শিশু হাসপাতালের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে ৫ সদস্যের কমিটি

প্রকাশিত: ১০:১০ অপরাহ্ণ , এপ্রিল ১৯, ২০২৪

রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে অবস্থিত বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে (ঢাকা শিশু হাসপাতাল) ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। আগুনে হাসপাতালের ‘বি’-ব্লকের ৫ম তলায় কার্ডিয়াক বিভাগের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। এ সময় আইসিইউ শয্যার সব ধরনের সরঞ্জাম ধ্বংস হয়ে যায়।

শুক্রবার দুপুর পৌনে ২টার দিকে এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের মোহাম্মদপুর, সিদ্দিক বাজার ও তেজগাঁও ফায়ার স্টেশন থেকে অগ্নিনির্বাপক দল ছুটে আসে। তাদের সঙ্গে যোগ দেন নৌ-বাহিনীর সদস্যরাও। ফায়ার সার্ভিস ও ডিফেন্সের পাঁচটি ইউনিট একযোগে ১ ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, এসি বিস্ফোরণ থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে। ঘটনার পর স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. রোকেয়া সুলতানা হাসপাতালে ছুটে যান।

এদিকে অগ্নিকাণ্ডের পর হাসাপাতালের রোগী, তাদের স্বজন এমনকি চিকিৎসক-নার্সসহ সবার মাঝে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। প্রাণ বাঁচাতে তারা দিগি¦দিক ছোটাছুটি করতে থাকেন। রোগীদের অক্সিজেন, ক্যানোলা, স্যালাইন সংযোগ খুলে ওই ব্লক থেকে বের হয়ে যান। রোগী ও তাদের স্বজনরা ভয় ও আতঙ্কে বাইরে বেরিয়ে তীব্র গরমের মধ্যে এখানে-সেখানে আশ্রয় নেন। হুড়োহুড়ি করতে গিয়ে অনেকে কমবেশি আহতও হন। এ ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কার্ডিয়াক বিভাগের প্রধান ডা. রেজোয়ানা রিনার নেতৃত্বে এই কমিটিকে ৩ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পরই অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে বিস্তারিত জানা যাবে।

অগ্নিকাণ্ডের পর ‘বি’ ব্লকের সব রোগীকে সরিয়ে ফেলা হয়। এই ব্লকের ১৯৪টি শয্যায় ১৭৩ জন শিশু রোগী চিকিৎসাধীন ছিল। এরমধ্যে আইসিইউ, পিআইসিইউ এবং এনআইসিইউ, স্ক্যাবু, এইচডিইউর ১৬টি শয্যায় চিকিৎসাধীন রোগীদের পার্শ্ববর্তী জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে স্থানান্তর করা হয়। কিছু রোগী ছাড়পত্র নিয়ে অন্যত্র চলে যান। আগুন লাগার পরপর যেসব রোগী জীবন বাঁচাতে বাইরে বের হয়ে গিয়েছিলেন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার পর তারা ওয়ার্ড ও কেবিনে ফিরে যান।

আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) এক বার্তায় জানায়, আগুন নিয়ন্ত্রণে যোগ দেয় নৌবাহিনী। আগুন নেভানোর কাজে যোগ দেওয়া নৌবাহিনীর ঘাঁটি হাজী মহসিনের লেফটেন্যান্ট কমান্ডার তানবিনুর রহমান বলেন, আইসিইউতে যত রোগী ছিলেন, সেসব রোগী ও তাদের স্বজনদের নিরাপদে সরিয়ে নিয়েছেন তারা।

সরেজমিন দেখা যায়, অগ্নিকাণ্ডের সময় পুরো হাসপাতালে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য তৈরি হয়। রোগী ও তাদের স্বজনরা চিৎকার করে কান্নাকাটি করতে থাকেন। প্রিয়জনের জীবন রক্ষায় যে যার মতো প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করেন।

চিকিৎসা নিতে আসা নাসরিন বেগম নামে এক স্বজন জানান, তার বাচ্চা আইসিইউতে ভর্তি ছিল। মুখে ছিল অক্সিজেন মাস্ক। আগুনের খবরে মুখের অক্সিজেন খুলে প্রথমে চার তলায় ছুটে যান। সেখানে অক্সিজেনের ব্যবস্থা না থাকায় নিচে নেমে আসেন।

রোগীর স্বজনরা আরও জানান, দুপুরে আইসিইউর ভেতর হঠাৎ বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। এর পরপরই আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় ভবনের কার্ডিয়াক ইউনিট এবং এর আশপাশের ওয়ার্ডসহ পুরো ভবন প্রচণ্ড ধোঁয়ায় অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায়। আইসিইউতে ভর্তি থাকা শিশুর স্বজনরা ভয়ে কাঁদতে থাকেন।

স্বজনরা অভিযোগ করে বলেন, এতবড় একটা হাসপাতাল, অথচ আগুন নির্বাপণের জন্য পর্যাপ্ত সরঞ্জাম নেই। আগুন নেভানোর মতো প্রাথমিক ব্যবস্থাও নেই তাদের।

হাসপাতালে সন্তানের চিকিৎসা নিতে আসা জোবায়ের আলম বলেন, ‘আমার ৬ বছর বয়সি কন্যা সন্তান ভর্তি রয়েছে। আগুন লাগার খবর পেয়ে মেয়েকে কোলে নিয়ে আমরা স্বামী-স্ত্রী দৌড়ে নিচে নেমে আসি। কারণ, এর আগে বেইলি রোড ট্র্যাজেডিতে শুধু ধোঁয়ায় অনেকে মারা গেছেন।

এক রোগীর স্বজন রফিকুল ইসলাম জানান, তিনি জুমার নামাজ পড়তে গিয়েছিলেন। হঠাৎ আগুন লাগার খবরে দৌড়ে হাসপাতালে এসে দেখেন আগুন জ্বলছে। চতুর্দিকে ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। পরে দ্রুতই তিনি তার রোগীকে নিয়ে হাসপাতালের নিচে নেমে আসেন। শুনেছি আইসিইউর বিছানার কাপড়ে আগুন লেগে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

আগুনে আইসিইউতে থাকা ১০টি মেশিন পুড়ে অকেজো হয়ে যায়। অগ্নিকাণ্ডের পর কার্ডিয়াক বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, আইসিইউর চিকিৎসক কক্ষে থাকা এসি, কম্পিউটার, প্রিন্টার, চেয়ার-টেবিলসহ রোগী ও চিকিৎসকদের ফাইলপত্র পুড়ে ছাই হয়ে যায়। কক্ষের দেওয়ালসহ সবকিছুতেই কালো ধোঁয়ার আস্তরণ পড়ে আছে।

মোহাম্মদপুর ফায়ার স্টেশনের সিনিয়র অফিসার মোহাম্মদ ফখরুদ্দীন জানান, প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি, আইসিইউর ভেতর থাকা এসি বিস্ফোরণ থেকে আগুনের ঘটনা ঘটেছে। যেখানে সূত্রপাত হয়েছিল, সে জায়গাটিতে অক্সিজেন সরবারহ থাকায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে কিছুটা বেগ পেতে হয়েছে। পরে অক্সিজেন সংযোগ বন্ধ করে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। তিনি বলেন, অগ্নিকাণ্ডের পর রোগীদের সরিয়ে নেওয়ায় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেনি।

বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম জানান, দুপুরের দিকে হাসপাতালের ‘বি’ ব্লকের পাঁচ তলায় আইসিইউতে আগুন লাগার পর শিশুদের দ্রুত সরিয়ে নেওয়া হয়। আগুনের ঘটনায় কেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, খোঁজখবর নিয়ে জানাতে পারব।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আগুনের ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে ৩ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

কার্ডিয়াক বিভাগে কর্তব্যরত এক নার্স বলেন, আগুনে পুড়ে যাওয়া প্রত্যেক শয্যায়ই রোগী ছিল। যখন দুর্ঘটনা ঘটে তখন আইসিইউতে ১৬ জন রোগী ছিল। আগুন লাগার পর তাদের প্রত্যেককেই বিভিন্ন ওয়ার্ড ও অন্যান্য আইসিইউগুলোতে স্থানান্তর করা হয়। তিনি বলেন, আগুনে পুরো বেড, দেওয়াল, এসি, ফ্রিজসহ অক্সিজেন সামগ্রী পুড়ে গেছে। যেগুলোর কোনোটাই আর ব্যবহার উপযোগী নয়। যেগুলো ছিল তা এখন দাহ্য পদার্থ।

কর্তব্যরত এক চিকিৎসক বলেন, আগুন নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বড় সমস্যার কারণ ছিল ধোঁয়া। আইসিইউ থেকে ধোঁয়া বের হওয়ার কোনো পথ ছিল না। ফায়ার সার্ভিসকর্মীরা এসে কয়েকটি জানালার কাচ ভেঙে ধোঁয়া বের হওয়ার ব্যবস্থা করেন। আগুন যদি আরও ছড়িয়ে পড়ত, তবে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা ছিল বলে মন্তব্য করেন তিনি।

স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. রোকেয়া সুলতানা সাংবাদিকদের বলেন, হাসপাতালের চেয়ার-টেবিল, এসি-ফ্রিজ, শয্যাসহ যা কিছু পুড়েছে সবকিছু ক্ষয়ক্ষতির বিষয় সঠিকভাবে তদন্ত করে তদন্ত কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে

Loading