‘শুয়া চান পাখি’ গান নিয়ে যতো বির্তক, অধ্যক্ষ মোঃ গোলাম মোস্তফা

প্রকাশিত: ১০:৫৪ অপরাহ্ণ , অক্টোবর ২৪, ২০২৩

প্রসঙ্গঃ ‘শুয়া চান পাখি’ গান নিয়ে যতো বির্তক
গত ২৪ নভেম্বর ২০১৭খ্র্রি: বাংলাদেশের বাউল গানের জগতে একটি নক্ষত্র ঝড়ে যায়। তিনি হলেন, আমাদের সবার প্রিয় শিল্পী বারী সিদ্দিকী (১৯৫৪-২০১৭)। তাঁর গ্রামের বাড়ি নেত্রকোণা সদর উপজেলার কারলি গ্রামে। গ্রামের বাড়িটির নামকরণ করেছেন ‘বাউল বাড়ি’।
প্রথম জীবনে বারী সিদ্দিকী’র পরিচয় ছিল- তিনি একজন নামকরা বংশীবাদক। অন্যদিকে বাউল কবি রশিদ উদ্দীন (১৮৮৯-১৯৬৪) নেত্রকোণা পৌর এলাকার বাহিরচাপড়া গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন।

বাউল কবি রশিদ উদ্দীনের বিখ্যাত দু’টি গান হুমায়ূন আহমেদের পরিচালনায় ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রে কষ্ঠ দেওয়ার পর বারী সিদ্দিকীকে আমরা নতুন করে পাই লোক গানের কন্ঠ শিল্পী হিসেবে। রশিদ উদ্দিন নেত্রকোণা সমকালীন বাউলদের ঘরানা ওস্তাদ এবং তাঁর বাড়িটি ছিল অত্র এলাকার ‘বাউল সাধনার পাঠশালা’। এই পাঠশালার ছাত্র ছিলেন জালাল খাঁ, মজিদ তালুকদার, তৈযব আলী, উকিল মুন্সী, ইদ্রিস, কমল মিয়া, মিরাজ আলী প্রমূখ এবং নেত্রকোণার বাহিরে সিলেটের শাহ আব্দুল করিমসহ অনেকে।
তখনকার সময় স্ব-শিক্ষিত এই সকল লোকগানের গীতিকারদের রচিত গানগুলো লিখে রাখার পথে ছিল নানান বাধা ও সমস্যা। গান রচনার পর শীষ্যদের সামনে পরিবেশন করতেন; শিষ্যরাই মুখস্থ করতো, মুখে মুখে প্রচার হতো। আবার কিছু গান গীতিকার লিখে রাখতে পারতেন বা আর্থিক সঙ্গতি থাকলে বই আকারে প্রকাশ করতেন। এই সকল সমস্যার জন্য পরবর্তী সময় অনেক গান যেমন অংশবিশেষ পরিবর্তন হয়েছে, তেমনি একজনের গান অন্যজনের নামে চলে গেছে এবং গানগুলো নিয়ে নানান বির্তক জন্ম দিয়েছে (যা অন্য একটি প্রবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।) এই ধরানের অনেকগুলো গানের বির্তকের মাঝে একটি বাউল কবি রশিদ উদ্দীনের ‘শুয়া চান পাখি’ গানটি।

আমরা জানি, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রে হুমায়ুন আহাম্মেদ তাঁর নিজের লেখা ৪টি গানসহ মোট ৯টা গান ব্যবহার করেন, এতে বারী সিদ্দিকী সাহেব কন্ঠদেন একাই ৬টি গানে। গানগুলো হলো গীতিকার বাউল উকিল মুন্সী’র- ‘আমার গায়ে যতো দুঃখ সয়’, ‘পূবালী বাতাসে’, ‘কেহ গরিব অর্থের জন্যে’ এবং গীতিকার বাউল কবি রশিদ উদ্দীনে’র ‘মানুষ ধরো মানুষ ভজ’ এবং ‘শুয়া চান পাখি আমি ডাকিতাছি, তুমি ঘুমাইছ নাকি’। রশিদ উদ্দিনের পান্ডুলিপিতে তাঁর হাতে লেখা এটি ‘৬৬ নং’ গান। কিন্তু এই গানটি হুমায়ূন আহমেদ “শ্রাবণ মেঘের দিন” চলচ্চিত্রে গীতিকার হিসেবে কবি পরিচিতিতে রশিদ উদ্দিনের নাম ব্যবহার না করে বাউল উকিল মুন্সি সাহেবের নাম ব্যবহার করেছেন- যা আদৌ সত্য নয়। তখন থেকে এই গানটির প্রকৃত গীতিকারের নাম নিয়ে নেত্রকোণার সাধারণ মানুষ ও লোকগবেষকদের মাঝে বির্তকটি প্রবল হয়।

বাউল কবি রশিদ উদ্দিন আজ থেকে প্রায় ৮০ বছর আগে এক বিশেষ ধরনের কালি ও কলম ব্যবহার করে পান্ডুলিপিতে নিজ হাতে ‘ শুয়া চান পাখি’ গানটি লিখে যান। গানটি মূল পান্ডুলিপি থেকে স্কেন করে দেয়া হলো

প্রায় ৮০ বছর আগে এক বিশেষ ধরনের কালি ও কলম ব্যবহার করে পান্ডুলিপিতে বাউল কবি রশিদ উদ্দিন এর নিজ হাতে লেখা ‘ শুয়া চান পাখি’ গান

-এই ধরনের লিখিত একটি দলিল থাকার পরও সম্ভবতঃ এই ভুলটি হয়েছিল হুমায়ূন আহমেদ যার মাধ্যমে গানটি সংগ্রহ করে চলচ্চিত্রে ব্যবহার ছিলেন তার তথ্য প্রদানে ভুলের জন্য।
নেত্রকোণার লোকগানের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘শিকড় উন্নয়ন সমিতি’র’ সভাপতি আ.ফ.ম. রফিকুল ইসলাম আপেলে সাহেবের সাথে এবিষয়ে আমার কথা হয়। তিনি বলেন,‘একদিন আমার বন্ধু বারী সিদ্দিকী আমার শিকড় উন্নয়ন সমিতিতে আসেন। তিনি নেত্রকোণার বাউলদের কিছু গান সংগ্রহের আগ্রহ প্রকাশ করেন। আমি বাউল কবি রশিদ উদ্দীন, বাউল সাধক জালাল খাঁ, বিরহী বাউল উকিল মুন্সী, দীন শরৎ, আবেদ আলী, মিরাজ আলী প্রমূখ বিখ্যাত বাউল গীতিকারদের কিছু গান বন্ধু বারীকে দেই। এই সময় নেত্রকোণার বিখ্যাত বাউলদের ১০টি গানের ক্যাসেট বারীর হাতে তুলে দেই। এই সকল কেসেটের গানগুলোতে কন্ঠ দিয়েছিলেন বাউল শিল্পী হেকিম, বাউল ফিরোজ, বাউল মিয়া হোসেন প্রমূখ। এইসময় ‘শুয়া চান পাখি’ গানটি গীতিকার রশিদ উদ্দীনের নাম উল্লেখ করেই তাকে আমি তথ্য দেই। আমি গানটি বাউল রশিদ উদ্দীনের ছোট ছেলে আবু আনসার মোঃ কালা মিয়ার কাছে সংরক্ষিত রশিদ উদ্দীনের হাতে লেখা অতিপুরোনো মূল পান্ডুলিপি থেকে সংগ্রহ করি। এই গানটি পরে অনেকের হাতবদল হয়ে ‘শ্রবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রে প্রকাশ পায়।

’’ গত ফেব্রুয়ারি ২০১৩ খ্রিঃ মাহবুব কবির সম্পাদিত ‘উকিল মুন্সির গান’ গবেষণাধর্মী গ্রন্থে তিনি বিষয়টি স্বীকার করেছেন। জনাব মাহবুব কবির বলেন, “এখানে উল্লেখ্য, হুমায়ূন আহমেদের ওই চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত “শুয়া চান পাখি/ আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি” গানটি উকিল মুন্সির বলে পরিচিতি পায়। গানে কবি পরিচিতির ভণিতায় উকিলের নাম। তবু এ গানটি রশিদ উদ্দিনের নাকি উকিল মুন্সির তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক রয়েছে। কিন্তু আমি যা দেখেছি ও জেনেছি তা হলো, রশিদ উদ্দিনের নাতির কাছে সংরক্ষিত তার প্রায় আড়াইশ গানের মধ্যে এই গানটি রয়েছে। রশিদ উদ্দিনের গানের এ পান্ডুলিপিটি অতি পুরানো। অন্যদিকে বিভিন্ন জনের সংগ্রহ করা উকিল মুন্সির গানের পুরনো যে চারটি ডায়েরি আমার হস্তগত হয়েছে, সেসব ডায়েরির একটাতেও ওই গানটি নেই। এই চারটি ডায়েরির একটি গত শতাব্দীর পঞ্চাশ দশক সময়কালের। ’’শুয়া চান পাখি’ গানটির কথাগুলো “শ্রাবণ মেঘের দিন’’ চলচ্চিত্রে যখন ব্যবহার করা হয় তখন নিচের কথাগুলোতে কন্ঠ দেয়া হয়-

‘‘শুয়া চান পাখি,
আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি?
তুমি আমি জনম ভরা ছিলাম মাখামাখি,
আইজ কেন তুই হইলে নিরব মেল দুইটি আঁখি/
বুলবুলি আর তোতা ময়না,কত নাম তর রাখি
শিকল কেটে চলে গেলে কারে লইয়া থাকি\
তোমার আমার মধুর পিরিত,চন্দ্র সূর্য সাক্ষী,
হঠাৎ কেন ভেঙ্গে দিলে বুঝলামনা চালাকি//

এখানে উল্লেখ্য যে, যেকোনো বাউল গানের শেষের দিকে গীতিকারের নাম থাকে, কিন্তু উক্ত গানে কোনো গীকিতারের নাম ব্যবহার করা হয়নি। কিন্তু গানটি যখন দর্শক-শ্রোতার বিচারে জনপ্রিয়তার আকাশ চুঁয়া হয়ে যায়, তখন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এবং প্রচার মাধ্যমে গানের কন্ঠশিল্পী বারী সিদ্দিকী মাধ্যমে গানটির গীতিকার হিসেবে নেত্রকোণার আর এক কিংবদন্তি বাউল শিল্পী উকিল মুন্সি সাহেবের নাম সাধারণ মানুষের কাছে প্রকাশ পায়। ফলে তখনই নেত্রকোণা অঞ্চলের বাউল শিল্পীসহ লোকগবেষক মহলে প্রবল আপত্তি উঠে। কারণ গানটি চলচ্চিত্রে ব্যবহার করার আগেই লোকগবেষক ও বীরমুক্তিযুদ্ধ গোলাম এরশাদুর রহমান ১৯৯৩ খ্রি. নেত্রকোণার পৌষমেলায় দেশ-বিদেশী লোকগবেষকদের উপস্থিতিতে হাজার হাজর স্থানীয় নেত্রকোণাবাসীর উপস্থিতিতে “বঙ্গীয় লোক সংস্কৃতির অঙ্গনে নেত্রকোণার বাউল সাধক রশিদ উদ্দিন”, শীরোনাম প্রবন্ধে (নেত্রকোণার পৌষমেলা ও সাংস্কৃতি পক্ষ ১৪০০ স্বরনিকা) গানটি রশিদ উদ্দিনের বলে আলোচনায় আনেন এবং লিখিত আকারে প্রকাশ হয়। ফলে তিনিসহ নেত্রকোণা এলাকার বাউল শিল্পীগণ দাবি করেন “শুয়া চান পাখি” গানটির গীতিকার রশিদ উদ্দিন; উকিল মুন্সী নন- এই দারীটি প্রবল হয়। কিন্তু গণ-মাধ্যগুলোতে ভুলভাবে উকিল মুন্সির নাম প্রচার হতে থাকে। ফলে ভুল তথ্যটি দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পরে। কিন্তু বাউল শিল্পী বারী সিদ্দিকীর জীবদ্বশায় গত নভেম্বর ২০১৩খ্রি: মো: গোলাম মোস্তফা সংগ্রহ ও সম্পাদিত “রশিদ গীতিকা” গ্রন্থে গানটি ইতিহাসসহ পান্ডুলিপির অংশ বিশেষ স্কেন করে বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়।

‘রশিদগীতিকা’ প্রকাশিত হওয়ার পর শিল্পী বারী সিদ্দিকী এই গ্রন্থের একটি কপি রশিদ উদ্দিনের বড় মেয়ের দিকে নাতি আবুল কাশেমের মাধ্যমে সংগ্রহ করেন এবং তাতে বাউল কবি রশিদ উদ্দিনের হাতের লেখা প্রায় অতিপুরোনো পান্ডুলিপিতে ‘শুনা চান পাখি’ গানটি লেখা দেখে এই অনাকাক্ষিত ভুলটি উদার মন নিয়ে স্বীকার করে নেন এবং বলেন, ‘গানের শেষের দু’টি লইন বাদ পড়েছে।

তখন থেকে যে কোনো গানের অনুষ্ঠানে বারী সিদ্দিকী পূর্নাঙ্গ গানটি পরিবেশন করতে শুরু করেন। তবে নতুন করে আরেকটি ভুল তথ্য যোগ করতে থাকেন। শিল্পী বারী সিদ্দিকী তখন গান গাওয়ার সময় গানের শেষের অংশে রশিদ উদ্দিনকে গানের গীতিকার হিসেবে স্বীকার করে নিলেও আগের ভুলটি ঢাকতে গিয়ে এক অভিনব পন্থায় বাউল উকিল মুন্সির (১৮৮৫-১৯৭৮) নামও সংযুক্ত করে দেন , যার ফলে আবারও নতুন বির্তক তৈরি হয়। তখন বারী সিদ্দিকী গাইতেন-“বিশ্বজোড়া এই পিরিতি , সবই দেখছি ফাঁকি, বাউল কবি রশিদ বলে, ওরে উকিল ডাকলেই বা আর হবে কি।”

পাঠকের জ্ঞাতার্থে রশিদ উদ্দিনের হাতের পান্ডুলিপি থেকে গানটির কোনো অংশ পরিবর্তন ছাড়াই হুবুহু তুলে ধরলাম-

‘‘ও আমার সোয়া চান পাখি,
আমি ডাকিতাছি ঘুমাইছ নাকি?
তুমি আমি জনম ভরা ছিলাম মাখামাখি,
আইজ কেন তুই হইলে নিরব মেল দুইটি আঁখি
বুলবুলি আর তোতা ময়না কত নাম তর রাখি,
শিকল কেটে চলে গেলে, কারে লইয়া থাকি\
তোমার আমার মধুর পিরীত, চন্দ্র সূর্য সাক্ষী,
অকস্মাৎ কেন ভেঙ্গে দিলে বুঝলামনা চালাকী\
বিশ্বজোড়া এই পীরিতি সবই দেখছি ফাঁকি,
বাউল কবি রশিদ বলে, ডাকলেই বা আর হবে কি?

”অর্থাৎ, শিল্পী বারী সিদ্দিকী যখন ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রে গানটি প্রথম পরিবেশন করেন তখন গানের শেষাংশে নামের ভনিতাসহ দু’টি লাইন পরিবেশন করেননি। ফলে বোঝা যায়নি এই গানটির প্রকৃত গীতিকার কে। পরবর্তী সময়ে এই নিয়ে যখন লোকগবেষকদের মাঝে বিতর্ক প্রবল হয় এবং সাধারণ মানুষের মাঝে নানান প্রশ্ন তৈরি হয়- তখন বারী সিদ্দিকী তার জবাব দিতে গিয়ে গণ-মাধ্যমে একটি গল্প জুরে দেন। ২০১৭ খ্রি. চ্যানেল আই-এর ‘আমার যতো গান’ অনুষ্ঠানে বলেন,‘‘ শ্রবণ মেঘের দিন চলচ্চিত্রে গানটি ব্যবহার করা হয়। এই গানটি নিয়ে নানান গবেষণা হচ্ছে। নানান মতামত আছে। আমি যখন গানটি নিয়ে হুমায়ুন আহমেদ স্যারের কাছে যাই, গানটি গেয়ে শোনাই তখন তিনি বলেন, গানটি আমার দরকার। গানের মূল কথা হলো “শুয়া চান পাখি’’ অর্থাৎ, শুয়ে আছে আমার চান পাখিটা। বাউল উকিল মুন্সী তার মৃত স্ত্রী’র মাথাটি কোলে নিয়ে কবরের পাশে বসে গানটি লিখেন। আমি জানিনা গানটি কার। আমার তখন জন্মই হয় নাই।’’ তারপর তিনি গানটি পরিবেশ করেন এভাবে-‘‘বাউল কবি রশিদ বলে, চলে উকিল ডাকলেই বা আর হবে কী?’’

দুঃখের বিষয় ২০১৭ খ্রি. চ্যানেল আই-এর “আমার যতো গান’’ এই অনুষ্ঠানটি প্রচার হওয়ার মাত্র কিছু দিন পর অর্থাৎ ২৪ নভেম্বর ২০১৭ খ্রি. রাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে স্কয়ার হাসপাতালে এই কিংবদন্তি শিল্পী বারি সিদ্দিকী আমাদের ছেড়ে পরপারে চলে যান।

আমরা জানি রশিদ উদ্দিন সাহেবের জন্ম ১৮৮৯ খ্রি. ২১ জানুয়ারি এবং ১৯৬৪ খ্রি. ১০ সেপ্টেম্বর পরলোক গমন করেন। অন্যদিকে বাউল উকিল মুন্সি সাহেবের জন্ম নেত্রত্রোণা জেলার খালিয়াজুড়ির নূরপুরের বোয়ালী গ্রামে ১৮৮৫ খ্রি । ১১ জুন জন্ম গ্রহণ করেন এবং ১৯৭৮খ্রি. ১২ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। একই বছর অর্থাৎ ১৯৭৮খ্রি. কয়েক মাসের ব্যবধানে উকিল মুন্সী সাহেবের প্রথমে স্ত্রী পরে তাঁর পুত্র বাউল আবদুস সাত্তার মৃত্যুবরণ করেন। কাজেই প্রশ্ন হলো উকিল মুন্সী সাহেব এবং তাঁর স্ত্রী-পুত্র মৃত্যুর ১৪ বছর আগেই রশিদ উদ্দিন সাহেব মৃত্যু বরণ করেন, তিনি কীভাবে কবর থেকে উঠে এসে উকিল মুন্সি সাহেবের শোকে শোকাহত হলেন? তাকে শান্তুনা দিলেন? কাজেই এ ধরনের মনগড়া গল্প-আমাদের এই দুই কিংবদন্তি শিল্পীকে ছোট করে। তাঁদের নিয়ে এধরনের মনগড়া কথা না বলাই ভালো। কারণ তাদের নিয়ে অনেক গবেষণা হবে এবং হচ্ছে। আবার অনেকেই মনে করে থাকেন এই “শুয়া চান পাখি গানটি” রশিদ উদ্দিন রচনা করেছেন তার প্রথম স্ত্রী দৌলতেন্নেছার মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে। রশিদ উদ্দিন সাহেবের দুই স্ত্রী দৌলতেরনেচ্ছা ও আমিরজান। দ্বিতীয় স্ত্রী আমিরজানের সাথে রশিদ উদ্দিনের বিবাহ হয় ১৯৩৭ খ্রি.। ‘রশিদ গীতিকা’ গ্রন্থটি লেখার সময় উনার সাথে আমার অনেকবার কথা হয়। পারিবারিক তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায়, রশিদ উদ্দিনের প্রথম স্ত্রী দৌলতেন্নেছা মারা যান ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে রশিদ উদ্দিনের মৃত্যুর পর পরেই এবং দ্বিতীয় স্ত্রী আমিরজান মারা যান ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে প্রায় শত বছরের উপরে বয়সে।

দ্বিতীয় স্ত্রী আমিরজানের সাথে আমার যখন কথা হয় তখন তিনি বলেন, ‘‘রশিদ উদ্দিন এই ‘শুয়া চান পাখি’ গানটি রচনা করেন তাঁর প্রথম স্ত্রীর দ্বিতীয় সন্তান বোরহান উদ্দিনের মৃত্যুর পর। বাংলা ১৩৪৪ সনের ২২শে চৈত্র রোজ সোমবার প্রথম স্ত্রীর দ্বিতীয় ছেলে আদরের বোরহান উদ্দিন মৃত্যুবরণ করে। এতে রশিদ উদ্দিন খুবই মর্মাহত হন। ছেলেটি সবসময় অসুন্থ থাকত।” রশিদ উদ্দিনের দ্বিতীয় স্ত্রী আমিরজানের মতে,“এই সময় বাউল রশিদ উদ্দিন তার বিখ্যাত গান “ও আমার শুয়া চান পাখী, আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি” গানটি রচনা করেন। তিনি বলেন,“ছেলের মৃত্যুর সময় গান পাগল রশিদ উদ্দিন ময়মনসিংহের গৌরীপুরের জমিদার বাড়িতে বাউল গানের আসরে ছিলেন। সেখানে বসেই তিনি তাঁর প্রিয় সন্তানের মৃত্যুর সংবাদ পান। তখন তিনি উক্ত গানটি রচনা করেন এবং ছেলের মৃত্যুর পর প্রায়ই তিনি একা একা বসে এই গানটি গাইতেন।

” রশিদ উদ্দিনের পান্ডুলিপি ছাড়াও পারিবারিক ডায়েরীতে গানটি ও ছেলের মৃত্যুর তারিখসহ বিস্তারিত লেখা রয়েছে। কাজেই এ বিষয়ে বিতর্ক তৈরি করা অনর্থক। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে হুমায়ূন আহমেদ “শ্রাবণ মেঘের দিন” চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত মোট ৯টি গানের মাঝে বারী সিদ্দিকী একা ৬টি গানে কন্ঠ দেন। এর মাঝে বাউল কবি রশিদ উদ্দিনের লেখা দু’টি এবং বাউল উকিল মুন্সী সাহেবের ৩টি । রশিদ উদ্দিনের বিখ্যাত দ্বিতীয় গানটি হলো-
‘‘মানুষ ধর মানুষ ভজ শোন বলিরে পাগল মন।
মানুষের ভিতরে মানুষ করিতাছে বিরাজন\’’

এই গানগুলোতে দরদি কন্ঠ এবং দরাজগলায় সুর দিয়ে বংশীবাদ বারী সিদ্দিকী নতুন করে বিখ্যাত হয়ে উঠেন মানুষের ‘প্রিয় লোকশিল্পী বারী সিদ্দিকী’ হিসেবে। সেই সাথে মানুষ নতুন করে পরিচয় খুঁজতে থাকে গীতিকার বাউল কবি রশিদ উদ্দিন, বাউল উকিল মুন্সী ও শিল্পী বারী সিদ্দিককে। এই তিনজনের বাড়িই আমাদের নেত্রকোণায়।
বাউল কবি রশিদ উদ্দিন ‘‘মানুষ ধরো মানুষ ভজ’’ এই গানের জন্য ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক “শ্রেষ্ঠ গীতিকার” মরণোত্তর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার লাভ করেন এবং উক্ত পুরস্কারটি ঘোষণা করা হয় ১০ সেপ্টেম্বর ২০০৩খ্রি.। কিন্তু কর্তৃপক্ষের গীতিকারের ঠিকানা খুঁজে পেতে সমস্যা হয়। পুরস্কার গ্রহণের খবর রশিদ উদ্দিনের পরিবার প্রথমে জানতে পারেনি। অথচ ষাটের দশকে আব্দুল আলিমের কন্ঠেও রশিদ উদ্দিনের বিখ্যাত গান ‘‘এই যে দুনিয়া কিসেরও লাগিয়া’’ গ্রামোফোন রের্কডে মানুষ শোনেনি এমন বাংলাভাষাভাষি লোকের সংখ্যা কম আছে। গানটি আব্দুল আলীম ছাড়াও গেয়েছেন কিংবদন্তি শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন, ওয়াহিদ মাহমুদসহ অনেকে। এই গান বাংলা ১৩৬২ খ্রি. মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকার আশ্বিন সাসের সংখ্যায় ছাপা হয় এবং এখনো মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত রশিদ উদ্দিনের সেই গান। তবে আব্দুল আলীম ‘এই যে দুনিয়া’সহ রশিদ উদ্দিনের চারটি গান গ্রামোফেন রেকর্ডে রেকর্ড করেন। কিন্তু একটি গানেও গীতিকার বাউল কবি রশিদ উদ্দিনের নাম ব্যবহার করেনি । গানগুলো সংগ্রহিত বলে চালিয়ে দিয়েছেন। ফলে আমাদের এই ধরনের অকৃজ্ঞতার জন্য নতুন প্রজন্মের কাছে রশিদ উদ্দিন অনেকটা হারিয়ে গিয়েছিলেন। রশিদ উদ্দিনের বাড়ির ঠিকানা না পেয়ে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারটি জাতীয় যাদুঘরের সংরক্ষিত রাখার কথা ভাবছিল কর্তৃপক্ষ। এই সময় নেত্রকোণা তৎকালীন জেলা প্রশাসক জনাব মোঃ আলী আকবর হোসেন আকন্দ বিষয়টির খবর পান। তিনি নেত্রকোণার সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘শিকড় উন্নয়ন সমিতি’র সাথে যোগাযোগ করেন। তিনি ও আরো কিছু স্থানীয় লোকদের সহযোগিতায় পুরস্কারটি রশিদ উদ্দিনের পরিবারের লোকদের কাছ পৌঁছায় ২০০৪ খ্রি.। কাজেই ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রে রশিদ উদ্দিনের গান স্থান পাওয়া, বারী সিদ্দিকী কন্ঠে সে গানের প্রাণ ফিরে পাওয়া, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া এবং ২০১৩ খ্রি. প্রথম ‘রশিদ গীতিকা’ প্রকাশের পর আবার রশিদ উদ্দিন তাঁর হারানো গৌরব ফিরে আসার একটি বাঁক কিছুটা অতিক্রম করল মাত্র। কিন্তু ১৯২৯ খ্রি. রমা প্রেস তাঁর জীবদ্ধশায় প্রকাশিত ‘স্বরাজ লহরী’ গ্রন্থটি এখনো উদ্ধার না হওয়া বাউল কবি রশিদ উদ্দিন সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য লোক আড়ালে রয়ে গেল।
আজ বাউল কবি রশিদ উদ্দিন, লেখক ও চলচ্চিত্রকার হুমায়ুন আহমেদ, বাউল শিল্পী বারী সিদ্দিকী, বাউল উকিল মুন্সী তারা সকলেই আমাদের ছেড়ে পরপারে চলে গেছেন। কিন্তু আমাদের জন্য রেখে গেছেন তাদের স্মৃতি আর অহংকার করার মতো কিছু কালজয়ী কর্ম। তারা প্রত্যেকেই স্ব-স্ব ক্ষেত্রে এক একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র, আমাদের জন্য এক একটি প্রতিষ্ঠান। তাঁরা বেঁচে থাকবেন যুগ যুগ ধরে, তাদের কর্মে। অমর হয়ে থাকবেন আমাদের মাঝে।

লেখক : অধ্যক্ষ গোলাম মোস্তফা, সংগ্রহ ও সম্পাদক, রশিদ গীতিকা এবং অধ্যক্ষ রাজুর বাজার কলেজিয়েট স্কুল, নেত্রকোণা সদর, নেত্রকোণা।

তথ সূত্র ঃ ১. বাউল কবি রশিদ উদ্দিনের হাতে লিখা পান্ডুলিপির তিনটি অংশ ও পারিবারিক ডায়েরি।
২. প্রবন্ধঃ “বাউল সাধক রশিদ উদ্দিন” লেখক, কবি রওশন ইজদানী, প্রকাশঃ মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকা, ২৬ বর্ষ, আশ্বিন, ১৩৬২সাল, পৃঃ৭৮২-৭৮৪।
৩. প্রবন্ধঃ “ময়মনসিংহের মুর্শেদী, মারফতি ও বাউল সাহিত্য” লেখক, কবি রওশন ইজদানী, প্রকাশঃ মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকা, ২২ বর্ষ,২য় সংখ্যা, অগ্রাহায়ন, ১৩৫৭-৫৮ সাল, পৃঃ১০৮-১০৯ ।
৪. প্রবন্ধঃ “বঙ্গীয় লোক সংস্কৃতির অঙ্গনে নেত্রকোণার বাউল সাধক রশিদ উদ্দিন’’, লেখকঃ গোলাম এশাদুর রহমান, নেত্রকোনার পৌষমেলা ও সাংস্কৃতি পক্ষ ১৪০০ স্বরনিকা।
৫. গ্রন্থঃ নেত্রকোনার লোকগীতি পরিচয়, লেখকঃ গোলাম এশাদুর রহমান, (১৯৯৮), সাতপাই, নেত্রকোনা।
৬. হুমায়ুন আহমেদের চলচ্চিত্রেমুক্তিযুদ্ধ, ৩ জানুয়ারি ২০১২ ।
৭. গ্রন্থঃ “কালনীর ঢেউ”, শাহ আব্দুল করিম, সিলেট।
৮. গ্রন্থঃ বাংলাদেশের বাউল ফকির (পরিচয় ও গান), লেখকঃ সুমন কুমার দাশ, ঢাকা (২০১২)
৯. গ্রন্থঃ উকিল মুন্সির গানঃ সম্পদনা মাহবুব কবির, ফেব্রæয়ারি ২০১৩ প্রকাশ ঐতিহ্য, ঢাকা।
১০. জাতীয় চলচ্চিত্র পুরুস্কারপ্রাপ্তদের নামের তালিকা (১৯৭৫-২০১২)।
১১. সাক্ষাতকার ও তথ্য সংগ্রহে সহযোগিতা ঃ (ক) আমিরজান বেগম, বাউল কবি রশিদ উদ্দিনের দ্বিতীয় স্ত্রী, বাহিরচাপড়া, নেত্রকোণা। (খ) আবু আনসার মোঃ কালা মিয়া, বাউল কবি রশিদ উদ্দিনের ছোট ছেলে, বাহিরচাপড়া, নেত্রকোণা। ( গ) আ ফ ম রফিকুল ইসলাম খান (আপেল), সভাপতি, শিকড় উন্নয়ন কর্মসূচি, নেত্রকোণা

Loading