেলার ১০ জনের সমন্বয়ে একটি গেরিলা গ্রুপ করা হলো। আমাদের গ্রুপের গ্রুপ লিডার নিযুক্ত হলেন বেলুকুচি থানার তামাই গ্রামের জনাব এম.এ মান্নান। ডেপুটি লিডার নিযুক্ত হলেন শাহজাদপুর থানার জামিরতা গ্রামের অধিবাসী রবীন্দ্র নাথ বাগচী। আমাদের কে তরঙ্গপুর থেকে অস্ত্র, গোলা-বারুদ, রেশনিং ও পকেট মানি দেওয়া হলো। আমার নামে একটি থ্রি নট থ্রি রাইফেল, এক ম্যাগজিন গুলি, একটি বেওনেট ও একটি হেলমেট ইস্যু করা হলো। অন্যান্য গোলা বারুদ, মাইন,গ্রেনেড ও এক্সপ্লোসিভ কমান্ডার স্যারের দায়িত্বে দিলেন। মৃত্যু যে হবেনা এমন কোন গ্যারান্টি ছিল না। তাই আমি মৃত্যুর প্রস্তুতি ও যুদ্ধ জয়ের জন্য তরঙ্গপুর বাজার থেকে একখানা শ্রী শ্রী চন্ডী গ্রন্থ, একটি বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত জাতীয় পতাকা ও একটি ৪ ব্যান্ডের রেডিও কিনলাম। তরঙ্গপুর থেকে কালিয়াগঞ্জ পর্যন্ত বাসে এসে ট্রেনে উঠলাম। ট্রেনে শিলিগুড়ি জংসন ষ্টেশন পর্যন্ত গেলাম। তারপর ট্রেন বদলীয়ে আসাম গামী ট্রেনে উঠলাম। আসাম গামী ট্রেনে ধুপরী নামক ষ্টেশনে আমরা নামলাম। ধুবরী থেকে বাস যোগে মানিকার চর এলাম। রাত হয়ে যাবার কারণে রাতে মানিকার চর একটা ভাড়া বডিং এ থাকলাম। পরদিন সকালে মানিকার চর থেকে নদী পার হয়ে এলাম তদানীন্তন রংপুর জেলার কুড়িগ্রাম মহকুমার (বর্তমানে জেলা) মুক্তাঞ্চলে স্থাপিত রৌমারী মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। রৌমারী ক্যাম্পে আমরা ¯œান খাওয়া দাওয়া করলাম। আমাদের কমান্ডার স্যার সিরাজগঞ্জ জেলার মুক্তাঞ্চল যমুনার চড়ে পৌঁছানোর জন্য একটি ছই ওয়ালা নৌকা ভাড়া করলেন। রৌমারী ক্যাম্প থেকে রাতের খাবার খেয়ে রাত ৯:০০ টার দিকে আমাদের নৌকা ছাড়লো। ইহা ছিল ৬ সেপ্টেম্বর’৭১। নৌকা বাহাদূরাবাদ ঘাট, জগন্নাথগঞ্জ ঘাট, কাজিপুর থানা ও অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা দিয়ে আসতে হয়। আমরা জানতে পেরে ছিলাম। বাহাদূরাবাদ ঘাট অত্যন্ত ঝুঁকি পূর্ণ এলাকা। ঐ ক্যাম্পের পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকারেরা ভয়ানক। তারা স্পীড বোট নিয়ে রাতে নদী টইল দেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকা পেলে ধরে নিয়ে যায়। ক্যাম্পে নিয়ে অমানুষিক অত্যাচার করে নৃশংস ভাবে হত্যা করে। আমাদের কমান্ডার জনাব এম.এ মান্নান স্যার নির্দেশ দিলেন-”আপনারা সবাই নৌকার ডওরার মধ্যে পজিশন অবস্থায় থাকুন। পাকিস্তানি হানাদারেরা ধরতে এলে আমরা ধরা দিব না। যুদ্ধ করবো। যুদ্ধ করে শহিদ হবো কিন্তু ওদের হাতে ধরা দিব না”। রাত ২.০০ টার দিকে আমরা বাহাদূরাবাদ ঘাটের ভয়াবহ এলাকা অতিক্রম করতে থাকলাম। ওদের সার্চ লাইটের আলো এসে বার বার আমাদের নৌকাতে পড়ছিল। ভগবানের কৃপায়-ওরা আর স্পীড বোট নিয়ে ধরতে এলোনা। আমরা বাহাদূরাবাদ ঘাট এলাকা অতিক্রম করলাম। আমাদের সাথে চিড়া গুড় ছিল। ভোরে মাঝিরা এক কাইসা খেতের মধ্যে নৌকা ঢুকিয়ে দিল। আমরা নীচে নেমে খেতের মধ্যে প্র¯্রাব পায়খানা করলাম। আমাদের সাথে থাকা চিড়া ও গুড় দিয়ে সকালের জলখাবার খেলাম। তার পর নৌকা আবার ছাড়লো। তখন কাজিপুর থানা অধিকাংশ এলাকা সহ বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকা পাকিস্তানি হানাদারদের দখলে। কাজিপুর থানার সম্মুখ দিয়ে আমাদের নৌকা আসবে। দেখে শুনে খোঁজ নিয়ে থামিয়ে থামিয়ে ৪ দিন ভরে নৌকা এসে পৌছালো সিরাজগঞ্জ হানাদার মুক্তাঞ্চল যমুনার চরে। ইহা ছিল টাঙ্গাইল জেলার সিংগুলির চড়েরনিকটবর্তী। নৌকাতেই রান্নার ব্যবস্থা ছিল। মাঝিরা কোন রকমে ডালভাত অথবা খিচুরী রান্না করে আমাদের খাওয়াতো। এই ভাবে খেয়ে না খেয়ে চলছিলাম। পরদিন রাতে যমুনা নদী পার হয়ে বেলকুচি থানায় এপাড়ে চলে এলাম। চলে এলাম বেলকুচি-কামারখন্দ নির্বাচনী এলাকার এম.এন.এ জনাব মো: আব্দুল মোমিন তালুকদারের গ্রামের বাড়িতে। তিনি তখন বাড়িতে ছিলেন না। তাঁর ভাই মো: রশিদ তালুকদার আমাদের থাকা খাওয়া ও অন্যান্য বিষয়ে সহযোগিতা করলেন। কমান্ডার স্যারের কাছে জানলাম জনাব মো: আমির হোসেন ভুলু এর গ্রুপ এবং মো: আব্দুল লতিফ মির্জার পলাশ ডাঙা যুব শিবিরের কয়েকটি গ্রুপ আমাদের এই এলাকাতেই আছে। আমরা পাকিস্তানি হানাদার সৈন্য ও তাদের দোসরদের আতঙ্কে রাখার জন্য গেরিলা কার্যক্রম “হিট এন্ড রান” চালাতাম। পাকিস্তানি সৈন্য বা রাজাকার ক্যাম্পের নিকট বর্তী গিয়ে ২/৪ টা থ্রি নট থ্র্রি রাইফেলের আকাশ মুখি ফাঁকা গুলি ছুড়ে চলে আসতাম। আমরা দিনের বেলা স্কুলে বা কারো বাড়িতে আত্মগোপন করে থাকতাম। মুক্তিযুদ্ধ কালীন সময়ে দেশের অভ্যন্তরে ছিল দুইটি পক্ষ। একটি স্বাধীনতার পক্ষে। অন্যটি স্বাধীনতার বিপক্ষে। আমাদের কার্য এলাকার অধিকাংশ মানুষ ছিল স্বাধীনতার পক্ষে। স্বাধীনতা বিরোধীরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ কারীদের তথ্য দিয়ে পাকিস্তানি সৈন্য নিয়ে এসে বাড়িঘরে অগ্নি সংযোগ, লুটতরাজ,চাঁদাবাজি করতো। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দাতা বাড়ির মালিককে ধরে নিয়ে নির্যাতন ও হত্যা করতো। হিন্দু ও আওয়ামী লীগ নেতারা ছিল ওদের বড় টার্গেট। হিন্দু নারী পুরুষকে ধরে নিয়ে যেত। নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যা করতো। বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধারাও পাকিস্তানি হানাদার পক্ষ ত্যাগ ও তাদের সহযোগিতা করার জন্য বিশেষ ভাবে অত্যাচারী পাকিস্তানি দালাল ও রাজাকারদের হত্যা করতো। গণহত্যা, ধর্ষণ ও অন্যান্য মানবতা বিরোধী কাজে সরাসরি জড়িত কোনপাকিস্তানি হানাদার সৈন্যকে ধরতে পারলে ফায়ারিং স্কোয়ার্ডে বিচার করার পরিকল্পনা ছিল। যে কারণে অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপে সাহসী একজন মুক্তিযোদ্ধা কে জল্লাদ হিসাবে মনোনীত করা হয়েছিল। আমাদের গ্রুপের জল্লাদ হিসেবে মনোনীত ছিলেন দৌলতপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মো: শামসুল হক। আমরা এমন কোন পাকিস্তানি হানাদার সৈন্য ধরতে পারি নাই। আমরা কখনো কাউকে মারি নাই। আমাদের গ্রুপের নীতি ছিল- “আমরা আমাদের দেশী কোনো ভাই কে হত্যা করব না। বুঝিয়ে তাদের কে স্বাধীনতার পক্ষে আনবো” যে কারণে আমাদের মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ কোন স্বাধীনতা বিরোধীকে ধরি নাই, অত্যাচার বা হত্যা করি নাই। আমরা নিজেরা বা তাদের আত্মীয়ের মাধ্যমে বুঝিয়ে বিভিন্ন ভাবে স্বাধীনতা বিরোধীদের স্বাধীনতার পক্ষে আনার চেষ্টা করতাম। আমাদের হাতে আগ্নেয় অস্ত্র থানা সত্বেও আমরা প্রতিটি মুহূর্তে আতঙ্কে থাকতাম। যে কোন সময় পাকিস্তানি হানাদাররা আমাদের আক্রমন করতে পারে। আমাদের থাকা খাওয়া কোন নিশ্চয়তা ছিল না। আমরা আজ এ শেল্টারে কাল সে শেল্টারে থাকতাম। কোন শেল্টারেই একাধিক দিন থাকতাম না। কোন কোন দিন কোন বাড়ি না পেয়ে সারারাত চিড়া গুড় খেয়ে রাত্রি জেগে স্কুলের বেঞ্চে শুয়ে থাকতে হতো। কি যে অমানবীয় কষ্ট। আমাদের শেল্টার পালা ক্রমে আমরা দু’জন করে করে পাহাড়া দিতাম। প্রতি রাতে কমান্ডার স্যার আমাদের পাশ ওয়ার্ড দিতেন। সকালে আমরা অস্ত্রে ফুল থ্রু মারতাম, পরিস্কার করতাম ও অস্ত্রে তেল দিতাম। তখন দেশের অধিকাংশ মানুষ ছিল স্বাধীনতার পক্ষে। আমরা একেক দিন একেক জনের বাড়িতে খাওয়া – দাওয়া করতাম। স্বাধীনতা বিরোধীদের ভয়ে অনেকে আমাদের কে শেল্টার বা খাবার দিতে সাহস পেতেন না। কারণ অধিকাংশ গ্রামেই ছিল ২/১ জন করে পাকিস্তানি দালাল ও রাজাকার। তারা খোঁজ জানলে পাশর্^বর্তী আর্মি বা রাজাকার ক্যাম্পে সংবাদ দিয়ে তাদেরকে নিয়ে এসে বাড়িঘর জ¦ালিয়ে দিবে, বাড়ির মালিককে ধরে নিয়ে হত্যা করবে ও অত্যাচার চালাবে এই ছিল তাদের ভয়। আমাদের সাথে সব সময় চিড়া গুড় থাকতো। স্থানীয় কিছু আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ট্রেনিং দেওয়ায়ে আমাদের সাথে নিলাম। কোথায় ও আক্রমণের পূর্বে আমরা রেকী করে দেখতাম। “জয় বাংলা” ছিল আমাদের রণাঙ্গণেরপ্রধান রণ ধ্বণি। আমি আমার গ্রুপ কমান্ডার ও রণাঙ্গণের সাথিদের বলে রেখে ছিলাম-“ আমি রণাঙ্গণে মারা গেলে, তরঙ্গপুর বাজার থেকে কেনা জাতীয় পতাকা দিয়ে মুড়িয়ে আমার দেহ নদীতে দিয়ে দিবেন” আমি দুই জন গ্রুপ কমান্ডাররের অধীনে সম্মুখ/ গেরিলা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছি। এক- গ্রুপ কমান্ডার জনাব এম.এ মান্নান ও ডেপুটি গ্রুপ কমান্ডার (গ্রুপ কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত) বাবু রবীন্দ্র নাথ বাগচী এর কমান্ডানাধীনে। গ্রুপ কমান্ডার এম.এ মান্নান স্যার এর অধীনে বেলকুচি থানা আক্রমন যুদ্ধ ও কালিয়া হরিপুর রেলওয়ে ষ্টেশন এ্যাম্বুস। বাবু রবীন্দ্র নাথ বাগচীর কমান্ডানাধীনে কল্যান পুর ও ধীতপুর যুদ্ধ। আমাদের গ্রুপ আমরা যে চারটি যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে ছিলাম তা হলো:-

১. বেলকুচি থানা আক্রমণ যুদ্ধ:
বেলকুচি সিরাজগঞ্জ জেলার একটি উল্লেখযোগ্য থানা। এই থানা আক্রমণ যুদ্ধে নেতৃত্বে ছিলেন গ্রুপ কমান্ডার জনাব এম.এ মান্নান স্যার। ২৪ অক্টোবর’৭১ কমান্ডার স্যারের ও আরো ৩ জনের রেকিতে একযোগে বেলকুচি থানা ও মুসলিমলীগ নেতা মোঃ আব্দুল মতিনের বাড়ি আক্রমন করে ছিলাম। সন্ধ্যায় বানিয়া গাতি শেল্টারে কমান্ডার স্যার বিস্তারিত ব্রিফ করে ছিলেন। কমান্ডার স্যার আমাদের গ্রুপ কে দুই গ্রুপে ভাগ করে দিয়ে ছিলেন। সিদ্ধান্ত ছিল কমান্ডার স্যারের নেতৃত্বে বড় গ্রুপটি থানা আক্রমন করবে। অন্য গ্রুপটি রবীন্দ্র নাথ বাগ্চীর নেতৃত্বে মতিন সাহেবের বাড়ি আক্রমন করে মতিন সাহেবকে ধরে আনবে। আমি কমান্ডার স্যারের গ্রুপে থেকে থানা আক্রমন যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে ছিলাম। রাত ৯ টায় বানিয়া গাতি শেল্টার থেকে যাত্রা করে ছিলাম। থানার কাছে গিয়ে দু গ্রুপ টার্গের উদ্দেশ্যে ভাগ হয়ে ছিলাম। রাত ১২টায় একযোগে আক্রমনের সিদ্ধান্ত। পরিকল্পনা মোতাবেক থানার পশ্চিম পাশ দিয়ে স্ক্রোলিং করে থানার সামনে যেতেই সেন্ট্রি দেখে ফেলে ছিল। হুইসেল বাঁজিয়ে থানার সবাইকে জানিয়ে দিয়ে আমাদের কে লক্ষ্য সেন্টি গুলি করে ছিল। তাঁরপর আমাদের গ্রুপ কমান্ডার জনাব এম.এ মান্নান কমান্ড করে ফায়ার ওপেন করে ছিলেন। তারপর সবাই একযোগে গুলি শুরু করে ছিলাম। প্রায় এক ঘণ্টা ব্যাপী যুদ্ধ হয়ে ছিল। যুদ্ধটি ছিল ভয়াবহ যুদ্ধ। আমার মাথায় হেলমেট ছিল। দুইটি গুলি এসে আমার হেলমেটে লেগে ছিল। আমার ডান পাশে অবস্থান নিয়ে ছিলেন এই যুদ্ধের কমান্ডার। আমাদের গ্রুপে তখন ২৭ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিল। বিজয় আর না হয় মৃত্যু ছাড়া কোন পথ ছিল না। বৃষ্টির মত গুলি চালিয়ে ছিলেন। আমাদের গুলির কাছে হেরে গিয়ে থানার বিহারী পুলিশ ও রাজাকারেরা থানার পিছনদিক দিয়ে পালিয়ে সোহাগপুর নদীতে থাকা একটি লঞ্চে আমাদের রেঞ্জের বাইরে যমুনার মধ্যে চলে গিয়ে ছিল। থানার সেন্ট্রি গুলি করা বন্ধ করে দুই হাত উপরে তুলে আত্মসমর্পণ করলো। তারপর আমরা সবাই থানার ভিতরে ঢুকে পড়ে ছিলাম। থানার মাল খানা থেকে সকল অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে ছিলাম। সেন্ট্রি সহ থানার দু’জন রাজাকারকে জ্যান্ত ধরে নিয়ে এসে ছিলাম। ভোর হয়ে গিয়েছিল। মতিন সাহেবের বাড়ি আক্রমন করা দলটিও এলো। মতিন সাহেব পালিয়ে গিয়েছিল। তাকে ধরা সম্ভব হয় নাই। মুক্তিযুদ্ধ কালীন সময়ে অধিকাংশ বাড়ি ও দোকানে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা তৈরি করে রেখে ছিল। থানার আশেপাশের লোকজন দোকান ও বাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দিয়ে ছিলেন। বিজয়ী হয়ে আমরা শেল্টারে চলে এসে ছিলাম। পরদিন সিরাজগঞ্জ থেকে শতাধিক পাকি হানাদার সৈন্য ও রাজাকাররা এসে থানার আশে পাশে আগুন দিয়েছিল এবং মানুষদের নির্যাতন করেছিল।

২. কালিয়া হরিপুরের যুদ্ধ :
কালিয়া হরিপুর স্টেশন সংলগ্ন ব্রীজ পাহাড়ারত রাজাকার ক্যাম্প এ্যাম্বুস। কালিয়া হরিপুর সিরাজগঞ্জ জেলার সদর থানার একটি রেলওয়ে স্টেশন। এই এ্যাম্বুসের নেতৃত্বে ছিলেন গ্রুপ কমান্ডার জনাব এম.এ মান্নান। ৪ নভেম্বর’৭১ গ্রুপের ঝাঐল গ্রামের সিরাজগঞ্জের এম,এন, এ জনাব মোঃ মোতাহার হোসেন তালুকদারের ভায়রা আওয়ামীলীগ নেতা জনাব মোঃ আব্দুল হামিদ তালুকদারের রেকির ভিত্তিতে কালিয়া হরিপুর রেলওয়ে ষ্টেশন সংলগ্ন ব্রীজ পাহাড়ারত রাজাকার ক্যাম্প অ্যাম্বুস করে ছিলাম। কমান্ডার স্যার ক্রোলিং করে রেল লাইনে বৈদ্যুতিক মাইন বসিয়ে এসে ছিলেন। গ্রুপ কমান্ডার স্যার উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে ছিলেন। আমরা সবাই ধানক্ষেতের মধ্যে পজিশন অবস্থায় ছিলাম। কামান্ডার স্যারের হাতে মাইনের তার ও ব্যাটারী। টর্চ লাইট ও হ্যারিকেন হাতে পাকি মিলি শিয়া ও রাজাকারেরা টহল দিচ্ছিল। ওদের পায়ে লেগে হঠাৎ আমাদের মাইনের তার বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে ছিল। মাইনটি পাকি হানাদারদের নজরে পড়ে ছিল। পাকি হানাদাররা হুইসেল দিয়ে রাজাকারদের লাইং পজিশনে রেডি থাকতে কমান্ড করলো। আমাদের দিকে টর্চ লাইট মেরে মেরে উর্দূতে বকাবকি করতে থাকলো। ইতিমধ্যে ঈশ্বরদী থেকে সিরাজগঞ্জ গামী পাকি হানাদার বাহী ট্রেন এলো। পাকি হানাদারেরা সিগন্যাল দিয়ে। ষ্টেশনে ট্রেনটি থামিয়ে দিল। ট্রেনের পাকি হানাদারেরা অস্ত্র তাক করা অবস্থায় নেমে আমারকে কে খুঁজতে থাকলো। আমাদের মাইনটি ব্রাষ্ট করা সম্ভব হলো না। পাকি হানাদারদের সংখ্যাধিক্যতায় ও অন্যান্য বিষয় বিবেচনা করে কমান্ডার স্যার উইথড্র হওয়ার কমান্ড করলেন। আমরা ক্রোলিং করে কিছু দূর পিছিয়ে এসে তামাই গ্রামে চলে এসে ছিলাম। পরের দিন সিরাজগঞ্জ থেকে পাকি হানাদার ও রাজাকারেরা এসে কালিয়া হরিপুরে ও আশেপাশে বিভিন্ন গ্রামের অনেক বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিল এবং গ্রামের অনেককে ধরে নির্যাতন করেছিল। তারা কালিয়া হরিপুর রেলওয়ে ব্রীজ সংলগ্ন রাজাকার ক্যাম্প এ্যাম্বুস থেকে ফিরে এসে তামাই গ্রামে কমান্ডার স্যারের বাড়িতে একত্রিত হই। কমান্ডার স্যারের মা আমাদের জন্য খাবার ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। আমরা কমান্ডার স্যারের বাড়িতে খাওয়া দাওয়া করলাম। খাওয়া-দাওয়ার পর আমাদের সবাইকে বসিয়ে কমান্ডার স্যার ব্রিফ করলেন। স্থানীয় ভাবে ট্রেনিং দেওয়া বেশ কিছু যুবককে আমাদের গ্রুপে ভর্তি করা হয়েছিল। এত বড় প্লাটুন এক শেল্টারে শেল্টার নেওয়া সমস্যা। তাই কমান্ডার স্যার ডেপুটি কমান্ডার রবীন্দ্রনাথ বাগ্চী কে কমান্ডার করে আমাদের ১১ জনের আর একটি গ্রুপ করে দিলেন। এই গ্রুপ এর সবাই রাতে হেটে কল্যাণপুর চলে এলাম।

৩. কল্যাণপুর যুদ্ধ:
কল্যাণপুর সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি থানার একটি গ্রাম। এই যুদ্ধে নেতৃত্বে ছিলেন ডেপুটি কমান্ডার (কমান্ডার হিসাবে নিয়োগ প্রাপ্ত) বাবু রবীন্দ্র নাথ বাগ্চী। কমান্ডার স্যারের নির্দেশে আমরা ১১ জন রবীন্দ্র নাথ বাগ্চীর কমান্ডনাধীন হয়ে হেটে ভোরে বেলকুচি থানার কল্যাণপুর নামক গ্রামে এক বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। ৫ নভেম্বর’৭১ বাড়ির মালিক আমাদের সকালের খাবারের ব্যবস্থা করলেন। আমরা সারারাত নিদ্রাহীন থেকে ও হেটে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। সকালের খাবার খেয়ে প্রকাশ্যে পিটি, প্যারেড করলাম। অস্ত্র পরিষ্কার করলাম। অস্ত্রে ফুলতুরী মারলাম। একজন করে করে ডিউটি করতে থাকলাম। অন্যান্যরা ঘুম বা রেষ্টে থাকলাম। কল্যানপুর একটি নিভৃত গ্রাম। আমাদের ধারনা ছিল এই গ্রামে পাকি হানাদার ও রাজাকার আসবে না। বেলা ১০টার দিকে সেন্ট্রিরত সহযোদ্ধা রতনকুমার দাস দৌড়ে এসে জানালেন আমাদের কে ধরার জন্য বেলকুচি থানা থেকে কয়েকজন পাকি হানাদার মিলে শিয়া ও রাজাকার আসছে। বওড়া গ্রামের মধ্য দিয়ে কল্যানপুরের দিকে আসতে ছিল। দুইজন পাকিস্তানি দালাল গামছা দিয়ে মুখ বেধে নিয়ে হানাদার ও রাজাকারদের পথ চিনিয়ে নিয়ে আস ছিল। দূর থেকে অনুমান হলো এই দলে ৫ জন মিলেশিয়া ও ৮ জন রাজাকার আছে। আমাদের কমান্ডার যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। আমরা কল্যানপুরে রাস্তার ধারে বাংকারের মত বাঁশ ঝাড়ের মধ্যে পজিশন নিলাম। বাঁশ ঝাড়ের সামনে দিয়ে চলা রাস্তা ধরে ওরা আস ছিল। আমাদের রেঞ্জের মধ্যে আসার সাথে সাথে আমাদের কমান্ডার রবীন্দ্রনাথ বাগ্চী কমান্ড ও ফায়ার ওপেন করলেন। এক লাফে হানাদারেরা রাস্তার উত্তর পার্শে¦ পজিশন নিল। ওরাও আমাদের কে লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে ছিল। আমরাও একযোগে বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে থাকলাম। গোলাগুলির শব্দ পেয়ে আশে পাশে অবস্থানকারী মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ তাদেরকে সহযোগীতা করার জন্য এগিয়ে এসে ছিলেন। এক ঘণ্টার অধিক সময় সম্মুখ যুদ্ধ চলছিল। তারপর পাকি হানাদারেরা পিছিয়ে গিয়ে ছিল। যুদ্ধে জয়ী হয়ে আমরা বিজয় উল্লাস করে ছিলাম। সকল স্তরের মানুষের আত্মবিশ্বাস দৃঢ় হলো। এক বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া করে ছিলাম। তারপর হেটে দৌলতপুর গ্রামের সহযোদ্ধা মোঃ শামসুল হকের বাড়িতে শেল্টার নিয়ে ছিলাম। কয়েক দিন দৌলতপুর, তেঞাশিয়া, খুকনী, বাজিয়ারপাড়া, দরগার চর ও অন্যান্য গ্রামে শেল্টার নিয়ে থাকলাম। প্রতিদিন রাতে কমান্ডার পাসওয়াড দিতেন। প্রতিদিন সকালে অস্ত্রে ফুল থ্রু মারা হতো ও তেল দেওয়া হতো।

৪. ধীতপুর যুদ্ধ:
ধীতপুর সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর থানার একটি গ্রাম। এই যুদ্ধে নেতৃত্বে ছিলেন ডেপুটি কমান্ডার (কমান্ডার হিসাবে নিয়োগ প্রাপ্ত) বাবু রবীন্দ্র নাথ বাগ্চী। ১২ডিসেম্বর’৭১ রাতে আমাদের শেল্টার ছিল সৈয়দপুর গ্রামের কালা চক্রবর্ত্তী ও অণ্যান্যের বাড়িতে। ১৩ ডিসেম্বর’৭১ বেলা ১২.০০ টার দিকে সংবাদ পেলাম পাকি হানাদারেরা কৈজুরী হয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। টাঙ্গাইলের যুদ্ধে পাকি হানাদারেরা পরাজিত হয়ে লঞ্চে যমুনা নদী পাড় হয়ে মালিপাড়া ক্যাম্পে এসে ছিলেন। মালিপাড়া ক্যাম্প থেকে রাস্তা চিনানোর জন্য দুই জন রাজাকারকে সঙ্গে নিয়ে এসে ছিল। আমরা পাকি হানাদারদের অফজার্ব করার জন্য ওদের পিছু নিলাম। ওরা ক্ষুধার্ত। কৈজুরী গ্রামের একজনের মুলা ক্ষেত থেকে মুলা খাওয়ার চেষ্টা করলো। ওরা হয়তো জানতো না কাঁচা মুলা খাওয়া যায় না। ওয়াপদা বাধ ধরে ওরা অগ্রসর হতে লাগলো। আমরাও নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে করে ওদের পিছু পিছু যাচ্ছিলাম। ওরা ভীষণ ক্রোধী। ধীতপুর নামক স্থানে গিয়ে ওরা আমাদের দিকে অস্ত্র তাক করে ছিল। আমরা জাম্প করে ওয়াপদা বাঁধের পশ্চিম দিকে পজিশন নিয়ে ছিলাম। পাকিস্তানি হানাদারেরা ওয়াপদা বাধের পূর্ব পার্শ্বে পজিশন নিয়ে ছিল। এক ঘণ্টা ব্যাপি গুলি পাল্টা গুলি চলতে থাকলো। গুলির শব্দে শাহজাদপুর ও বেড়া থানার বিভিন্ন স্থানে অবস্থানকারী মুক্তিযোদ্ধা দল আমাদের সহযোগিতা করার জন্য এগিয়ে এলো। এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। হানাদারেরা গুলি করা বন্ধ করলো। আমরাও অন্ধকারে গুলি করা বন্ধ করে দিয়ে ছিলাম। সারারাত আমরা না খেয়ে পজিশন অবস্থায় ছিলাম। আমাদের গ্রুপটি ছিল বাবু রবীন্দ্র নাথ বাগচী কমান্ডানাধীন। এই ভয়াবহ যুদ্ধে বেড়া থানার বৃশালিকা গ্রামের অধিবাসী বেড়া বিবি হাই স্কুলের এর দশ শ্রেণীর ছাত্রী মো: আব্দুল খালেক ও ছেচানিয়া গ্রামের মো: আমজাদ হোসেন গুলিবৃদ্ধ হয়ে গুরুত্বর আহত হন। পরে দুই জনই শহিদ হয়েছেন। ঐ দিন স্থানীয় দুজন পথচারী গোলাগুলির সময়ে গুলি লেগে মারা গিয়ে ছিল। আমাদের অন্যান্য গ্রুপের চার জন আহত হয়ে ছিলেন ধীতপুর যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে আমরা জামিরতা হাই স্কুলে ক্যাম্প করে অবস্থান নিয়ে ছিলাম। ১৪ ডিসেম্বর’৭১ শাহজাদপুর থানা হানাদর মুক্ত হয়ে ছিল। ১৬ ডিসেম্বর’৭১ সোহরাওর্য়াদী উদ্যানে তদানীন্তন রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি হানাদারেরা মাথা নিচু করে আত্মসমর্পণ করে ছিল। ১৭ ডিসেম্বর’৭১ ভারতীয় বিমান বাহিনী বাংলাদেশের আকাশ পথ ঘুড়ে যুদ্ধত্তোর স্বাধীন বাংলাদেশের অবস্থা দেখে ছিল। ১০ জানুয়ারী’৭২ জাতির পিতা পাকিস্তানের কারাগার হতে মুক্ত হয়ে দেশে আসলেন। ১২ জানুয়ারী জাতির পিতা প্রথমে রাষ্ট্রপতি হিসেবে এবং পরক্ষণেই রাষ্ট্রপাতি পদের ইস্তেফা দিয়ে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রথা চালু করে প্রধান মন্ত্রী হিসাবে দেশের দায়িত্ব ভার গ্রহণ করলেন। জাতির পিতা আমাদেরকে অস্ত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। আমাদের গ্রুপ ২৪ জানুয়ারী’৭২ রবিবার সিরাজগঞ্জ সদরস্থ ইব্রাহিম বিহারী বাসায় অস্ত্র ও গোলা বারুদ জমা দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের দায়িত্ব শেষ করে ছিলেন। সরকার থেকে ন্যাশনাল মিলেশিয়া ক্যাম্প স্থাপন করা হলো। আমাকে ন্যাশনাল মিলেশিয়া ক্যাম্পের ভর্তির পরামর্শ দিয়ে ছিলেন। আমি ন্যাশনাল মিলেশিয়া ক্যাম্পে ভর্তি হলাম না। বাড়িতে চলে এলাম। ১০ ফেব্রুয়ারী’৭২ সিরাজগঞ্জ মহকুমা কার্যালয় থেকে জেনারেল এম. এ.জি ওসমানীর সনদ নম্বর: ১২৯১৫৮। একটি সাদা কম্বল ও বকেয়া পকেট মানি ও রেশনিং মানি হিসেবে ১১০/- টাকা দেওয়া হলো। বাড়ি এসে রতন কান্দি নি¤œ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আমার বড় দাদা দেবেন্দ্র নাথ সান্যাল এর কাছ থেকে অষ্ঠম শ্রেণির অটোপাশের টিসি নিয়ে শাহজাদপুর বহুপার্শি^ক উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণি বিজ্ঞান ভর্তি হয়ে লেখা-পড়া শুরু করেছিলেন।

 

লেখক ঃ বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক ব্যাংকার।

 

মুক্তিযোদ্ধার পরিচিতি: বীর মুক্তিযোদ্ধা দেবেশ চন্দ্র সান্যাল,পিতা: দ্বিজেন্দ্র নাথ সান্যাল,মাতা: নিলীমা সান্যাল, গ্রাম ও ডাকঘর: রতন কান্দি,ইউনিয়ন: হাবিবুল্লাহনগর,উপজেলা: শাহজাদপুর, জেলা: সিরাজগঞ্জ। গেজেট নং-বে-সামরিক সিরাজগঞ্জ-১৬৭৯। ভারতীয় প্রশিক্ষণ – এফ.এফ. নং-৪৭৪২। সমন্বিত তালিকা জলা ভিত্তিক -১৪১১, উপজেলাভিত্তিক-১৫৮ মুক্তিযোদ্ধা পরিচিতি – ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিষ্টেম, ডিজিটাল সনদ ও পরিচয় পত্র নং- ০১৮৮০০০১৪১১।

Loading