ডিসেম্বরের রণাঙ্গন

কারেন্ট জালের মতো ঘিরে ফেলছে ‘মুক্তি-মিত্র’

প্রকাশিত: ১০:১৮ পূর্বাহ্ণ , ডিসেম্বর ৮, ২০২১
শেখ সাদী

৮ ডিসেম্বর, জেনারেল স্টাফ অফিস থেকে জি ০৯১২ নম্বরের আরেকটি সংকেত বার্তা আসে লে জে নিয়াজির কাছে। বার্তায় জানানো হলো, ‘তৎপরতা শুরু হয়েছে।’

এই ‘তৎপরতা’ মানে পাকিস্তানের পাশে দাঁড়াচ্ছে চীন।

থেমে নেই অরোরা। সীমান্ত এলাকায় সেনাবাহিনীকে সাজিয়ে ফেললেন রণসাজে।

সংবাদ বিনিময়ের জন্য গুয়াহাটি অফিস খোলা হলো।

ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে থাকল জেনারেল ওসমানীর নেতৃত্বে ৬০ হাজার মুক্তিসেনা। আর, মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগের দায়িত্বে থাকলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল বি এন সরকার। ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী নিয়ে গঠন দলে সর্বাধিনায়কের দায়িত্বে পেলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা।

সকাল থেকে সীমান্ত এলাকায় শত শত কংক্রিটের পিল বক্স, পুরু ছাদওয়ালা বাংকার, ট্যাংক প্রতিরোধকারী পরিখা খনন করা হচ্ছে। প্রতিটি জায়গায় জড়ো করা হচ্ছে বিপুল গোলাবারুদ। এবার ঝটিকা আক্রমণে পাকিস্তানি সেনাদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়া হবে। চলছে সেই প্রস্তুতি।

এদিকে প্রায় সবখানে মার খাওয়ার খবর আসলেও বাঁচার পথ খুজছেন লে জে নিয়াজি। আর, গতকাল থেকে গুজবের ফানুসটা ফুলে উঠেছে, ‘হেলিকপ্টারে পালিয়ে গেছেন নিয়াজি।’

না, না এই অপমানের জবাব দিতে হবে।  সকালে গরম পানিতে গোসল সেরে কফির পেয়ালা হাতে নিয়ে বসলেন টেলিফোনের সামনে। ফোন করলেন রাওয়ালপিণ্ডি।

আজও একই আশ্বাস। উত্তরের পাহাড়ি পথ দিয়ে নেমে আসবে চীনারা। আর, বঙ্গোপসাগরের পানিপথে আসবে মার্কিন সেভেনথ ফ্লিট। কথাটি পুরোপুরি বিশ্বাস হচ্ছে না। রাওয়ালপিণ্ডিতে জেনারেল হামিদের ব্যক্তিগত সচিবকে চড়া গলায় প্রশ্ন করলেন নিয়াজি, ‘চীন-আমিরিকার জন্য আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে?’

উত্তর এলো, ‘৩৬ ঘণ্টা।’

ঢাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন বিদেশিরা। যাদের বেশিরভাগই এতোদিন ছিলেন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। খবরটা নিয়জির কানে পড়েছে। সাথে নিজের পালিয়ে যাবার খবরটি মেনে নিতে পারছেন না লে জে।

ক্যান্টনমেন্টের ডেরা থেকে বেরিয়ে নিয়াজির গাড়ি এসে ঘ্যাচ করে ব্রেক কষলো হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে। হনহন করে ঢুকলেন হোটেলের রিসিপশনে। এখানে কয়েকজন বিদেশি জড়ো হয়ে আছেন ব্যাগ-পোটলা নিয়ে।বিমানবন্দরে যাবার অপেক্ষা।

রিসিপশনে ঢুকেই উত্তপ্ত প্রশ্ন নিয়াজির, ‘কে বলেছে আমি পালিয়েছি? এই যে আমি ! ’

খবরটা বিদেশিরা ছড়ালেও এখন সবাই দাঁতে-দাঁত এঁটে থাকলেন।

রাওয়ালপিন্ডিতে কথা বলার পর থেকে নিয়াজি আর ‘দমবন্ধ’ অবস্থা লাগছে না।

পূর্ণ উদ্যোমে ভারতীয় আক্রমণ ঠেকানোর ব্যবস্থা সাজাতে বসলেন। নিয়াজির নির্দেশে বাংলায় প্রবেশের সব পথ বন্ধ করে দেওয়া হলো। এদিকে অরোরার যুদ্ধ-পরিকল্পনার কিছুই ‘আঁচ’ করতে পারলেন না পাকিস্তানি লে জে।

স্থলযুদ্ধে সুবিধা করতে না পেরে আমেরিকার দেওয়া স্যাবার জেট বিমান দিয়ে আক্রমণ করে পাকিস্তানি সেনারা। সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় বিমানের হামলা। মাটিতে ভেঙে পড়ল পাকিস্তানের তিনটি স্যাবার জেট।

খণ্ডযুদ্ধ  চলছে। সবখানেই মুক্তি-মিত্র’র জোট প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে আঘাত করছে।

সবখানেই অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে পাকিস্তানি সেনা। মিত্রবাহিনী চারদিক থেকে ঘিরে ফেলছে, কারেন্ট জালের মতো।

ভারতীয় জেনারেল মানেকশ বিভিন্ন ভাষায় হানাদার বাহিনীকে আত্মসমর্পণের বার্তা লিখে ‘লিফলেট’  ছেপে ওড়ালেন আকাশে।  হেলিকপ্টার থেকে হাজার হাজার লিফলেট ছড়িয়ে পড়তে থাকলো। লিফরেটে মানেকশ বার্তা দিলেন, ‘আত্মসমর্পণ করলে তাদের প্রতি জেনেভা কনভেনশনের রীতি অনুযায়ী সম্মানজনক ব্যবহার করা হবে।’

পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণের দিকে না গিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সেনাদের নির্দেশ দেয়। বাড়তে থাকে যুদ্ধের তীব্রতা।

প্রতি ক্ষেত্রে হানাদার বাহিনীকে একের পর এক পরাজিত করতে থাকে মুক্তিবাহিনী।

পাকিস্তানি সেনা অবস্থানের ওপর মুক্তিসেনারা আর্টিলারি আক্রমণ চালায়।

মুক্ত হলো কুমিল্লা, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

রাস্তায় নেমে আসে জনতা।

কুমিল্লার আপামর জনগণ মুক্তিযোদ্ধাদের ফুলের পাপড়ি-ছিটিয়ে মুক্তির উল্লাসে বরণ করে নেয়। বিকেলে কুমিল্লা টাউন হল মাঠে বীর মুক্তিযোদ্ধা মিত্রবাহিনী জনতার উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। পূর্বাঞ্চলের প্রশাসনিক কাউন্সিলের চেয়ারম্যান রেহুম জহুর আহমেদ চৌধুরী, দলীয় পতাকা এবং কুমিল্লার প্রথম প্রশাসক অ্যাডভোকেট আহমদ আলী জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন।

এদিকে কুষ্টিয়ার মিরপুর থানায় কমান্ডার আফতাব উদ্দিন খান ১৭০ মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা গান স্যালুটে উত্তোলন করেন। আর, বিভিন্ন স্থানে লেজ গুটিয়ে পালানোর সময় পোড়ামাটির নীতি গ্রহণ করে লে জে নিয়াজি। আগুন জ্বলছে শত শত গ্রামে।

শেখ সাদীঃ লেখক ও গবেষক

Loading