‘কুলপতাক ; অসাম্প্রদায়িক বাংলার প্রতিচ্ছবি’ – ওবায়দুল হাসান

সুস্থির সরকার সুস্থির সরকার

বিভাগীয় প্রধান ময়মনসিংহ

প্রকাশিত: ২:০৬ অপরাহ্ণ , মে ১৯, ২০২১

শৈশবের স্মৃতির চিরকুটগুলোর কোনো কোনোটি এখনও মানসপটে উজ্জ্বল। সেদিনের একটি ভ্রমণ স্মৃতি এখনও মনের মাঝে ঘুরেফেরে। বাবার সঙ্গে গিয়েছিলাম নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ উজেলার সোয়াইর ইউনিয়নের কুলপতাক গ্রামে। আমাদের গ্রামের বাড়ি হাটনাইয়ার (ছয়াশি) বেশ কাছেই গ্রামটি। তখন সেখানে অস্ট্রেলিয়ার কিছু নাগরিক বাস করতেন। সবুজ বনানীতে ঘেরা শান্ত গ্রামটিতে গড়ে উঠেছিল ‘অস্ট্রেলিয়ান মিশন’। দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য কল্যাণমূলক নানা কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়ে ১৯৫৮ সালে স্থাপিত হয়েছিল এই মিশন।

বাবার সঙ্গে ওই মিশনবাড়িতে গিয়েছি সম্ভবত দু’বার। ১৯৬৬-৬৭ সালের কথা। আমি তখন ৭-৮ বছরের শিশু। আমাকে একজন মেম সাহেব সুন্দর পাথরের পেয়ালায় গরম দুধ পান করতে দিয়েছিলেন। দেয়ালের ওপর টালির তৈরি চৌচালা বাংলো ঘরে তারা থাকতেন। দরজা-জানালা নেট দিয়ে পরিবেষ্টিত। ওই বাড়িতে একটি যান্ত্রিক পাখা ছিল। সেটি চলত কেরোসিনের সাহায্যে। ঘরে বৈদ্যুতিক বাতিও জ্বালাতেন কেরোসিনের সাহায্যেই। এটি ছিল ব্যাপটিস্টদের একটি মিশন। গোড়ার দিকে মিশনটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জেলার মদন উপজেলার গোবিন্দশ্রী গ্রামে। কুলপতাক গ্রাম থেকে ৪-৫ মাইল দূরে ১৯৩০-৩১ সালের দিকে। প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে ছিলেন রেভারেন্ড এফডি আইসন্স, মিস জোনস, রোনাল্ড চেস্টারটন পটার, সিরিল জেমস মুর ও এডনা। মি. সিরিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংগ্রহণ করেছিলেন বলে স্থানীয়ভাবে জনশ্রুতি আছে। এই বিদেশিরা ঢাকা থেকে ট্রেনযোগে ময়মনসিংহ যেতেন এবং সেখান থেকে অন্য ট্রেনে মোহনগঞ্জ যেতেন। মোহনগঞ্জ থেকে স্পিডবোটে যেতেন গোবিন্দশ্রী গ্রামে। জেনেছি, ১৯৪৪ সালের ২৯ জুলাই ঘটে যায় এক মর্মন্তুদ ঘটনা। সেদিন আবহাওয়া খুব খারাপ ছিল। মিশনের প্রতিষ্ঠাতাদের তিনজনই মোহনগঞ্জ থেকে স্পিডবোটে গোবিন্দশ্রী গ্রামে যাওয়ার পথে মেন্দীপুর এবং গোবিন্দশ্রী গ্রামের মাঝখানে একটি হাওরে তাদের স্পিডবোট উল্টে যায়। পানিতে ডুবে তাদের তিনজনই মৃত্যুবরণ করেন। পরে স্থানীয়রা তাদের মরদেহ উদ্ধার করে মিশনে নিয়ে যায় এবং সেখানেই তাদের সমাহিত করা হয়। সিরিল জেমস মুর ও এডনা একে অপরের বাগদত্তা ছিলেন। মিশনে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিয়ের অনুষ্ঠানের বদলে তাদের দু’জনকে একই কবরে সমাহিত করা হয়। গ্রামবাসীর জন্য এটি ছিল চরম বিষাদের।

 

মিশনের প্রতিষ্ঠাতাদের আকস্মিক তিরোধানের পর অস্ট্রেলিয়া থেকে আরও লোকজন আসেন মিশনের দায়িত্ব নিতে। তারা তখন ভাটি এলাকার পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত উজান এলাকায় মিশনটি স্থানান্তর করার চিন্তা করেন। এই চিন্তা থেকে তারা কুলপতাক গ্রামে মিশনটি স্থানান্তর করেন ১৯৫৮ সালের দিকে। এ ক্ষেত্রেও রেভারেন্ড এফ. ডি আইসন্স ও মিস জোনসের অগ্রণী ভূমিকা ছিল। এখানেও স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেন। ধরনীকান্ত দাস একজন সংগ্রামী মানুষ, তিনি ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন ১৯৩৪ সালের দিকে। তিনি তার নাম পরিবর্তন করেননি। তার ছেলে মি. প্যানোয়েল দাস বর্তমানে কুলপতাক গ্রামে বসবাস করছেন। তার ছেলে জেমসন দাস ঢাকায় বসবাস করেন। ধরণী কান্ত দাস গোবিন্দশ্রীর অধিবাসী ছিলেন। ১৯৫৮ সালে কুলপতাক গ্রামে মিশন স্থানান্তরিত হওয়ার সময় খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের সবাই এ গ্রামেই চলে আসেন। সে সময় তারা চেস্টারটন পটার, সিরিল জেমস মুর ও এডনার কবর দুটিও এই কুলপতাক গ্রামে স্থানান্তর করেন।

মনে গেঁথে থাকা শৈশবের স্মৃতিকে সাথী করে ১ এপ্রিল ২০২১ গিয়েছিলাম কুলপতাক গ্রামের সেই মিশন বাড়িতে। সঙ্গে ছিলেন আমার স্ত্রী নাফিসা বানু, ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কামরুল হাসান, উপজেলা ভাইস চেয়রাম্যান দিলীপ দত্ত, স্থানীয় মুরুব্বি নূরন্নবী চৌধুরী, বজলুর রহমান চৌধুরী, বীর মুক্তিযোদ্ধা নূরুল ইসলাম নূর মিঞা প্রমুখ। আমাদের সঙ্গে মোহনগঞ্জ থেকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সার্কেল) এবং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাও গিয়েছিলেন। ইউনিয়নটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান আদর্শনগর। এখানে শহীদ স্মৃতি কলেজ নামে একটি কলেজ গড়ে উঠেছে। প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব সাজ্জাদুল হাসানের উদ্যোগে ২০১৫ সালে এই কলেজটি স্থাপিত হয়। অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কলেজের লাইব্রেরিটিও অত্যন্ত সমৃদ্ধ। ক্লাসরুম, কনফারেন্স রুম সবই আধুনিক সাজে সজ্জিত। কলেজটির দক্ষিণ-পশ্চিম দিক দিয়ে নেমে গেছে কুলপতাকের রাস্তা। জিপ গাড়িতে যাচ্ছি, রাস্তার দু’ধারে অবারিত সবুজের সমারোহ। মাঠে মাঠে সবুজ ধানের চারাগুলো জানান দিচ্ছিল আর কিছুদিন পরই ওরা শস্যবতী হবে। এক-দেড় কিলোমিটার দূরত্ব পার হতেই কুলপতাক গ্রাম। গাড়ি থামল মিশনের কাছাকাছি। হেঁটে যেতে হবে পঞ্চাশ গজের মতো। চারদিকে তাকিয়ে একটু ভালো করে দেখে নিলাম। শৈশবে দেখা চিত্র পেলাম না। সাহেব-মেম সাহেবদের সেই ছোট ছোট বাংলোর মতো ঘরগুলো এখন ধ্বংসস্তূপ। অদূরেই গড়ে উঠেছে একটি সুন্দর চার্চ। আমি সেটিতে যাইনি। যে চার্চটিতে গিয়েছিলাম সেটি দেয়ালের ওপর চৌচালা টিন দিয়ে তৈরি। একসময় কুলপতাক গ্রামের খ্রিষ্টান সম্প্রদায় দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। এই বিভাজন ছিল গোষ্ঠীগত মতানৈক্যের কারণে। জানতে পারি, মতানৈক্যের কারণেই অপর চার্চটি পরবর্তীকালে গড়ে ওঠে। এখন অবশ্য কুলপতাকের খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী সবাই একত্রে মিলেমিশে বড়দিনের অনুষ্ঠানসহ অন্য সব ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান চার্চেই করে থাকেন।

আমাদের ফুল দিয়ে বরণ করে ছোট ছেলেমেয়েরা। চার্চের যাজক বিধুভূষণ মজুমদার তাদের ধর্মগ্রন্থ থেকে কিছু পাঠ করেন। তার কথাগুলোর মধ্যে ছিল- ‘এই করোনা মহামারিতে ঈশ্বর আমাদের এখনও সুস্থ রেখেছেন, এটা তার কৃপা। আমরা সকলেই যেন সমাজের অনাচার দূর করতে সচেষ্ট হই। প্রভুর কৃপার কথা স্মরণে রেখেই যেন আমরা আমাদের পথচলা ঠিক করি।’ এই অনুষ্ঠানটিতে গ্রামের হিন্দু, মুসলমান ও খ্রিষ্টান এই তিন সম্প্রদায়ের মানুষই উপস্থিত ছিলেন। আমার বক্তব্য শেষ হলে তারা আমাদের চার্চের অফিসে নিয়ে যান। সেখানে যথেষ্ট ফল ও মিষ্টান্নের ব্যবস্থা ছিল। আমি হেঁটে গ্রামের কিছু অংশ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি। বেশ কয়েকটি বড় পুকুর আছে এই গ্রামে। তবে আমার শৈশবে দেখা এই গ্রামের সেই শ্রী আজ নেই। রাস্তাঘাট হয়েছে বেশ। কিন্তু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বেশ ছেদ পড়েছে। দেখছি, সেখানে এখন কেরোসিনের সাহায্যে চালিত পাখার জায়গায় বৈদ্যুতিক পাখার স্থান। সময়ের পথ ধরেই এই পরিবর্তন। তবে গ্রামের মানুষের স্নেহ ও মায়া-মমতার মাঝে কোনো কমতি ছিল না। মহিলারা বারবার বলছিলেন- ‘স্যার আবার আসবেন, আবার আসবেন।’ অনুভব করেছি এটা তাদের হৃদয় নিঃসৃত উচ্চারণ। আমি তো এই ইউনিয়নেরই বাসিন্দা। কিন্তু সেই ছোটবেলার পর আর কখনও যাওয়া হয়নি এই গ্রামে।

কুলপতাক গ্রামের প্রখ্যাত ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন শ্রী যতীন্দ্র বিশ্বাস। খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীরা যতীন্দ্র বিশ্বাসের কাছ থেকে জমি কিনে মিশন স্থাপন করেন। যতীন্দ্র বিশ্বাসের পরিবারের প্রায় সবাই ১৯৪৭-এ দেশভাগের পর ভারতে প্রত্যাবাসিত হতে শুরু করে। তবে যতীন্দ্র বিশ্বাস দেশ ত্যাগ করেন ১৯৫৮ সালের পর।

কুলপতাক গ্রাম ছাড়াও নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর ও কলমাকান্দা উপজেলায় এখনও কিছু খ্রিষ্টান ধর্মানুসারী রয়েছেন। তবে তারা গারো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। জেলার অন্য কোথাও সম্ভবত বাঙালি খ্রিষ্টান নেই। বাংলাদেশে খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী মানুষের আনুপাতিক হার সম্ভবত দশমিক ৫০ শতাংশেরও কম। নেত্রকোনা জেলার মোট জনসংখ্যার শতকরা দশমিক ৮২ শতাংশ খ্রিষ্টান। সমগ্র দেশের তুলনায় এখানে আনুপাতিক হার একটু বেশি। তার মধ্যে দুর্গাপুর ও কলমাকান্দা উপজেলায় এর আনুপাতিক হার আরও একটু বেশি, যথাক্রমে ৩ দশমিক ৯০% ও ৩ দশমিক ১৭%। মোহনগঞ্জ উপজেলার কুলপতাক গ্রামের লোকসংখ্যা ২০০০-২২০০-এর মধ্যে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা আনুমানিক ৫০-৫৫ শতাংশ, মুসলিম ৩৫ এবং খ্রিষ্টান আনুমানিক ১০-১২ শতাংশ। গ্রামটিতে মন্দিরের সংখ্যা চার-পাঁচটি, মসজিদ তিনটি, চার্চ দুটি।

শৈশবের স্মৃতি হাতড়ে কুলপতাক ভ্রমণ শেষ হয়। এবার মোহনগঞ্জে ফেরার পালা। চার্চের হলঘরের মানুষগুলোর কথা মনে পড়ছিল। তিন ধর্মের মানুষ একত্র হলেন কী পরম আনন্দে! যাজকের কথাগুলো মনে অনুরণিত হচ্ছিল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন যে অসাম্প্রদায়িক বাংলার স্বপ্ন দেখতেন, এটি তো সেই বাংলা। কুলপতাক গ্রামই যেন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের এক খণ্ডিত প্রতিচ্ছবি। গ্রামের সকল মুরুব্বি ও অন্যদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসার সময় গাড়িতে উঠি। গ্রামটি দেখতে দেখতে ফিরছি। সেই সঙ্গে মনে পড়ছিল আমার সেই শৈশবকালের সাহেব, মেম সাহেবদের আতিথেয়তার কথা। ভাবনায় যুক্ত হচ্ছিল আজকের দেখা সম্প্রীতিপ্রিয় মানুষগুলোর আন্তরিকতা ও ভালোবাসার কথা। তাদের হাসিমাখা ভালোবাসা ও স্নেহের কথা। গ্রামটি আমার মানসপটে স্থান করে নিয়েছে।

কুলপতাক গ্রাম সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত। শৈশবের স্মৃতিজড়িত বহুকাল পরে দেখা এই গ্রামের সবুজ প্রকৃতি ও মানুষের সম্প্রীতির মাঝে অনন্য এক মানবিক চিত্র খুঁজে পাই। কুলপতাক গ্রাম আমার ভাবনার এক অবিচ্ছিন্ন অংশ হয়ে রইবে। আমি যেন এই কুলপতাক গ্রামেরই একজন।

ওবায়দুল হাসান,                                                                                                                                                                                বিচারপতি,                                                                                                                                                                                          বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আপিল বিভাগ, ঢাকা।

[সূত্র: সমকাল]

Loading