কর্ণফুলী টানেল এখন দৃশ্যমান বাস্তবতা অগ্রগতি ৬০ ভাগ

প্রকাশিত: ৫:১৩ অপরাহ্ণ , অক্টোবর ১৪, ২০২০

বৈশ্বিক সংকট করোনা মহামারীর মধ্যেও অব্যাহতভাবে এগিয়ে চলছে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে বহুলেন সড়ক টানেল নির্মাণ প্রকল্পের কাজ। নির্মিতব্য টানেলটি দেশের প্রথম টানেল। এটির নামকরণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। অবিরাম চলছে কর্মযজ্ঞ। দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে টানেলের বিভিন্ন অংশ। সার্বিকভাবে প্রকল্পের ৬০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে।

কর্ণফুলী নদীর উপর ইতোমধ্যে ২ টি বড় আকারের সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। তবে সেগুলো যানবাহনের চাপ সামাল দেওয়ার জন্য যথেষ্ঠ নয়। কিন্তু আরও সেতু নির্মাণ করা হলে কর্ণফুলীর তলদেশ পলিতে ভরে যাবে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। এটি চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যকারীতার জন্য একটি হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। এ সংকট থেকে উত্তরণের জন্যই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূররর্শীতার ফসল দেশের প্রথম টানেল (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল) নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

উন্নয়ন কাজ স্বাভাবিক গতিতে চালিয়ে যেতে পারলে আগামী ২০২২ সালের মধ্যে যানচলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে টানেলটি। প্রকল্প পরিচালক মোঃ হারুনুর রশিদ চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, প্রকল্পের কাজ সম্পন্নের সময় নির্ধারিত রয়েছে ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাস। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ করার লক্ষ্য নিয়ে আমরা কাজ করছি। চীনের চায়না কমিউনিকেশন কোম্পানী টানেলটির নির্মাণ কাজ বাস্তবায়ন করছে।

বর্তমান সরকার বন্দর নগরী চট্টগ্রামকে চীনের সাংহাই নগরীর মতো ‘এক নগরে দুই শহর’ আদলে গড়ে তোলার লক্ষ্যে এ টানেল নির্মাণ কাজ শুরু করে। প্রাথমিক কাজ সমাপ্তির পর ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ তারিখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানেলের বোরিং কাজ উদ্বোধন করেন। টানেলটি কর্ণফুলীর তলদেশ দিয়ে চট্টগ্রাম নগরীকে বন্দর এলাকা ও আনোয়ারা এলাকা-এ দু’ প্রান্তে সংযুক্ত করবে। চট্টগ্রাম শহরকে বাইপাস করে টানেলটি ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সহজতর করবে। ফলে চট্টগ্রাম শহরের যানজট নিরসন হবে। এটি এশিয়ান হাইওয়ে হিসেবেও ব্যবহৃত হবে।

এ প্রকল্পের জন্য ৩৮২ একর ভুমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্থ জমির মালিকদের ক্ষতিপুরণের টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়াও টানেল কর্তৃপক্ষ-কর্তৃক অদ্যাবধি ক্ষতিগ্রস্থ ৪২৪ জন জমির মালিককে অতিরিক্ত মঞ্জুরীর অর্থ বাবদ ১৯৬ কোটি টাকার অধিক বিতরণ করা হয়েছে।

প্রকল্পের দৈঘ্য ৯.৩৯ কিলোমিটার। ২টি টিউব সংবলিত মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩.৩২ কিলোমিটার। এর মধ্যে টানেল টিউবের দৈর্ঘ্য ২.৪৫ কিলোমিটার এবং ভিতরের ব্যাস ১০.৮০ মিটার। টানেলের ভিতরের Vertical clearance ৪.৯০ মিটার। টানেলের পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তে মোট ৫.৩৫ কিলোমিটার এপ্রোচ রোড এবং ৭২৭ মিটার ওভারব্রিজ (Viaduct) রয়েছে। আটটি কনক্রিট সেগমেন্ট পরস্পরের সাথে সংযুক্ত করে একটি টানেল রিং তৈরি করা হয়। ইতোমধ্যে ২.৪৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে প্রথম টানেল টিউবের রিং প্রতিস্থাপনসহ বোরিং কাজ শেষ হয়েছে। আগামী নভেম্বর/ডিসেম্বর মাসে দ্বিতীয় টানেল টিউবের বোরিং কাজ শুরু হবে বলে জানা যায়।

প্রকল্প পরিচালক জানিয়েছেন, চীনের জিয়াংসু প্রদেশের জেংজিয়াং শহরে টানেল সেগমেন্ট কাস্টিং প্ল্যান্টে টানেলটির সেগমেন্ট নির্মাণের কাজ চলমান আছে এবং ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় ১৯ হাজার ৬১৬ টি সেগমেন্টের মধ্যে ৯০.৯% সেগমেন্ট নির্মান সম্পন্ন হয়েছে। ইতোমধ্যে ৭৫.৭৭ ভাগ সেগমেন্ট চট্টগ্রাম সাইটে পৌঁছেছে এবং ৫০ ভাগ সেগমেন্ট নির্মানাধীন টানেলে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। নির্মিতব্য টানেল সাইটে নদীর প্রস্থ ৭০০.০০ মিটার এবং পানির গভীরতা ৯-১১ মিটার। নির্মিতব্য টানেলটি নদীর তল দেশ হতে ১৮-৩১ মিটার গভীরতায় নির্মিত হচ্ছে যার দৈর্ঘ্য ৩.৩২ কিলোমিটার। টানেল নির্মাণে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে চীন সরকার দিচ্ছে ৫ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা। বাকি অর্থ বাংলাদেশ সরকার যোগান দিচ্ছে।

তিনি জানান, টানেলটির পূর্ব প্রান্তে ওয়ার্কিং শাফট এবং Cut & Cover এর কাজ চলমান রয়েছে। ইতোমধ্যে ডায়াপ্রাম ওয়াল, Rotary Jet Grouting, Cement- mixed -pile, Cast -in -Situ Bored pile এর কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এ ছাড়া পূর্বপ্রান্তে ৫.৩৫ কিলোমিটার এপ্রোচ সড়কের কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে।

প্রকল্প পরিচালক আরো জানান, এটির পতেঙ্গা প্রান্তে Flood Gate এর কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং জি১ ও জি২ রোড এর কাজ চলমান রয়েছে। আনোয়ারা প্রান্তে ৭২৭ মিটার Viaduct নির্মাণ কাজের Substructure এর কাজ সম্পন্ন হয়েছে। Superstructure এর ২০৩ টি Pre fabricated box girder এর মধ্যে ৭৬ টির কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এটি কাজের শতকরা ৪৯.২৩ ভাগ। ইতোমধ্যে ৭২ টি Pre fabricated box girder এর প্রতিস্থাপন কাজ শেষ হয়েছে।

টানেলটির নির্মাণ কাজ শেষ হলে এটি হবে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার অন্যতম মাইল ফলক। এর কারণে পর্যটন নগরী কক্সবাজারসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাথে ঢাকা এবং চট্টগ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থা আরো সহজ হবে। ফলে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ বাড়বে। কর্ণফুলী নদীর পূর্ব প্রান্তের প্রস্তাবিত শিল্প এলাকার উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে এবং মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত চট্টগ্রাম শহর, চট্টগ্রাম বন্দর ও বিমানবন্দরের সাথে উন্নত ও সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপিত হবে। পাশাপাশি এ অঞ্চলের পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটবে। এটিকে ঘিরেও নতুন পর্যটন এলাকা গড়ে উঠবে। DPP মোতাবেক এ প্রকল্প বাস্তবায়তি হলে Financial এবং Economic IRR এর পরিমাণ দাঁড়াবে যথাক্রমে ৬.১৯ ভাগ এবং ১২.৪৯ ভাগ। তাছাড়া, Financial ও Economic “Benefit Cost Ratio (BCR)” এর পরিমাণ দাঁড়াবে যথাক্রমে ১.০৫ এবং ১.৫০। ফলে কর্ণফুলী টানেল নির্মিত হলে জিডিপিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে ।

এ টানেল চালু হলে দেশের অর্থনীতি আরও গতিশীল হবে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা। তারা মনে করেন এতে চট্টগ্রাম বন্দরের গুরুত্ব আরো বেড়ে যাবে। তবে এ টানেলের উত্তম সুবিধা পেতে যোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নয়নের উপর গুরুত্বারোপ করেন ব্যাবসায়ীরা। ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম অব বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম এর সভাপতি এস এম আবু তৈয়ব এ প্রসঙ্গে বলেন, টানেলের পূর্ণাঙ্গ সুবিধা পেতে হলে দক্ষিন চট্টগ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিস্তৃত করতে হবে, সেখানে গ্যাস, কারেন্ট ও অবকাঠামোসহ প্রয়োজনীয় সুবিধাগুলো বাড়াতে হবে। ব্যবসায় বান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

আগামী ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে। প্রকল্প পরিচালক মোঃ হারুনুর রশিদ চৌধুরী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে বলে আশা প্রকাশ করেন।

Loading