আত্মশুদ্ধি ও তাকওয়া অর্জন রোজার উদ্দেশ্য

প্রকাশিত: ৮:২০ অপরাহ্ণ , মার্চ ২০, ২০২৪

মাহমুদুল হক আনসারী

রমজানে মুমিন মুসলমানের অন্যতম কাজ হলো তাকওয়া অর্জন করা। কেননা তাকওয়া অবলম্বনের মাধ্যমে এ মাসে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন সহজ হয়। রমজানে রোজা ফরজ করার উদ্দেশ্যই হলো মানুষ দুনিয়ার সব অন্যায় ও গর্হিত কাজ থেকে বিরত থেকে নিজকে আল্লাহর বন্ধু হিসেবে তৈরি করবে।

তাকওয়া বা পরহেজগারী অর্জন করার একমাত্র উপায় হলো রোজা পালন করা। আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারিমে ঘোষণা করেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর; যেন তোমরা তাকওয়া বা পরহেযগারী অর্জন করতে পার।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৩)

রোজা এমনই এক ইবাদত। যা দুনিয়ার সব নবি-রাসুলের ওপর ফরজ ছিল। রোজা ফরজ হওয়ার অন্যতম কারণ হলো তা মানুষকে তাকওয়ার শিক্ষা দেয়। আর এ কারণেই আল্লাহ তাআলা নিজেই রোজার প্রতিদান দান করবেন।

মানুষের জীবন গঠন ও পরিচালনার একমাত্র প্রশিক্ষণের সময় হলো পবিত্র রমজান মাস। এ মাসে প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাধ্যম হলো রোজা। আর তাকওয়া অর্জনের প্রথম মাধ্যমও রোজা।

তাকওয়া অর্জনের প্রথম প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে রোজার বিধান পালনে মানুষ ভোর রাতে নির্দিষ্ট সময়ে নিয়ম মেনে সাহরি খায়। সারাদিন আল্লাহ বিধি-বিধান পালনার্থে পানাহার ত্যাগ করে ইবাদাত-বন্দেগিতে ব্যস্ত থাকে। সময় মতো জামাআতে নামাজ আদায় করে।

আবার সুর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গেই ইফতার করে। রাতে নিয়ম মেনে তারাবিহ নামাজ আদায় করে। কুরআনের বিধান মানতে রমজানের এ নিয়মতান্ত্রিকতা বছরের অন্য মাসগুলো পালনে এবং তাকওয়া অবলম্বনে রোজাদারের জন্য রমজান মাস হলো প্রশিক্ষণ কর্মশালা।

রমাজানের দীর্ঘ এক মাসের রোজার প্রশিক্ষণ শেষে মানুষ আবার আগের মতো পানাহার করবে ঠিকই কিন্তু বছরের বাকি সময় অন্যায় কাজ থেকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে রমজানের রোজার শিক্ষা স্থায়ীভাবে বিরাজ করবে সবার মাঝে।

তাকওয়া অর্জনে অন্যতম অন্তরায় হচ্ছে মিথ্যা। কেননা মিথ্যাকে সকল পাপের জননী বলা হয়। মিথ্যা বর্জনে রমজান মাসের বিকল্প নেই। তাকওয়া বা পরহেজগারী হলো মিথ্যা দূরভীত করার অন্যতম মাধ্যম। যার মাঝে তাকওয়া বা পরহেজগারী থাকবে, ওই ব্যক্তির দ্বারা মিথ্যা বলা সম্ভব হবে না। এ তাকওয়া বা পরহেজগারী মানুষকে মিথ্যা বলা থেকে বিরত রাখে। যা পবিত্র রমজান মাসেই অর্জন সম্ভব।
অপরাধমুক্ত সুশৃঙ্খল ও সুন্দর জীবন-যাপন এবং সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে রমজানে কুরআনের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। মানব জীবনকে সুন্দর, পরিপাটি ও শান্তিময় করার দিক-নির্দেশনা জানার পাশাপাশি মানতে হবে কুরআনের সকল করণীয় বিধি-বিধান।

পরিহার করতে হবে দুনিয়া ও পরকালের সুখ-শান্তি ধ্বংসকারী গোনাহের সব কাজ। নিষিদ্ধ কাজ পরিহার করে তাকওয়া অর্জনে কুরআনের নির্দেশ বাস্তবায়ন করাই হবে মানব জীবনের একমাত্র করণীয় কাজ।

রমজানের রোজা পালনের মাধ্যমে মানুষ লাভ করবে শান্তিময় নিয়মতান্ত্রিক জীবন এবং অর্জন করবে তাকওয়া ও পরহেজগারী।

রমজানের উদ্দেশ্য তাকওয়া। তাকওয়া অর্থ আল্লাহর ভয়। আল্লাহর ভয়ে সব মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকা। সংযম অবলম্বন করা। এই সংযম সব শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য। ব্যবসায়ী ও বিক্রেতারা অতি মুনাফার লোভ সংযত করবেন, কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি থেকে বিরত হবেন। ভোক্তা ও ক্রেতারা অহেতুক অধিক পরিমাণে পণ্য ক্রয় থেকে বিরত থাকবেন। সরকার ও প্রশাসন শুধু রাজস্ব বাড়ানো আর অর্থকরী ব্যবস্থার পরিবর্তে জনকল্যাণে ব্রতী হবে। তবেই রমজানের উদ্দেশ্য সফল হবে। রহমতের অফুরন্ত ধারা প্রবাহিত হবে। মাগফিরাত ও নাজাত লাভ হবে।

রমজান মাস উপবাস পালনের মাস। যাতে ধনীরা অভাবী মানুষের ক্ষুধার যন্ত্রণা উপলব্ধি করতে পারেন। কিন্তু আমরা রমজানকে ভোজের আয়োজনে পরিণত করি। পানাহারের প্রতি এত বেশি মনোযোগী হই, যাতে ইবাদতে বিঘœ সৃষ্টি হয়। সামর্থ্যবানেরা এত বেশি বাজার করেন, এতে গরিব মানুষ কেনার সুযোগ পায় না, যা রমজানের শিক্ষার ও উদ্দেশ্যের পরিপন্থী। সহমর্মিতার এ মাসে আমাদের আশপাশে প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজন যাঁরা অভাবী আছেন, তাঁদের ইফতার ও সাহ্রির ব্যবস্থা করা আমাদের সবার নৈতিক দায়িত্ব। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, ‘সে ব্যক্তি পরিপূর্ণ ইমানদার নয়, যে পেট ভরে আহার করে আর তার প্রতিবেশী অনাহারে থাকে (মুসলিম)।’

আল্লাহর রহমত সর্বকালে সর্বত্র বর্ষিত হতে থাকে; পবিত্র রমজান মাসে এর ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়, জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়, শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়। ফলে রোজা, নামাজ, তিলাওয়াত, দান-সদকা, ফিতরা, জাকাত, জিকির-আসকার যাবতীয় ইবাদত অনুশীলন ও তাকওয়া অর্জন সহজ হয়।

সাওম বা রোজা পালনের পাশাপাশি তাকওয়া তথা খোদাভীতি সদা মনে জাগরূক রাখতে হবে। সংযম, সহমর্মিতা, সমবেদনা, ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা অবলম্বন করতে হবে। তবেই রহমত, মাগফিরাত ও নাজাত লাভ নিশ্চিত হবে।
আল্লাহতায়ালা রমজানের রোজা আমাদের জন্য এ কারনেই ফরজ করেছেন যাতে আল্লাহতায়ালার সমস্ত আদেশ নিষেধ মেনে চলে যেন আমরা তাকওয়া অবলম্বন করতে পারি। আল্লাহতায়ালার নৈকট্য লাভ করতে পারি। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য রোজা একটি বড় মাধ্যম।

পবিত্র কোরআনে বারবার তাকওয়া অর্জন করার কথা বলা হয়েছে, এই তাকওয়া আমরা কিভাবে অর্জন করবো? আমাদেরকে জানতে হবে তাকওয়া কাকে বলে আর তাকওয়া কি জিনিস? তাকওয়া অর্জনের মূল কথা হলো, আমরা যেন সকল প্রকার পাপ থেকে বিরত থাকি, পাপ বর্জন করতে চেষ্টা করি। আর এই চেষ্টা এমন এভাবে করতে হবে যেভাবে কেউ ঢালের আড়ালে এসে নিজেকে নিরাপদ করতে চেষ্টা করে।

বড় কোন বিপদ থেকে আমরা যেমন নিজকে বাঁচাবার জন্য অনেক চেষ্টা করি। তেমনভাবে আল্লাহ বলেছেন, রোজা রাখ, যেভাবে রোজা রাখার নির্দেশ রয়েছে। আর আমরা যদি সেভাবে রোজা রাখি, তবেই তাকওয়ার পথে এগিয়ে গিয়ে উন্নতি লাভ করতে পারবো।

যারা পূর্বে থেকেই পুণ্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত, তাদের এই পবিত্র রোজা পালনের মাধ্যমে তাকওয়ার মান আরো বৃদ্ধি করে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে সহজতর হবে।

আমাদের মনে রাখতে হবে রমজান মাসের রোজা কেবল এতটুকুই না যে, নির্দিষ্ট সময় খানা-পিনা থেকে বিরত থাকলেই আমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারবো। বরং তাকওয়া অর্জন করতে হলে প্রকৃত অর্থে রোজাও রাখতে হবে আর বেশি বেশি ইবাদত-বন্দেগিতে নিয়োজিত থাকতে হবে। সেই সাথে সব ধরনের মন্দ কাজ ছেড়ে দিতে হবে। ইবাদত বন্দেগী নির্ভেজাল ও একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই হওয়া চাই। দান সদকা খয়রাত লোক দেখানো যেনো না হয়। গরীব দুঃখী অসহায় দুঃস্থ প্রতিবেশীর প্রতি সাধ্যমতো সাহায্য সহযোগীতা থাকা চাই।

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে হবে। মৌজুদদারী মনোভাব পরিহার করতে হবে। প্রতিবছর রমজান আসলে মজুদদার মুনাফা লোভী সিন্ডিকেট তৎপর হয়ে ওঠে। পৃথিবীর অপরাপর দেশে রোজাদারদের সম্মান দেখানো হলেও বাংলাদেশে তার বিপরীত। এই সংস্কৃতি থেকে মুসলিম সমাজকে বেরিয়ে আসতে হবে। রমাজনের তাকওয়া পরহেজগার আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য মানব সৃষ্টিকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানানো উচিত। সমাজের সুখ শান্তি ক্রয় ক্ষমতা তাদের জীবন যাপনের ওপর মানবিক দায়িত্ব থাকা চাই। রমজানের শিক্ষা সমাজের আশপাশে থাকা দরিদ্র মানুষের খবরদারী করতে হবে। সাধ্যমত তাদেরকে রোজা পালনে সাহায্য প্রদান করতে হবে। অশ্লীল বাদ্যবাজনা ও আচার আচরণ থেকে সংবরণ করতে হবে। সর্বাবস্থায় নফসকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। তবেই রোজার পূর্ণস্বাদ একজন ঈমানদার মুসলমান গ্রহণ করতে পারে।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে রমজানের তাকওয়া অর্জনের তাওফিক দান করুন। সুশৃঙ্খল জীবন গঠনে কুরআনের বিধান বাস্তবায়নে রমজানের নিয়ম-কানুনকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করার ক্ষমতা দান করুন। রমজানের রহমত বরকত মাগফেরাত ও নাজাতের দুয়ার রাব্বুল আলামীন মানবজাতির জন্য খুলে দিবেন। আসুন ব্যক্তি, পরিবার, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে রমজানের তাকওয়া অর্জন এবং বাস্তবায়নে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালন করি।

লেখক
মাহমুুদুল হক আনসারী
সংগঠক,গবেষক,কলামিষ্ট

Loading