রোহিঙ্গারাই রোহিঙ্গাদের হত্যা করছে কেন?

প্রকাশিত: ১১:০৩ পূর্বাহ্ণ , অক্টোবর ৮, ২০২০

কক্সবাজারের কুতুপালং ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে এক সপ্তাহে অন্তত আট জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে৷ যৌথ অভিযান চালিয়েও সংঘর্ষ থামানো যাচ্ছে না৷ সাধারণ রোহিঙ্গা শরণার্থী ও বাংলাদেশি নাগরিকরা রয়েছেন আতঙ্কে৷স্থানীয় সূত্র জানায়, মাদকসহ নানা ধরনের অবৈধ ব্যবসার আধিপত্যকে কেন্দ্র করেই এই সংঘাত৷ এই গ্রুপগুলোর সঙ্গে স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ীদের যোগাযোগ থাকার দাবি করেছেন কেউ কেউ৷ এর পিছনে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ইন্ধন আছে এবং রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর অস্ত্রের প্রধান উৎস মিয়ানমার-এমন দাবিও করেছে একাধিক সূত্র৷

উখিয়ার কুপালং ক্যাম্প সবচেয়ে বড় রোহিঙ্গা ক্যাম্প৷ কুতুপালং ও টেকনাফের নয়াপাড়া- এই দুটি ক্যাম্প রেজিষ্টার্ড হলেও মোট ক্যাম্প ৩৪টি৷

চট্টগ্রাম রেঞ্জ পুলিশের ডিআইজি মো. আনোয়ার হোসেন বুধবার কুতুপালং থেকে বলেন, ‘‘এই সপ্তাহে মোট আট জন নিহত হয়েছেন৷ নিহতদের লাশ স্থানীয় হাসপাতাল মর্গে আছে৷ ক্যাম্প এলাকায় যৌথ বাহিনী অভিযান চালাচ্ছে৷ এখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে৷ ক্যাম্পে গোলাগুলি বন্ধ হলেও পরিস্থিতি থমথমে৷’’

তিনি জানান, ‘‘এই ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের মুন্না ও সাদেক গ্রুপ নামে সন্ত্রাসীদের দুইটি বাহিনী আছে৷ তবে এখানে বিষয়টি হলো, মুন্না এবং অ্যান্টি মুন্না৷ তাদের মধ্যেই সংঘর্ষ চলছে৷ সংঘর্ষের মূল কারণ ক্যাম্পের আধিপত্য৷ ক্যাম্পের আধিপত্য যাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে, তারাই অবৈধ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে৷’’

তবে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ক্যাম্পে দ্বন্দ্বের নানামুখী কারণ আছে৷ রেজিষ্টার্ড এবং নন-রেজিষ্টার্ড রোহিঙ্গাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব অনেক পুরনো৷ এছাড়া আরসারও প্রভাব আছে৷ আর মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর পক্ষে কাজ করে এমন কয়েকটি গ্রুপও রয়েছে৷ তারা এখান থেকে তথ্য সরবরাহ করে৷ তারাও সশস্ত্র৷ জানা গেছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পভিত্তিক মাদক ব্যবসা অর্থের একটি বড় উৎস৷ মিয়ানমার থেকে আসা ইয়াবা ক্যাম্পে মজুত করে এখান থেকেই বন্টন করা হয়৷ এছাড়া ক্যাম্প এলাকা এবং আশপাশে অনেক দোকানপাট থেকে চাঁদা আদায় হয়৷ আর রোহিঙ্গাদের পাওয়া উদ্বৃত্ত ত্রাণ সামগ্রীর বড় একটি মার্কেট আছে৷ ক্যাম্পের ভেতরে ৬-৭টি বাজার আছে৷ সেখান থেকেও অনেক অর্থ আদায় হয়৷

মুন্না অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা আর সাদেক নিবন্ধিত রোহিঙ্গা৷ সাদেকের সাথে আরসার যোগাযোগের অভিযোগ আছে৷ উখিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, ‘‘এখন অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা অনেক বেশি৷ নিবন্ধিতরা আগে এসেছে এবং তারা সংখ্যায় কম৷ ফলে আধিপত্যের দ্বন্দ্ব তীব্র হচ্ছে৷ আর এই আধিপত্য প্রয়োজন নানা উপায়ে অর্থ আয়ের জন্য৷’’ তার মতে, ‘‘গত চার বছরে যেসব রোহিঙ্গা এসেছে, তাদের মধ্যে ইয়াবা ব্যবসায়ীও আছে৷ তারা ইয়াবা তৈরি করতে পারে৷ ক্যাম্পের ভেতরে তারা এ ধরনের কারখানা তৈরি করেছে বলে আমরা ধারণা করি৷ আবার কিছু রোহিঙ্গা আছে, যারা ক্যাম্পে থাকলেও নিয়মিত মিয়ানমারে আসা-যাওয়া করে৷ তারা অস্ত্র এবং ইয়াবা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত৷ গত একমাসে রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে ২০ লাখ ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে৷’’

গত ২ অক্টোবর কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পাশে পালংখালিতে একটি অস্ত্র তৈরির কারখানার সন্ধান পায় র‌্যাব৷ সেখান থেকে দুটি আগ্নেয়াস্ত্র, দুই রাউন্ডগুলি এবং অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়৷ এসব মজিদ ও রবি নামের দুই ব্যক্তিকে আটকও করা হয়৷ তাদের বাড়ি মহেষখালী এবং তারা অস্ত্র তৈরির কারিগর৷ র‌্যাব জানিয়েছে, ‘‘তারা অস্ত্র তৈরি করে রোহিঙ্গাদের কাছে বিক্রি করে আসছিলো৷’’কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবুল মোরশেদ খোকা দাবি করেন, ‘‘মিয়ানমার থেকেও মাদকের সাথে অস্ত্র আসে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে৷ আমাদের কাছে তথ্য আছে এই সময়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর চররাও সক্রিয় আছে৷ তারা অস্ত্র দিচ্ছে৷ তারা চায় এখানকার পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে৷ এখানে আরসাসহ আরো কিছু গ্রুপও সক্রিয় আছে৷ সব মিলিয়ে এক জটিল পরিস্থিতি৷’’

তবে ডিআআইজি আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘‘মিয়ানমার থেকে অস্ত্র আসে কিনা আমাদের জানা নেই৷ তবে সংঘর্ষে যারা লিপ্ত, তারা তো সশস্ত্র৷ তাছাড়া ক্যাম্পের মধ্যে মাদকের কারখানা আছে৷ ক্যাম্পে অনেক ঘটনা ঘটে যা জানা যায় না৷ সন্ত্রাসীদের কারণে তারা জানাতে সাহসও পায় না৷’’

হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, ‘‘রোহিঙ্গা ক্যাস্প একটি সোনার ডিম পাড়া হাঁস৷ আর তার নিয়ন্ত্রণ নিয়েই এই সংঘর্ষ৷ এর সঙ্গে জড়িত আছে এ দেশীয় স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ী, চোরাকারবারি ও অস্ত্র ব্যবসায়ীরা৷’’

শুধু কুতুপালং কাম্পেই পাঁচ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা রয়েছে৷ সবচেয়ে বড় ক্যাম্প হওয়ায় সেখানকার কোনো ঘটনা অন্য ক্যাম্পেও প্রভাব ফেলে৷ সার্বিক পরিস্থিতি জানতে কুতুপালং ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের মুখপাত্র ইউনূস আরমানকে বার বর ফোন করলেও তিনি ফোন ধরেননি৷ DW

Loading