কবিগান : বাংলা সংস্কৃতির মার্গীয় মেধাসত্ত্বের রত্নালংকার – জাহাঙ্গীর আলম সরকার

প্রকাশিত: ২:৫৫ পূর্বাহ্ণ , অক্টোবর ১৬, ২০২০

কবিগান’ : বাংলা সংস্কৃতির মার্গীয় মেধাসত্ত্বের রত্নালংকার

– এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার পিপিএম :

বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির আকাশে কবিগান, পুঁথিপাঠ, জারি, সারি, ভাটিয়ালি, মুর্শিদি, পাঁচালী, ময়মনসিংহ গীতিকা, ভাওয়াইয়া, নবান্নের গান, হাসন-লালন,পদাবলী, শাস্ত্র পাঠ, প্রত্যেকটি বিষয় এক একটি দুর্লভ উজ্জ্বল দ্যুতি সম্পন্ন নক্ষত্রের মত। এসব নিজস্বতা বাঙালি জাতিকে বিশ্বের যে কোনও জাতিসত্তা থেকে পৃথক করেছে, যা শুধুমাত্র আমাদের। বিশ্বের অন্য কেউ, অন্য কোন জাতির মধ্যে এসকল জ্ঞান-গরিমা, বিদ্যা, বুদ্ধি চলন-বলন, সুর, ছন্দ, মাত্রা খুব একটা আছে বলে আমার জানা নেই। যার মূল্যায়নে বিশ্বের যে কোনও জাতির চেয়ে বিদ্যাযাত্রায় আমাদের এ চলন গুলি ছিল অত্যন্ত উচ্চমার্গীয়। আটষট্টি হাজার গ্রামবাংলার সাধারন মানুষের জীবনযাত্রা, আচার ও বিনোদনের নিত্য সঙ্গী ছিল সাহিত্য ও সংস্কৃতির এ মহামূল্যবান বিষয়বস্তুগুলো।
এমনকি, বাঙালীর ক্রীড়া সংস্কৃতিতেও ছি-কুতকুত, গোল্লাছুট, দাড়িয়াবান্ধা, চোর-পুলিশ, বউচি, ইচিং-বিচিং, ডাংগুলি ইত্যাদি অনন্য বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন খেলাধুলা নিতান্তই আমাদের নিজস্ব স্বকীয়তা হিসেবে সাধারণ মানুষের আনন্দ বিনোদনের দারুণ উপভোগ্য ছিল। বিশ্ব প্রেক্ষাপটে এ জাতীয় খেলাধুলা বাঙালীজাতি, রাষ্ট্র ও মানুষের নিজস্ব সৃজনশীলতার পরিচায়ক।

বিশ্ব মানচিত্রে ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে এ বদ্বীপ রাষ্ট্রের অবস্থানগত সুবিধা এবং নদ-নদী, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, পাহাড়, পর্বত, সমুদ্র বেষ্টিত হওয়ায় পরিবেশগত কারণে দুর্যোগ, খরা, বৃষ্টি, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় নানাবিধ বিশ্বাস এবং প্রেক্ষাপটকে মাথায় রেখে বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে বিশেষ ধরনের লোকজ সংস্কৃতি এবং খেলাধুলার উদ্ভব হয়েছে। সেইসাথে ঋতু বৈচিত্রের বিবেচনায় আমরা এতগুলো ঋতুর স্বাদ, সুবিধা-অসুবিধা ভোগ করে এ সকল ক্ষেত্রে বিশেষ পারঙ্গমতা এবং সৃষ্টিশীলতার স্বাক্ষর হিসেবে এমনসব ভিন্নতর বৈশিষ্ট্যের সাহিত্য-সংস্কৃতি রচিত হয়েছে, যা নিতান্তই আমাদের নিজস্ব সম্পদ। বিশ্বের যারা যেভাবেই ভাবুক না কেন, এ সকল মূল্যবান সম্পদ অনন্য সংস্কৃতি ঋদ্ধ লোকজ জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে কতটা উন্নত, ব্যতিক্রমী ও গবেষণাধর্মী তা আমরা খুব একটা অনুধাবন করতে না পারলেও, বিশ্ব ভাবনার পণ্ডিতদের কাছে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, হাসন রাজাকে রাজদরবার টানতে পারেনি ততটা, যতটা লোকজ সংস্কৃতি তাকে টেনেছে। বরপুত্র লালন সাঁইজি কে নিয়ে এখনও গবেষণা চলছেই। কি এমন স্বাদ, গন্ধ, রূপ, রস, যৌবনে ভরা এই বিষয়গুলো,যা খুব সহজেই বাঙালী জাতিকে বিশ্বের অন্য দেশ থেকে পৃথক করতে পেরেছে? তারই জবাব পেতে এতকিছু থেকে আমি একটি মাত্র বিষয়ের অবতারণা করতে চাই এ লেখাটিতে। তা হল বাংলার সাহিত্য আকাশের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র আমাদের স্বকীয় কবিগান।

দুইশত চুয়ান্ন বছরের ইতিহাস পাওয়া যায় বাংলাদেশের ভোলা জেলার একটি কবিগান উৎসব আয়োজন কে ঘিরে। সুপ্রাচীন এই বিশেষায়িত ধারা বেশ কিছু লোকজসঙ্গীতের সংমিশ্রণে জন্ম নিয়েছে, যার মূল উপজীব্য ছিল গ্রামবাংলার বাউল ধর্মতত্ত্ব, আধ্যাত্মিক জীবনতত্ত্ব,দেহতত্ব, প্রকৃতিবিদ্যাসহ বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক মৌল ধারনার সমন্বিত এক অসামান্য জ্ঞান, যা গুরুবিদ্যার পরম্পরা রুপে বহুলচর্চিত ছিল। সামান্যতে এ বিদ্যার অস্তিত্ব পাওয়া সম্ভব নয়। সাধারণত স্বশিক্ষিত স্বভাব কবিদের মধ্যে এ ধারাটি বেশি পরিলক্ষিত হয়েছে। চর্চা ও গ্রহনযোগ্যতার বিচারে এটি তৎকালীন অবিভক্ত বঙ্গভূমির প্রায় সর্বত্র সমান ধারায় দীর্ঘকাল ধরে পরিবেশিত হয়েছিল। দুই বাংলাতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কবিয়াল পরিচিতি রয়েছে। কবিয়াল বিজয় সরকার চারহাজার আসরে পরিবেশন করেছেন দুই বাংলা মিলে।

ড. সুশীল কুমার দে ‘র মতে,সপ্তদশ শতাব্দীতেও কবিগানের অস্তিত্বের প্রমান পাওয়া যায়। গবেষনায় জানা গেছে এই চর্চার প্রকৃত বিকাশকাল ১৭৬০ থেকে ১৮৩০ সালের মধ্যবর্তী সময়।
‘বাংলার কবিগান ‘ গ্রন্থে সাহিত্যগবেষক সজনীকান্ত দাশ বলেন- অবিভক্ত বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে প্রচলিত বহুরকমের সাংগীতিক ধারার মিলনেই কবিগানের জন্ম।ধারাগুলো হল- তরজা,পাঁচালি,খেউড়,আখড়াই,ঢপকীর্তন,টপ্পা,
কৃষ্ণযাত্রা,তুক্কাগীতি ইত্যাদি।

সর্বাপেক্ষা প্রাচীন কবিয়াল হিসেবে ইতিহাসবিদগন গোঁজলা গুঁই এর নাম খুঁজে পান।সম্ভবত ১৭০৪ সালে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলায় তার জন্ম হয়।তার শিষ্য লালু নন্দলাল, কেষ্টামুচি,রঘুনাথ দাস ও রামজির হাত ধরেই অষ্টাদশ শতাব্দী ও পরবর্তীতে বিখ্যাত কবিয়ালদের উদ্ভব হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত কবিয়ালরা ছিলেন – হরু ঠাকুর, নিত্যানন্দ বৈরাগী, রামবসু, ভোলা ময়রা, ভবানী বণিক, এ্যন্টনী ফিরিঙ্গী, বলহরি দে, শম্ভুনাথ মন্ডল, যজ্ঞেশ্বরী দেবী, তারক সরকার, রমেশ চন্দ্র শীল প্রমুখ। এমন কি, বিখ্যাত মুকুন্দ দাস ও প্রকৃতপক্ষে একজন কবিয়াল ছিলেন।

১৮৫৪ সালে কবি ঈশ্বর গুপ্ত সর্বপ্রথম কবিগান সংগ্রহ করে ‘সংবাদ প্রভাকর ‘ পত্রিকায় প্রকাশ করা শুরু করেন। লোকসঙ্গীতের সর্বোচ্চ প্রতিভার এই বিশেষ ধারায় লোককবিরা প্রতিযোগীতামূলক গানের আসরে অংশগ্রহন করতেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্নোত্তর পর্বে মুখে মুখে পদ রচনা করে তাৎক্ষণিকভাবে সুরারোপ করে বাদ্যযন্ত্র সহকারে তা পরিবেশন করতেন। তথ্যমতে- ডাক, মালসি, সখীসংবাদ, কবি, টপ্পা, ধুয়া, প্যার ও পাঁচালি এই আট ভাগে বিভক্ত হয়ে কবিগান পরিবেশিত হত।

যে আধুনা সাহিত্যের উদাহরন দিয়ে আমরা বর্তমান বাঙ্গালীরা বিশ্বের কাছে নিজেদের সাহিত্যকর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশে উদগ্রীব, একটু ভেবে দেখবেন কি- এই কবিয়াল সম্প্রদায়ের মানুষগুলো প্রকৃতপক্ষে কি সৃষ্টি করে গিয়েছিলেন সে সময়ে, যার খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজনও আমরা সঠিক ভাবে অনুধাবন করিনি!

কল্পনা করুন- কোনও সম্ভ্রান্ত জমিদারের আয়োজনে দু ‘জন কবিয়াল মুখোমুখি হয়েছেন অগনিত মানুষের মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে। সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে তারা পরষ্পর কোনও বিষয় নিয়ে তর্কযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন। কোনও ধরনের পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই যে কোনও বিষয় নিয়ে তাৎক্ষণিক গীত রচনা করে তাল, লয়, সুরের সঠিক সংমিশ্রণে ঐ সুনির্দিষ্ট প্রশ্নটির মোক্ষম উত্তর না দিতে পারলেই পরাজয়! এবং, বিষয়বস্তুও সচরাচর সহজ ছিল না। অথচ,বাংলার মাঠ-ঘাট থেকে উঠে আসা এই তাথাকথিত প্রাতিষ্ঠানিকশিক্ষাহীন মানুষগুলো দীর্ঘ সময় ধরে অবলীলায় এই অসাধ্য সাধন করে গেছেন! কত ধরনের বিষয়ের উপর সম্যক জ্ঞান থাকলে এবং প্রতিভার কোন স্তরে অবস্থান করলে একজন মানুষ এভাবে তার মস্তিষ্কের সর্বোচ্চ ব্যবহার করার ক্ষমতা প্রাপ্ত হন? আশ্চর্যের বিষয় হল, এমন মানুষের সংখ্যাও নিতান্তই কম ছিলনা সেই সময়।
দর্শন,ধর্মতত্ব,রাজনীতি,ইতিহাস,দেহতত্ব, বিবিধ শাস্ত্র, ভাষার বিভিন্নতা, আধ্যাত্বিকতা ইত্যাদি বহুল বিষয়বস্তুর সার্বিক তথ্য সম্পর্কে বিশদভাবে অবগত না থাকলে একজন সফল কবিয়াল হতে পারতনা কেউ। এই সাধনা যে কোনও সাধারন মানুষের স্বাভাবিক ক্ষমতার অনেক উর্দ্ধে,তা বলাই বাহুল্য।

আমার আলোচনা ও গবেষণায় যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে তা হলো, একজন বাঙালী কবিয়াল বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খুব স্বল্প শিক্ষিত অন্তত প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে। কিন্তু, তারা অনেক বেশি সুশিক্ষিত তাদের স্বশিক্ষার মহিমায় । খুব গভীরভাবে আমাকে এ বিষয়টি ভাবিয়েছে যে, কত শতমুখি বিদ্যা তাদেরকে রপ্ত করতে হয়েছে! আর তার চেয়েও বেশি অনুধাবন করার চেষ্টা করেছি কতবেশি সক্রিয় ও উন্নত মেধার পরিচায়ক তাঁরা, যখন কিনা তাদেরকে দেখি প্রতিপক্ষের একটি প্রশ্ন গ্রহণ করার সাথে সাথে সেটি বুঝতে সক্ষম হওয়া অতপর শত বিদ্যার শতমুখী জ্ঞানের যে শাখা থেকে উত্তরটি খুঁজে পাওয়া সম্ভব যথাযথভাবে সেই শাখায় সংকেত পৌঁছে দেয়া, সেখান থেকে স্পষ্ট অস্পষ্ট কিছু একটি উত্তরের আভাস মেলা, আরো পরিষ্কার করে উত্তর তৈরি করবার জন্য একটি অনন্য চিত্র মনে ধারণ করা, সেখানে বাছাইকৃত সুষম পদ রচনা করে ছড়ামালা বা বাক্য গঠন করা, সুরারোপ করা, তাল-লয়-ছন্দে পরিবেশন যোগ্য করে গড়ে তোলা, দোহাররা যথারীতি সাহায্য করতে পারবে তেমনটি ভাবা এবং পরিবেশনের মধ্য দিয়ে অপর কবিকে বোধগম্য করা, সেই সাথে উপস্থিত সুধীগনকে রূপ, রস, গন্ধের সমন্বয়ে উপভোগ্য করে তোলা এবং প্রাসংগিক লড়াইয়ের জন্য নতুন করে প্রশ্ন ছুড়া এই সামগ্রিক বিষয় টি সময়ের এত ক্ষুদ্র অংশে এতটা পরিপূর্ণরূপে প্রকাশ সত্যিই পৃথিবীতে বিরল। দিব্য চোখে দেখলে মনে হবে যেন যুগ যুগ ধরে মুখস্ত কোন বিদ্যায় সুরের মাধ্যমে উত্তর দিয়ে যাচ্ছে মাত্র। আসলে বিষয়টি তা নয় বলেই কিন্তু পর্তুগিজ এন্টনি ফিরিঙ্গি তার যথার্থ দর্শন উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এবং একজন কবিয়াল হিসাবে বাঙালিয়ানার বাইরে অনন্য অসাধারণ উচ্চতায় স্থান করে নিয়েছেন বাংলার কবিগানে।

তথাকথিত শহরের সাহিত্যের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হতে হতে গ্রাম বাংলার চিরায়ত উন্নত সাহিত্য নক্ষত্রগুলো বাঙালির হৃদয় ও মনন থেকে নিভে গিয়ে বাঙালির চিন্তাজগতে যে অন্ধকার অমানিশা নেমে এসেছে, তারই ফলশ্রুতিতে আজকের মানুষ যত অনিয়ম, অনাচার, ঠকবাজি, প্রতারণা, জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ এমনই সব ঋণাত্মকতায় নিমজ্জিত হয়েছে। তাই চারপাশে হতাশা, অস্থিরতা, অনিরাপত্তা আমাদেরকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে।

অথচ, বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠতম এই নিদর্শন শুধুমাত্র সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা এবং সংরক্ষণের অভাবে আজ বিলুপ্তপ্রায়। স্বাধীন বাংলাদেশে কতিপয় কিছু গুনী মানুষ যেমন, অহীগুরু মাতাল রাজ্জাক, শাহ্ আলম সরকার, বিজয় সরকার, শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব, শেফালী ঘোষ, মনসুর বয়াতী,কুদ্দুস বয়াতী,সঙ্গীতশিল্পী- বরেণ্য সাংসদ মমতাজ ইত্যাদি প্রমুখগন এই অত্যন্ত উচ্চমার্গীয় চর্চা কিছুটা প্রচলিত রেখেছিলেন। হয়তো কালের পরিবর্তনে এই প্রবাহ অচিরেই বিলুপ্ত হবে বাংলা সংস্কৃতি থেকে হায়!

লেখক – পুলিশ সুপার, গীতিকবি ও কন্ঠ শিল্পী।

Loading