১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে নিহত সেনবাগের ৪ শহীদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি আজো মেলেনি

প্রকাশিত: ৪:০০ অপরাহ্ণ , ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০২৪

মো: আমির হোসেন লিটন,
সেনবাগ (নোয়াখালী) প্রতিনিধিঃ

গণঅভ্যুত্থানের ৫৫ বছরের ইতিহাসে আজো মেলেনি নোয়াখালীর সেনবাগের ৪ শহীদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি।
১৯৬৯’র গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল সময়ে এদেশের ছাত্র- জনতা, আবাল, বৃদ্ধ- বনিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফা এবং ছাত্রদের ১১ দফা দাবী আদায়ের সংগ্রামে যখন ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করেন, ঠিক সে সময়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ১৭ নম্বর আসামী, নোয়াখালীর কৃতি সন্তান, ফ্লাইট সার্জেন্ট জহুরুল হককে ৬৯’র ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বন্দি অবস্থায় হত্যা করেন পাক-রাষ্ট্রযন্ত্র । এ সংবাদ ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে বেগবান করে তোলে, রূপ দেয় গণঅভ্যুত্থানের। মুক্তি পাগল জনতার গণ-আন্দোলন ঠেকাতে পাক-পুলিশ গুলি চালিয়ে হত্যা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আসাদকে, ২৪ জানুয়ারি হত্যা করেন ঢাকা নব-কুমার ইনষ্টিটিউটের দশম শ্রেণির ছাত্র- মতিউর রহমানকে এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আন্দোলন থামাতে পাকপুলিশ গুলি চালিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকেই হত্যা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহাকে। পাক- পুলিশের এ বর্বরতা ও হটকারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সমগ্র জাতি এক যুগে ফুসে উঠেন। সে দিন সেনবাগবাসীও থেমে থাকেনি। ঝাঁপিয়ে পড়েন আন্দোলনে। তৎকালীন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে এবং মৌলভী দ্বীন ইসলাম, আলী আহম্মদ ভূঁইয়া, রাখাল চন্দ্র বণিক, মরহুম মোস্তফা
কামাল (নেতা কামাল) ও আ.ক.ম হাসমত উল্যাহ চৌধুরীসহ কতিপয় সংগঠক ও ছাত্রনেতার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ডক্টর জ্জোহার হত্যার পর দিন ১৯ ফেব্রুয়ারি সকাল ১১ টায় সেনবাগ থানায় কালো পতাকা উত্তোলন ও থানা ঘেরাও কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। গৃহীত সিদ্ধান্ত মোতাবেক ছাত্র-জনতা একত্রিত হতে শুরু করলে, তৎকালীন পাকপুলিশ বেপরোয়া হয়ে, জনতাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ার এক পর্যায়ে, সেনবাগ ফাযিল মাদরাসার অষ্টম শ্রেণির ছাত্র আবুল কালাম (বাবুপুর) এর তলপেটে গুলি লেগে আবুল কালাম মারা যান। আবুল কালামের মৃত্যুর সংবাদ চর্তুর দিকে ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের ন্যায় মানুষ ছুটতে থাকে সেনবাগ অভিমুখে। মানুষের ঢল দেখে পুলিশ দ্বিতীয় দফায় গুলি ছুটলে নিহত হন সেনবাগ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র খোরশেদ আলম (মোহাম্মদপুর), সামছুল হক (জিরুয়া) ও শ্রমিক আফিজুর রহমান (অর্জুনতলা)।
আহত হয় ১৫ জন। পাক-পুলিশের সেদিনের বর্বরতার তিলক ধারণ করে আজো আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন আহত মাষ্টার নাছির উদ্দিন ও জালাল আহম্মেদ (জিরুয়া)। গণঅভ্যুত্থানের সর্বশেষ আন্দোলনটি ছিলো ১৯ ফেব্রুয়ারি সেনবাগের আন্দোলন। ১৯ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের পর ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকসহ সকল কারাবন্দীকে মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তি পরবর্তী বঙ্গবন্ধু সেনবাগে আসেন এবং শহীদ অফিজুর রহমানের কবর জেয়ারত করেন। বঙ্গবন্ধু সেদিন স্বল্প কিছু সময়ের জন্য অবস্থান নেয়, পাকিস্তান সরকারের সাবেক এমএলএ ডাক্তার টি.আই.এম নুরুজ্জামান চৌধুরী পূণ্যভূমি চাঁচুয়া গ্রামের ঐতিহ্যবাহী চৌধুরী বাড়িতে।
তিনি সেদিন মূখে কোন কথা বলতে পারেননি, কারণ তাঁর মূখে জারী ছিলো ‘এবডো’ আইন।

তাই বলা চলে বাংলাদেশের বিজয় বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনার মধ্য দিয়ে এমনি এমনিতে আসেনি। বাংলাদেশের বিজয় এসেছে এক নদী রক্তের বিনিময়ে। এই বিজয় এসেছে একটি সফল গণতান্ত্রিক ও ধারাবাহিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। সে ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন জাতির
অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান কিংবা সেনবাগবাসীর আন্দোলন তারই একটি অংশ। কিন্তু
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, যাঁদের রক্তের সিঁড়ি বেয়ে জাতি আজ মুক্ত স্বাধীন, ৬৯’র পথ বেয়ে পরবর্তী ৭১’র স্বাধীকার আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা। যাঁরা স্বাধীনতার প্রথম প্রহরে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছেন জাতিকে মুক্ত করার দীপ্ত বাসনায়, আজ আমরা তাদের ভুলতে বসেছি।
মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধা মুহাম্মদ আবু তাহের (৬৯ গণ আন্দোলন কর্মী) এর প্রস্তাবে দীর্ঘ পাঁচ দশক পর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ খোরশেদ আলম খাঁন এর উদ্যােগে উপজেলা পরিষদের অর্থায়নে এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো: সাইফুল ইসলাম মজুমদারের তত্ত্বাবধানে ২০২১ সালে চার শহীদের কবর চিহ্নিত করে পাকা করা হয়।

দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেল শহীদদের আত্মদানের ৫৫টি বছর। কিন্তু কি পেয়েছে শহীদ পরিবারগুলো? আর কিবা পেল আহতের পরিবার। জাতীয়ভাবে যেমনি এদের কোন স্বীকৃতি মেলেনি, তেমনি স্থানীয়ভাবেও এর কোন প্রতিফলন দেখা যায়নি। প্রতি বছর এ দিনে আমরা নানাভাবে প্রশাসনকে জানান দিয়ে আসছি, সেনবাগের চার শহীদের নামানুসারে চারটি রাস্তার নামকরণ এবং পরবর্তী প্রজন্মের নিকট তাদের স্মৃতি ধরে রাখার স্বার্থে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের। কিন্তু শহীদদের আত্মদানের ৫ দশক পেরিয়ে গেলেও মেলেনি তাঁদের অবদানের স্বীকৃতিটুকু। যাঁদের রক্তের বদৌলতে আজ আমরা মুক্ত স্বাধীন, পেয়েছি লাল-সবুজের পতাকা, স্বাধীন দেশ, সার্বভৌমত্ব।

আজ পঞ্চম বারের মতো দেশ পরিচালনার মহান দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য তনয়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাই বঙ্গকন্যার নিকট সেনবাগবাসীর প্রাণের দাবী ৬৯’র ৪ শহীদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিসহ স্থানীয়ভাবে ১টি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ ও ৪টি রাস্তার নামকরণসহ আহত-নিহত পরিবারকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হোক। এমনটাই আশা করে সেনবাগের আপামর জনসাধারণ।

Loading