ওয়াসার লাইনে থাকবে ২৪ ঘণ্টা পানি, খাওয়া যাবে সরাসরি

প্রকাশিত: ৮:৪৬ পূর্বাহ্ণ , সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২০

ট্যাপ থেকে সরাসরি খাওয়ার উপযোগী নিরাপদ পানি সরবরাহ, রাতদিন চব্বিশ ঘণ্টা পানি প্রবাহ নিশ্চিতকরণ এবং সর্বোপরি কোটি কোটি টাকার পানি অপচয় রোধে চট্টগ্রাম ওয়াসা নগরীর সব পাইপ পাল্টানোসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। পুরো নগরীকে ১০৫টি ব্লকে ভাগ করে এই কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৫৯টি ব্লকের কাজ শেষ পর্যায়ে। শহরের বাকি এলাকাকে ৪৬টি জোনে ভাগ করে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে। এতে ২০২২ সালেই নগরীতে ট্যাপ থেকে সরাসরি পানি খাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। আর ২০২৪ সালে পুরো নগরীতেই নিরাপদ এবং সার্বক্ষণিক পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে। ওয়াসার দায়িত্বশীল একটি সূত্র এই খবর নিশ্চিত করেছে।
সূত্র জানিয়েছে, নগরীর পানীয় জলের চাহিদা হচ্ছে ৫০ কোটি লিটারের বেশি। কিন্তু চট্টগ্রামের পানি সরবরাহকারী একমাত্র প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম ওয়াসা তিনটি পানি শোধনাগার এবং গভীর নলকূপের মাধ্যমে দৈনিক প্রায় ৩৬ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করে। এরমধ্যে শেখ রাসেল পানি সরবরাহ প্রকল্প থেকে দৈনিক ৯ কোটি লিটার, শেখ হাসিনা পানি শোধনাগার প্রকল্প থেকে দৈনিক ১৪ কোটি ৩০ লাখ লিটার এবং মোহরা পানি সরবরাহ প্রকল্প থেকে ৯ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করা হয়। এছাড়া ৪৪টি গভীর নলকূপ থেকে ৩ কোটি ৭০ লাখ লিটার পানি উৎপাদন করা হয়। তবে রাঙ্গুনিয়ায় নির্মাণাধীন পানি শোধনাগারের ১৪ কোটি লিটার পানি ওয়াসার সরবরাহ নেটওয়ার্কে যুক্ত হলে চট্টগ্রামে পানির আর কোনো অভাব থাকবে না বলে প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
নগরীতে পানির উৎপাদন বাড়লেও বহু এলাকাতেই পুরোদমে পানি সরবরাহ দিতে পারছে না ওয়াসা। বিশেষ করে দীর্ঘদিনের পুরনো পাইপ লাইনের কারণে অধিকাংশ এলাকায় পানির চাপ বাড়ানো যাচ্ছে না। এতে পানি থাকলেও বিদ্যমান পাইপ লাইনে পূর্ণ প্রেসারে পানি দেয়া সম্ভব না হওয়ায় মানুষ নানাভাবে ভোগান্তিতে পড়ছে। অপরদিকে শহরজুড়ে নানা স্থানে প্রায় সময় পাইপ ফেটে যাওয়ার ঘটনায় বিপুল পরিমাণ পানি নষ্ট হয়। ওয়াসার সিস্টেম লস ২৫ শতাংশেরও বেশি বলে উল্লেখ করে সূত্র বলছে, এরমধ্যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে পানি চুরির ঘটনা ঘটলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে পানি নষ্ট হয়। শহরে প্রতি মাসে গড়ে তিনশ’টি লিকেজ হয় উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা বলছেন, এসব লিকেজ দিয়ে প্রচুর পানি নষ্ট হয়ে যায়। এসব লিকেজ মেরামত করে পানি অপচয় ঠেকাতে ওয়াসাকে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
চট্টগ্রাম ওয়াসার শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান, ১৯৬৩ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত সময়কালে স্থাপিত স্টিল ও এসবেস্টরের পাইপগুলো দীর্ঘদিনের ব্যবহারে জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। আয়রন ও ময়লা জমে বহু পাইপের অবস্থাই নাজুক। প্রাচীন প্রযুক্তিতে তৈরি এসব পাইপের অনেকগুলো জনস্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। বিশেষ করে এসবেস্টর সিমেন্ট দিয়ে তৈরি ওয়াসার পাইপগুলো জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়েছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে এসবেস্টর সিমেন্ট নির্মিত পাইপ বহু আগেই বাতিল করা হয়েছে। অপরদিকে অন্তত ৫০ বছর আগে স্থাপন করা এসব পাইপের উপর রাস্তা দিয়ে যে পরিমাণ ওজনের গাড়ি চলাচল করে তা ধারণ ক্ষমতার বাইরে। এসব পণ্য বোঝাই ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও কন্টেনার মুভারসহ ভারী পণ্য বোঝাই গাড়ি চলাচলের ফলে মাটির নিচের পাইপগুলো বাঁকা হয়ে যায়। এছাড়া অনেক সময় পানির প্রেসারেও পাইপ বাঁকা হয়ে যায়। ফলে বাঁকা পাইপে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হয় এবং অনেক সময় তা ফেটে পানি অপচয় হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, পানির প্রেসারের (হাইড্রোলিক চাপ) মেপে পাইপ বসানোর প্রযুক্তি না থাকায় ওয়াসার প্রায় সব পাইপই সক্ষমতা হারাতে বসেছে। এসব পাইপের লিকেজ দিয়ে নানা ধরনের ময়লা ও জীবাণু ঢুকে তা ওয়াসার পানি দূষিত করছে। যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম ওয়াসা চুরি ও অপচয় ঠেকানোর পাশাপাশি ট্যাপ থেকে সরাসরি খাওয়ার উপযোগী নিরাপদ পানি মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছানোর লক্ষ্যে ডিস্ট্রিক্ট মিটারিং এরিয়া (ডিএমএ) নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। এই প্রকল্পের আওতায় শহরের বিভিন্ন এলাকাকে পৃথক পৃথক ব্লকে বিভক্ত করে জোন হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। এরমধ্যে শুরুতে ৫৯টি জোনে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কাজ শুরু করা হয়। সাড়ে নয়শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্পের আওতায় শহরের হালিশহর থেকে নয়াবাজার, বড়পুল, সিডিএ আবাসিক এলাকা, গোসাইলডাঙ্গা, মাদারবাড়ি, চকবাজার, দুই নম্বর গেট, জিইসিসহ সন্নিহিত অঞ্চলকে ৫৯টি জোনে ভাগ করে ৬৩০ কিলোমিটার পাইপ লাইন পাল্টানো হয়েছে। আগামী কিছুদিনের মধ্যেই নতুন পাইপ লাইনে পানি প্রবাহ শুরু করা হবে। ৫৯টি জোনে ৫৯টি মাস্টার মিটার বসানো হবে। এই মাস্টার মিটারে ব্যবহৃত পানির অংকের সাথে এলাকার ব্যক্তিগত মিটারগুলোর পানির ব্যবহারের অংকের সাথে সমন্বয় করা হবে। এতে সিস্টেম লস কিংবা পানি চুরির ঘটনা ধরা পড়বে। সপ্তাহের সাতদিনই রাতে দিনে চব্বিশ ঘণ্টা এসব স্থানে শতভাগ নিরাপদ পানি সরবরাহ দেয়া হবে। ট্যাপ থেকে যা সরাসরি খাওয়া যাবে। তবে কোনো ভবনে যদি ব্যক্তিগত রিজার্ভারে সংরক্ষণ করে পানি ব্যবহার করা হয় সেক্ষেত্রে পানির বিশুদ্ধতার দায় ওয়াসা কর্তৃপক্ষ নেবে না।
নগরীর বিস্তৃত এলাকাকে মোট ১০৫টি জোনে বিভক্ত করে প্রথম দফায় ৫৯টি জোনে ডিএমএ বাস্তবায়ন কার্যক্রমের শেষ পর্যায়ে বাকি ৪৬টি জোনেও একইভাবে কার্যক্রম শুরু করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ৪৬টি জোনে ডিস্ট্রিক্ট মিটারিং এরিয়া (ডিএমএ) বাস্তবায়নের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। ২ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে গৃহীত এই প্রকল্পের আওতায় ৮১৪ কিলোমিটার পাইপ পাল্টানো হবে। একই সাথে মাস্টার মিটার স্থাপনসহ যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালিত হবে। পুরনো পাইপ লাইন পাল্টে একশ’ বছর আয়ুষ্কালের এইচডিপিই বা হাইডেনসিটি পলিথিন পাইপ স্থাপন করা হবে। দ্বিতীয় পর্যায়ের এই প্রকল্প বাস্তবায়নে এশিয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং বিশ্বব্যাংক অর্থায়নে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাংকের সাথে চট্টগ্রাম ওয়াসার ভার্চুয়াল মিটিংও সম্পন্ন হয়েছে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম ওয়াসার চিফ ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ মাকসুদ আলম বলেন, পানির অপচয় রোধ, নিরাপদ পানি সরবরাহ এবং সর্বোপরি রাতেদিনে পানি দেয়ার লক্ষ্যে প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছে। প্রথম প্রকল্প বাস্তবায়নের শেষ পর্যায়ে এসে আমরা দ্বিতীয় প্রকল্প হাতে নিয়েছি। প্রথম প্রকল্পের সুফল আগামী ২২ সালের জুন নাগাদ পাওয়া যাবে। ২০২৪ সালে পুরো নগরীই নিরাপদ পানির আওতায় চলে আসবে। নগরবাসী ওয়াসার ট্যাপ থেকে সরাসরি পানি খেতে পারবেন। লাইনে পানি না পাওয়ার অভিযোগও রূপকথায় পরিণত হবে।
এই ব্যাপারে গতকাল চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম ফজলুল্লাহর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রকল্প গ্রহণের কথা স্বীকার করে বলেন, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বিশাল এক কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন হতে চলেছে। আমরা নগরীর বিস্তৃত এলাকাকে ৫৯টি জোনে চিহ্নিত করে ডিস্ট্রিক্ট মিটারিং এরিয়া (ডিএমএ) করতে সক্ষম হয়েছি। ইতোমধ্যে আমাদের প্রথম প্রকল্পটির কাজ একেবারে শেষ পর্যায়ে। আমরা শহরের বাকি অংশকে অন্তভুক্ত করে দ্বিতীয় প্রকল্প তৈরি করেছি। এই দুইটি প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা চট্টগ্রাম মহানগরীতে সার্বক্ষণিক নিরাপদ পানি সরবরাহ দিতে পারব। ওয়াসার এই প্রকল্পটিকে অত্যন্ত কল্যাণমুখী প্রকল্প আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, এর মাধ্যমে শুধু নগরবাসীর পানির অভাবই ঘুচবে না; বরং ঘরে ঘরে নিরাপদ পানিও পৌঁছে যাবে। ট্যাপ ঘুরিয়ে সরাসরি পানি খাওয়ার যে সুবিধা ইউরোপ আমেরিকার মানুষ পান আমরাও সেটি পাওয়ার খুব কাছাকাছি বলে জানান এ কে এম ফজলুল্লাহ। আজাদী

 

Loading