লঞ্চের কেবিনে ‘জ্বীনের বাদশা’কে হত্যা, তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী গ্রেফতার

প্রকাশিত: ১১:৪৯ অপরাহ্ণ , আগস্ট ৩, ২০২২

ঢাকা থেকে ভোলাগামী গ্রীনলাইন-৩ লঞ্চে জাকির হোসেন বাচ্চূ ওরুফে জ্বীনের বাদশা (৩৮) নামের এক যুবককে হত্যার ঘটনায় তার তালাকপ্রাপ্ত কথিত স্ত্রী মোছাঃ আরজু আক্তার (২৩) কে গ্রেফতার করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ঢাকা জেলা পুলিশ।

মঙ্গলবার (০৩ আগস্ট) দুপুরে এসব তথ্য প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানিয়েছেন পিবিআই ঢাকা জেলা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) সালেহ ইমরান।

এরআগে, মঙ্গলবার (০২ আগস্ট) ভোর রাতে সাভারের আশুলিয়ার নবীনগর এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।

গ্রেফতার আসামী-মোছাঃ আরজু আক্তার বোরহানউদ্দিন থানার চরটিকটা গ্রামের মৃত হাফিজ উদ্দিনের মেয়ে।

নিহত জাকির হোসেন বাচ্চূ ওরুফে জ্বীনের বাদশা একই থানার পূর্ব মহিষখালি গ্রামের ফরাজি বাড়ির মোঃ সিদ্দিক ফরাজির ছেলে।

প্রেস বিজ্ঞপ্তি সূত্রে জানা গেছে, গত ৩২ জুলাই জাকির হোসেন বাচ্চূর ১ম স্ত্রী সুরমা আক্তার বাদী হয়ে দক্ষিণ করোনীগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়রে করনে।

মামলা নং- ৯৪। মামলার এজাহারে বাদী উল্লখে করনে, সুরমার স্বামী ২০২০ সালের এপ্রিল মাসের দিকে তার ২য় স্ত্রী আরজু বেগম বিয়ে করেন। ২য় বিবাহের পর জাকির কিছুদিন তার ২য় স্ত্রী আরজু এর সাথে বসবাস

করে এবং একপার্যায়ে তার স্বামী ২০২২ সালের এপ্রিল মাসের দিকে তার ২য় স্ত্রী আরজু বেগমকে ডিভোর্স দেয়। কাজের সুবাধে তার স্বামীর বড় ভাসুরের স্ত্রী মিনারা (৩০) এর বাসায় থাকত।

গত ২৯ জুলাই সকালে তার স্বামী লঞ্চে করে বাড়ীতে আসবে বলে জানায়। পরে ঐদিন স্বামীকে একাধিক ফোন দিলেও তার নাম্বার বন্ধ পায় সুরমা। যথাসময়ে বাড়ীতে না আসায় বিষয়টি সন্দহে হয় বিভিন্ন স্থানে খোঁজা-খুঁজি করিতে থাক।

একর্পযায়ে সদরঘাট নৌ থানার মাধ্যমে সংবাদ পায় যে, গত ২৯ জুলাই সদরঘাটে থাকা এমভি গ্রীন লাইন-৩ লঞ্চের ৩য় তলার মাষ্টার ব্রীজের সাথে মাষ্টার কেবিনের ভিতরে খাটের নিচে জাকিরের লাশ পাওয়া গেছে।

ছাড়াও উক্ত লঞ্চের কতিপয় স্টাফদের মাধ্যমে সুরমা জানতে পারে যে, সেই লঞ্চের কেবিনে জাকিরের সাথে কফি কালারের বোরকা পরিহিত মুখ ঢাকাবস্থায় একটি মেয়ে ছিল। তার স্বামীর মৃত্যুর পর তাকে আর কোথাও দেখা যায় নি।

এই মামলাটি পিবিআই’র সিডিউলভুক্ত হওয়ায় পিবিআই ঢাকা জেলা স্ব-উদ্দোগে মামলাটির তদন্ত অধিগ্রহণ করে।

পিবিআইয়ের অ্যাডিশনাল আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার বিপিএম (বার) পিপিএম এর সঠিক তত্বাবধান ও দিক নির্দেশনায় পিবিআই

ঢাকা জেলা ইউনিট ইনচার্জ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খোরশেদ আলম পিপিএম-সেবা এর সার্বিক সহযোগিতায় মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই (নিরস্ত্র) মোঃ আনোয়ার হোসেন মামলাটি তদন্ত করে রহস্য উদঘাটন করনে।

শেষমেশ গতকাল মঙ্গলবার ভোর রাতে সাভারের আশুলিয়ার নবীনগর এলাকা থেকে মোছাঃ আরজু আক্তারকে গ্রেফতার করা হয়।

গ্রেফতার আসামী জানায়, মৃত জাকির হোসেন বাচ্চু দুই বছর পূর্বে জীনের বাদশা পরিচয়ে আরজু আক্তার কে ফোন দেয়।

তারপর থেকে আরজু আক্তারের সাথে পরিচয়, প্রেম ও পরবর্তীতে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। আরজু জাকির হোসেন বাচ্চুর ২য় স্ত্রী। ভুক্তভোগী জাকির হোসেন বাচ্চু আসামী আরজু আক্তারকে জীনের বাদশা প্রতারনার কাজে ব্যবহার করে এবং তাকেও এই কাজে পারদর্শী করে।

আরজুর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ থাকার পরও জাকির হোসেন বাচ্চু একাধিক নারীর সাথে পরকীয়া প্রেমে জড়িয়ে পড়ে। জ্বীনের বাদশার পরিচয়ে প্রতারনার মাধ্যমে জাকির হোসেন বাচ্চু যে অর্থ উপার্জন করত তা অনৈতিক কাজে খরচ করত।

এসব বিষয় নিয়ে আরজু আক্তারের সাথে জাকিরের ব্যাপক মনোমালিন্য সৃষ্টি হলে গত প্রায় ৫ মাস আগে দ্বিতীয় স্ত্রী আরজু আক্তারকে তালাক দেয়। দ্বিতীয় স্ত্রী আরজু আক্তারকে তালাক দেওয়ার পরও জাকির হোসেন তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক বজায় রাখে।

তালাক দেওয়ার পরও দ্বিতীয় স্ত্রী আরজু আক্তার এর সাথে শারীরিক সম্পর্ক থাকাকালে জাকির হোসেন বাচ্চু পুনরায় একাধিক নারীর সাথে পরকীয়া সম্পর্কের বিষয়টি আরজুর কাছে ধরা পরে।

এতে আরজু আক্তার আরো বেশী ক্ষিপ্ত হয় এবং জাকির হোসেন বাচ্চুকে উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়ার সুযোগ খোঁজতে থাকে।

হত্যার আগের দিন রাতে জাকির হোসেন বাচ্চু তার এক পরকীয়া প্রেমিকার সাথে রাত্রি যাপন করে। বিষয়টি আরজু আক্তার বুঝতে পারে।

জাকির হোসেন ঘটনার দিন গত ২৯ জুলাই শুক্রবার ঢাকা থেকে লঞ্চে গ্রামের বাড়ি ভোলা যাওয়ার বিষয়টি আসামী আরজু আক্তার জানতে পারে। আসামী আরজু জাকির হোসেন বাচ্চুকে লঞ্চের একটি কেবিন ভাড়া করে তাকেও বাড়ি নিয়ে যেতে বলে।

জাকির ও আসামী আরজু আক্তারের বাড়ি একই এলাকায় পাশাপাশি গ্রামে হওয়ায় জাকির হোসেন বাচ্চু ঢাকা থেকে ভোলাগামী এমভি গ্রীন লাইন- ৩ লঞ্চের একটি স্টাফ কেবিন ভাড়া করে।
ভাড়া নেওয়ার সময় তারা স্বামী স্ত্রী পরিচয় দিয়ে লঞ্চে উঠে। কেবিন ভাড়া নেওয়ার সময় লঞ্চ কর্তৃপক্ষ তাদের নিকট থেকে কোন তথ্য রাখেনি। লঞ্চে উঠা থেকে নামা পর্যন্ত আসামী আরজু আক্তার বোরকা পরিহিত মুখ ঢাকা ছিল।

জিজ্ঞাসাবাদে আসামী আরজু আক্তার আরও জানায়, সকাল ৮টার দিকে সদরঘাট থেকে ভোলার ইলিশা যাওয়ার জন্য লঞ্চে উঠে। পরিকল্পনা অনুযায়ী আসামী আরজু আক্তার দুধের সাথে ৫ টি ঘুমের ট্যাবলেট মিশিয়ে লঞ্চে উঠে। জাকির হোসেন এক বাটি রসমালাই ক্রয় করে।

লঞ্চের কেবিনে উঠার পর তারা শারীরিক মেলামেশা করে। ঘন্টা খানেক পর আসামী আরজু আক্তার ঘুমের ওষুধ মিশ্রিত দুধ ডিসিষ্ট জাকির হোসেনকে খাইয়ে দেয়। দুধ খাওয়ার কিছুক্ষনের মধ্যে জাকির হোসেন অচেতন হয়ে গেলে উড়না দিয়ে জাকির হোসেনের হাত এবং পা বেধে ফেলে।

পরে অন্য একটি উড়না দিয়ে জাকির হোসেনকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। হত্যার পর জাকির হোসেনের লাশ কেবিনের স্টিলের খাটের নিচে লুকিয়ে রেখে লঞ্চটি ভোলার ইলিশা ঘাটে পৌছালে আরজু আক্তার নেমে যায়। ঐ দিন দুপুরে লঞ্চটি ইলিশা হতে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।

লঞ্চের স্টাফরা উক্ত কেবিনটি তিন জন বাচ্চা সহ দুই জন মহিলাকে ভাড়া দেয়। লঞ্চটি ঘাট ছেড়ে আসার প্রায় দুই ঘন্টা পর মহিলাদের সাথে থাকা একটি বাচ্চা খাটের নিচে প্রবেশ

করলে একজন মহিলা খাটের নিচ থেকে বাচ্চাটিকে আনতে গেলে লাশ দেখে চিৎকার শুরু করলে বিষয়টি লঞ্চের স্টাফদের নজরে আসে।

লঞ্চ কর্তৃপক্ষ সদরঘাট এসে বিষয়টি ঢাকা সদরঘাট নৌ থানা পুলিশকে অবহিত করলে সদরঘাট নৌ থানা পুলিশ অজ্ঞাত ব্যক্তির পরিচয় সনাক্তের জন্য পিবিআইকে অবহিত করে।

পিবিআই ঢাকা মেট্রো উত্তর এর ক্রাইমসিন টীম নিহত জাকির হোসেন বাচ্চুর পরিচয় সনাক্তের পর বিষয়টি পিবিআই ঢাকা জেলা পুলিশকে অবহিত করে।

এ বিষয়ে পিবিআই ঢাকা জেলা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) সালেহ ইমরান জানান, পিবিআই ঢাকা জেলা পুলিশ এর চৌকস একটি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শনসহ বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে।

পরে গত ৩১ জুলাই জাকিরের ১ম স্ত্রী সুরমা আক্তার বাদী হয়ে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করে। মামলা নং- ৯৪।

মামলাটি পিবিআই’র শিডিউলভুক্ত হওয়ার পর গত ০১ আগস্ট মামলাটি অধিগ্রহণ করার ৪৮ ঘন্টার পূর্বেই আসামীকে গ্রেফতার করে পিবিআই ঢাকা জেলা।

গ্রেফতার আসামী আরজু আক্তার গত ০২ আগস্ট তারিখ হত্যাকান্ডের বর্ণনা দিয়ে বিজ্ঞ সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের কাছে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী প্রদান করেন।

Loading