বনানী হবে বাংলাদেশের ‘সিলিকন ভ্যালি’!

প্রকাশিত: ২:০৮ অপরাহ্ণ , আগস্ট ২৬, ২০২২

হুমায়ুন রশিদ (ছদ্মনাম) ঢাকার একটি টেক কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)। তার দিনের শুরু থেকে শেষ পুরোটাই টেকনোলজি নির্ভর। প্রতিদিন অ্যাপল সিরির ডাকে ঘুম ভাঙে হুমায়ুনের। অ্যামাজন এলেক্সায় নরম সুরের কোনো গান শুনতে শুনতে সকালের নাস্তা সারেন তিনি। বাসা থেকে বের হওয়ার আগে গুগল ম্যাপে দেখে নেন রাস্তাঘাটের অবস্থা। গাড়িতে বসেই ল্যাপটপের স্ল্যাকে দেখেন অফিসের হালচাল। এরপর দিনের প্রায় পুরোটাই কাটে বনানীর অফিসে। এই সেই ঢাকার বনানী, যেখানে গড়ে ওঠেছে সাড়ে তিনশর বেশি টেক কোম্পানি। বর্তমান বনানীকে দেখলে নিঃসন্দেহে এটিকে বাংলাদেশের ‘মিনি সিলিকন ভ্যালি’ বলা যায়। ভবিষ্যতে এটি স্বপ্নের ‘সিলিকন ভ্যালি’ হবে বললে অত্যুক্তি হবে না।

চলছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগ। প্রথম শিল্প বিপ্লব ছিল বাষ্প ইঞ্জিনের, দ্বিতীয়টি বিদ্যুতের, তৃতীয়টি কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের এবং বর্তমান শিল্পবিপ্লব হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে (এআই) ঘিরে। আমাদের অনেকের কাছে এখনো এআই এর ধারণাটি ঘোলাটে। একটু পরিষ্কার করে বললে, এই যে গুগলে কিংবা ইউটিউবে দেয়া ভয়েস কমান্ড (কোন গান শুনবেন, কী দেখবেন মুখে বলে দেয়া) ও সে অনুযায়ী ফলাফল পাওয়া, গাড়িতে উঠে কিংবা হাঁটতে গিয়ে গুগল ম্যাপে গন্তব্য সেট করে দিয়ে সে অনুযায়ী চলাচল করা, টিভি কিংবা এসিকে নিজেদের কথামতো অন/অফ করা- এসবই এআই-এর প্রাথমিক রূপ। অর্থাৎ আমাদের পাশে এমন কেউ আছে যারা আমদের কথা শুনতে বাধ্য, আমাদের সেবা দিয়ে থাকে, পূরণ করে আমাদের প্রাথমিক প্রয়োজনীয়তা।

ইতোমধ্যে আমরা প্রবেশ করেছি চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে। এখন যুগটা সম্পূর্ণ সফটওয়্যারের। একটি অফিসের কথাই চিন্তা করা যাক- একজন কর্মী কখন প্রবেশ করছেন, কখন বের হচ্ছেন, কতক্ষণ টেবিলে থাকছেন, কী পরিমাণে কাজ করছেন, কাজের মান কেমন- এসবই এখন সফটওয়্যার ভিত্তিক কাজ। নিজ থেকে গিয়ে হাজিরা খাতায় এখন স্বাক্ষর করতে হয় না, মালিককে এসে খোঁজ নিতে হয় না- কে কাজ করছেন, কে করছেন না- সবকিছুই জানা যাচ্ছে টেকনোলজির মাধ্যমে। জন্মসনদ, স্বাস্থ্যসেবা, নাগরিক সেবা, শিক্ষা সেবা থেকে শুরু করে মৃত্যুর প্রত্যয়নপত্র পর্যন্ত সবকিছুতে ডিজিটালাইজেশনের ছোঁয়া লেগেছে। দেশের সিংহভাগ মানুষকে ডিজিটালাইজড করতে দেশের বুকেই গড়ে ওঠেছে শত শত স্টার্টআপ কোম্পানি। তারা এআই ডেভেলপমেন্ট, অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট ও সফটওয়্যার সুবিধা থেকে দিচ্ছে সব ধরনের প্রযুক্তিগত সুবিধা।

২০ বছর আগেও বলা হতো, বাংলাদেশের বাজারে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারের দাম নেই। কিন্তু এখন এ কথা সেকেলে হয়ে গেছে। দেশের প্রযুক্তিখাত এখন আইটি ইঞ্জিনিয়ারদের হাতের মুঠোয়। অনেকেই শুরু করেছেন নিজেদের ব্যবসা। দেশে সফটওয়্যার সরবরাহ করে রফতানি করছেন বিদেশে। অনেকে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে একজোট হয়ে কাজ করছেন। যারা দেশের বাইরে বড় বড় সফটওয়্যার কোম্পানিতে কাজ করছেন, তারাও স্বপ্ন দেখেন দেশে ফিরে এসে নিজের প্রতিষ্ঠান খোলার।

এমনই একজনের সঙ্গে কথা হয় সময় সংবাদের। গুগলের ইঞ্জিনিয়ার শ্রীজয় হালদার বলেন, ‘বাংলাদেশে টেকনোলজিক্যাল খাতে বড় ধরনের বিপ্লব হচ্ছে। ঢাকার বনানীর দিকে তাকালেই কিন্তু এটা টের পাওয়া যায়। বনানী দিনকে দিন দেশের সিলিকন ভ্যালিতে পরিণত হচ্ছে। বড় বড় টেক হাবগুলো গড়ে উঠছে এ এলাকায়। আমারও ইচ্ছা আছে দেশে কিছু করার। নিজের একটি টেক কোম্পানি গড়ে তোলার।’

সরেজমিন খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, সত্যিই তাই। এ এক অন্য বনানী। প্রায় প্রতিটি ভবনেই রয়েছে একের অধিক টেক কোম্পানি। দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে থাকে।

এমনই এক টেক কোম্পানি নেক্সট আইটির বিজনেস ডেভেলপমেন্ট অফিসার মৃত্যঞ্জয় দাস সময় সংবাদকে বলেন, ‘আমরা মূলত গার্মেন্টস এক্সেসরিজ সফটওয়্যার নিয়ে কাজ করে থাকি। একটা সময় বিদেশ থেকে এ সফটওয়্যার কিনে এনে কাজ করতে হতো। এখন আমরা নিজেরাই এটি তৈরি করি। শুরুর দিকে সবখানে বাজারজাতের ইচ্ছা না থাকলেও আমরা বর্তমানে এটি বাজারজাত করা শুরু করেছি। এছাড়াও আমাদের আরও অনেক টেকনোলজিক্যাল কার্যক্রম আছে। আমাদের সবসময়ই লক্ষ্য থাকে নতুন কিছু করার।’

সময় সংবাদের সঙ্গে কথা হয় আরেক আইটি কোম্পানি ট্রাক্স টেকনোলজিসের ব্যবস্থাপক (বিজনেস ডেভেলপমেন্ট) মোস্তাহাদ আহমেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমরা মূলত ব্যাংকিং খাতে প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে থাকি। আমাদের মাদার কোম্পানি ব্যাংকের এটিএম বুথ ও টাকা ট্রান্সফারের কাজগুলোতে সহায়তা করে। ইন্টারনেট ব্যাংকিং ও কিউ-ক্যাশের মতো জিনিসগুলো নিয়ে কাজ করি আমরা। এছাড়াও আলাদাভাবে ট্রাক্স গ্রিন ব্যাংকিং নিয়ে কাজ করছে। এটিএম জ্যাকেট আমাদের একটি উদ্ভাবন বলতে পারেন। এক্ষেত্রে একটি বুথ চালাতে বিদ্যুৎ খরচ কমে আসে, কমে আসে বড় রকমের জায়গার ব্যবহার। ব্যাংকখাতকে কীভাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানির আওতাভুক্ত করা যায় এ নিয়ে এখন কাজ করছি আমরা।’

ব্যাংক ও শিল্পখাতে প্রযুক্তিগত সহায়তা দেয়ার মতো এমন শক্তপোক্ত আইটি কোম্পানি ছাড়াও গড়ে ওঠেছে অনেক সাধারণ সফটওয়্যার কোম্পানি। অনেকেই নিজেদের মতো করে অ্যাপ বানাচ্ছেন, বানাচ্ছেন গেমসের মতো অ্যাপগুলো। প্রতিটি কোম্পানিতে দেশের শত শত সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার কাজ করছেন।

ভিভাসফটের ব্যবস্থাপক আসিফ ইকবাল মাহমুদ সময় সংবাদকে বলেন, ‘আমাদের এখানে ১৬০ জনের মতো সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার কাজ করে থাকেন। এটা সম্পূর্ণ দেশীয় একটি প্রতিষ্ঠান। আমরা এখানে সফটওয়্যার ভিত্তিক প্রায় সব ধরনের সহযোগিতা করে থাকি।’

বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে গড়ে উঠবে সিলিকন ভ্যালি- এই স্বপ্ন দেখা কতটা যৌক্তিক জানতে চাওয়া হয় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদের কাছে। সময় সংবাদকে তিনি বলেন, ‘এটা কিন্তু মোটেও দিবাস্বপ্ন না। বাংলাদেশেই এটা সম্ভব। গুগলের অফিসে যে ছেলেটা কম্পিউটারের সামনে বসে আছে, আর আমাদের দেশের একটা ছেলে যে কম্পিউটারের সামনে বসে আছে, দুটোই কিন্তু প্রায় একই কম্পিউটার। পার্থক্যটা হচ্ছে আমাদের দক্ষতায়। আমাদের ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান আরও বাড়াতে হবে। প্রতিবছর বুয়েট থেকে কেউ না কেউ বাইরে গিয়ে প্রোগ্রামিংয়ে পুরস্কার নিয়ে আসছে। তাদের কতজনকে আমরা চিনি? কতজনকেও বা আমরা ধরে রাখতে পারি। আমাদের আগ্রহের জায়গাটা বদলাতে হবে। আমাদের যতটা না দেশপ্রেম ক্রিকেটকেন্দ্রিক তার সিকিভাগও প্রযুক্তিকেন্দ্রিক না। আপনাকে বাংলাদেশের সেরা ক্রিকেটার কে জিজ্ঞাসা করলে আপনি ফট করে তার নাম বলে দিতে পারবেন। কিন্তু আপনাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, আমাদের সবচেয়ে ভালো প্রোগ্রামারের নাম কী- আপনি কিন্তু উত্তর দিতে পারবেন না। আমাদের মানসিকতায় একটা বড় রকমের পরিবর্তন দরকার।’

সিলিকন-চিপ উদ্ভাবন ও বাজারজাত করার সূত্র ধরে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে গড়ে উঠেছিল বিখ্যাত সিলিকন ভ্যালি। অ্যাপল, ফেসবুক (বর্তমান মেটা), ভিসা ও শেভরনের মতো দুনিয়া কাঁপানো কোম্পানিগুলোর আঁতুড়ঘর এটি। প্রতিদিন এখানে চালু হচ্ছে নতুন নতুন স্টার্টআপ কোম্পানি। ইতোমধ্যে হাজার হাজার সফটওয়্যার ও ইন্টারনেট ভিত্তিক কোম্পানিতে সয়লাব এ সিলিকন ভ্যালি। ২০-২৫ বছর আগেও কেউ ভাবেনি সমুদ্র তীরবর্তী এ এলাকা কাঁপিয়ে বেড়াবে সারা দুনিয়া, কিন্তু হলো তাই। বর্তমান বাংলাদেশ দিনকে দিন প্রযুক্তিগতভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, আসছে নতুন নতুন উদ্ভাবন; নানা আইডিয়া নিয়ে শুরু হচ্ছে নিত্যনতুন স্টার্টআপ। এককালে গুলশানের পাশে বনানী বিখ্যাত ছিল অভিজাতদের আবাসন ও রেস্টুরেন্ট ব্যবসার জন্য। সেই বনানী ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছে বিশাল এক টেক হাবে- যেন বাংলাদেশের বুকে এক নতুন ‘সিলিকন ভ্যালি’। -সময় সংবাদ

 

Loading