জমে থাকা মনের কথা – প্রিয়দর্শী চাকমা

প্রকাশিত: ১২:৩৩ অপরাহ্ণ , মার্চ ২৬, ২০২৩

সবুজ গিরি প্রান্তর,আকা- বাকা বড় মাওরুম নদীর কোল ঘেষে গড়ে উঠা বহু পুরনো প্রসিদ্ধ একটি গ্রাম নাম তার “ঘিলাছড়ি”।ইহা রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার অন্তর্গত নানিয়ার চর থানাধীন ৪নং ঘিলাছড়ি ইউনিয়ন সদর এবং ৬৯ নং ঘিলাছড়ি মৌজাস্থ ঘিলাছড়ি গ্রাম।এই গ্রামে অনেক সুখ্যাতি রয়েছে বহু পুরনো একটি বর্দ্ধিষ্ণুগ্রাম হিসাবে।ভরন্ডি আদাম ঘিলাছড়ি হতে রামহরি পাড়া যাওয়ার পথে দুই গ্রামের সীমানা পাহাড়ের উপর উঠলে (গড় উগুরে) শুনা যেত নাকি ঘিলাছড়ি গ্রামের কলরবের (গোঙানির)আওয়াজ।আর যখনি অনাবৃষ্টি দেখা দিত চাকমা রাজার রাজ্যে,তখন রাজা মহাশয় খবর নিতেন ঘিলাছড়ি গ্রামবাসীরা ঠানমানা করেছে কিনা?উল্লেখ্য ঠানমানায় নাকি মহিষ জবাই করে মা গঙ্গীকে পূজা করা হতো। ঘিলাছড়ির ঠানমানা করলে নাকি আকাশে মেঘ উঠতো বৃষ্টি হতো,এমন কথা প্রচলিত আছে।এখন অবশ্য ঐসব কিছুই হয় না সবই অতীত।
তখনকার আমলে বহু আগে থেকেই এই গ্রামের মানুষ খুব সুখে শান্তিতে বসবাস করে আসছিল।মানুষের কোন অভাব অভিযোগ ছিল না। পরম মমতায় কারও কোন বিপদে সবাই একযোগে একে অপরকে সহযোগিতা করতো।গ্রামের পাড়া মুরুব্বীদের কথা সবাই মেনে চলতো।গ্রামের কোন বিশৃংখলা দেখা দিলে মুরুব্বীরা সমাধা দিতো।মুরুব্বীরা না পারলে তখন হ্যাডম্যান মহোদয় সেটা বিচার করতো।এককথায় খুব সুন্দর একটা সমাজ ব্যবস্থা ছিল।মুরুব্বীরা প্রত্যেক ঘরে২ ঘুরে বেড়াতেন এবং প্রত্যক্ষ করতেন কারো কোন সমস্যা আছে কিনা?কারোর খাদ্যের ঘাটতি দেখা দিলে তারা ঐ লোকের বাড়ী গিয়ে ধান/চালের ব্যবস্থা করে দিতো।আমার থেকে দুই বস্তা ধান নিয়ে এসো এভাবে বলে আসতো।কি সুন্দর দিন যাপন করেছিলেন তখন কার সময়ে।ছোট কালে অবশ্য আমিও কিছু২ লেজ পেয়েছি সেই সুখের দিনগুলির।
গ্রামের নাম ঘিলাছড়ি নাম হওয়ার পিছনেও একটি লোক কাহিনী জড়িয়ে আছে- বহু বহু আগের ঘটনা,আমাদের গ্রামের অর্থাৎ ঘিলাছড়ি গ্রামের দেওয়ান পরিবারের “বুড়ি মা”তার সুন্দরী যৌবনা নাতিনীকে নিয়ে ঘিলাছড়ি নদীতে মাছ কাঁকড়া আহরণ করতে যায়।মাছ কাঁকড়া ধরতে২ অনেক দূর পর্যন্ত যায়।তখনকার সময়ে অনেক ঝাড়-জঙ্গল নিবিড় বন ছিল।হঠাৎ একপর্যায়ে মাছ কাঁকড়া ধরতে২ তার সুন্দরী নাতনীর গাছ-পালার উপরের দিকে হঠাৎ চোখ যায়,তখন দেখেন ছাতার মতো বিরাট একটা ফুল।নাতনী তখন তার নানুকে বলে দেখ২ নানু কত বড়ো একটা ফুল ফুটে রয়েছে।কিন্ত বুড়ি মা সুন্দর করে বার২ তাকানোর পরেও কোন ফুল দেখতে পেলো না।অথচ নাতনী দেখে সে দেখে না।তখন বুড়ি মা তার নাতনীকে বলে ভেদোবি,তুমি খুব ভাগ্যবান তুমি ঘিলাফুল দেখেছো।তোমার রাজ ঘরে বিয়ে হবে।ঠিকই নাকি বুড়ি মার নাতনীর রাজবাড়ীতে বিয়ে হয়েছে এবং গ্রামের নাম ঘিলাছড়ি হয়।তখন থেকেই নাকি চাকমা রাজপরিবারের সাথে ঘিলাছড়ির হ্যাডম্যান দেওয়ানদের খুবই ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে উঠে।
যদিও গ্রামের নানামুখী সুনাম ছিল কিন্ত শিক্ষার ক্ষেত্রে গ্রামের মানুষ অনেক পশ্চাদপদ ছিল,তখনকার সময়ে যারা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছিল তারা সবাই রাউজান,রাঙ্গুনীয়া,রাঙ্গামাটি সদর এবং খাগরাছড়ি গিয়ে পড়াশুনা করেছিল।কারণ একাকায় কোন উচ্চবিদ্যালয় ছিল না।বহু কষ্ট করে শিক্ষা অর্জন করতে হয়েছে।ক্রমান্বয়ে অনেকে শিক্ষিত হয়েছে বটে কিন্ত গ্রামে একটা হাইস্কুল প্রতিষ্ঠার কথা কারোর মাথায় আসেনি।আমাদের সময়েও আমরা অনেক কষ্ট করে ৫/৭কিলোমিটার পথ পায়ে হেটে বর্ষাবাদল উপেক্ষা করে ছোট মহাপূরম এবং বড় মহাপূরম স্কুলে গিয়ে পড়াশুনা করে এসেছি।অনেক কষ্টের বিনিময়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করেছি।
যখনি হাইস্কুল লেভেলে পড়াশুনা করি তখন থেকেই স্বপ্ন দেখতাম বড় হলে আমাদের ঘিলাছড়িতে একটা হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করবো।স্বপ্নটি কারোর কাছে প্রকাশ করিনি তখন, যত্নে লালন করেছি মনের গহিণে।আস্তে২ স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদানের জন্য তৈরী করতে থাকি নিজেকে।একধাপ,দুইধাপ এভাবে অগ্রসর হতে থাকি।১৯৯১ সালে বড় মহাপূরম উচ্চবিদ্যালয় থেকে মেট্রিক,১৯৯৩ সালে নোয়াপাড়া ডিগ্রী কলেজ থেকে ইন্টার মেডিয়েট,এবং ১৯৯৫ সালে ইমাম গাজ্জালী ডিগ্রী কলেজ থেকে বি,এ পাশ করি।তখন চিন্তা করি এই বুঝি মোক্ষম সময় স্কুল করার।কলেজে পড়াকালীন সময়ে সামিল হই পাহাড়ীদের স্বাধীকার আদায়ের আন্দোলনে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্রপরিষদের পতাকা তলে।১৯৯৪ সালের কথা আমাদের ঘিলাছড়ি গ্রামের প্রথম বি,এ পাশ করা উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তির সাথে আলাপ করি (যিনি বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন প্রধান শিক্ষক)ঘিলাছড়িতে একটি জুনিয়র হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করার জন্য।আমি ভেবেছিলাম উনি যেহেতু গ্রামের প্রথম বি,পাশ করা ব্যক্তি উনার কাছ থেকে হয়তো সহযোগিতা পাবো।কিন্ত দুঃখের বিষয় উনি আমাকে উৎসাহের পরিবর্তে নিরাশই করলেন।তিনি আমাকে বললেন- “প্রিয়দর্শী” তুমি কি মনে কর আমি জুনিয়র হাইস্কুলে চাকুরী করেছি,স্কুল করা এতো সহজ ব্যাপার নয়।চুপচাপ থাকো,চোখে পহ্ র দেখছো পারবা না।তখন আমি বলেছিলাম “কাকা”আমরা তো চেষ্টা করে দেখতে পারি।উনি বললেন না দরকার নাই পারবা না।
আমি অবশ্যই সেদিন মনে২ অবাক হয়েছিলাম,গ্রামের উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তির এমন কথা শুনে।আমি অবশ্য পিছু হটিনি,দমিয়ে যায়নি,দমানোর পাত্রও আমি নই স্কুল প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে। উনার এমন কথা শুনার পরেও আমি স্কুল প্রতিষ্ঠা করার জন্য কাজে হাত দিলাম। ছাত্র পরিষদের সহকর্মীদের নিয়ে পার্শ্ববর্তী ঘিলাছড়ি,চৌধুরীছড়া,বামে বগাছড়ি,নাঙেল পাড়া,চৈ ছড়ি,কলক পাড়া,পুকুরছড়ি,ভুইয়ো আদাম গ্রামে সাংগঠনিক সফরে যাই, ঘিলাছড়ি স্কুল করার জন্য সকল গ্রামবাসীদের নিকট প্রস্তাবনা দিই সেদিন সকলেই আমাকে সাপোর্ট দিয়েছিল স্কুল করার জন্য আমি আরও দ্বিগুণ উৎসাহী হলাম এলাকাবাসীর সাপোর্ট পেয়ে।
১৯৯৪ সালের কথা- পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ নানিয়ার চর থানা শাখার নেতৃবৃন্দ ০৯/০৯/১৯৯৪ ইং শুক্রবার ঘিলাছড়ি আসলে ঘিলাছড়ি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক গণসংযোগ সভার আয়োজন করা হয়।ঐ সভাতেই আমি উপস্থিত গণ্যমান্য ব্যক্তি ও গ্রামবাসীর সামনে ঘিলাছড়িতে জুনিয়র হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করার জন্য উপস্থাপনায় প্রস্তাব পেশ করি।উক্ত সবায় উপস্থিত সবাই আমার উদ্যোগকে সাধুবাদ দিয়ে স্বাগত জানায় এবং নানিয়ার চর পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের নেতারা আশ্বাস দেন যে,আমরা স্কুল করলে তারা শিক্ষক দিয়ে দিবেন।তখন আমি বলেছিলাম- ঠিক আছে আমরা স্কুল করবো,কিন্ত স্কুলের জন্য তো একটা জায়গা লাগবে।কোথায় করবো স্কুলটা,কে জায়গা দিবে? তখন উক্ত সভা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে মি. চন্দ্র নীল চাকমা( আমার কাকা হন) বলেন- ভেইপুত আমরা দেবো জায়গা স্কুল করেন।কোথায় দিবেন জানালে বর্তমানে স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত জায়গাটির কথা বলেন।
যেই কথা সেই কাজ।গ্রামবাসী এবং এলাকাবাসী মিলে জায়গা পরিস্কার করে মাটি কেটে গাছ বাঁশ সংগ্রহ করে তড়িঘড়ি স্কুল ঘর নির্মাণ করা হয়১৯৯৪ এর শেষান্তে।১৯৯৫ ইং সন থেকে ০৯/০১/১৯৯৫ তারিখ থেকে ছাত্র/ছাত্রী ভর্তি কার্য্যক্রম শুরু হয় এবং ২০/০৩/১৯৯৫ ইং থেকে ছাত্র/ছাত্রীদের পুরোদমে ক্লাশ চালু করা হয়।যাতে আমরা শিক্ষক হিসাবে ৩ জন ছিলাম।প্রধান শিক্ষক তাপস ত্রিপুরা,সহকারী প্রধান শিক্ষক আমি প্রিয়দর্শী চাকমা ও সহকারী শিক্ষক নির্মল কান্তি চাকমা প্রমুখ।আমাদের তিন শিক্ষকের ঐকান্তিক ও নিরলস প্রচেষ্টার ফলে দক্ষ পাঠদানের মাধ্যমে স্কুলের ছাত্র/ছাত্রীরা যোগ্য ছাত্র/ছাত্রী হিসাবে গড়ে উঠতে থাকে এবং দিনে২ ছাত্র/ছাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
এভাবে দুই দুইটি বছর ১৯৯৫-১৯৯৬ অতিক্রান্ত হয়ে গেলো।এভাবে আস্তে২ বাস্তবায়ন হতে চললো আমার দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্ন।পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালের প্রথমান্তে আমি অন্য এক উদ্দেশ্য নিয়ে বিদ্যালয় থেকে ইস্তফা দিই,আমার প্রাণ প্রিয় ছাত্র/ছাত্রী,এবং শিক্ষকেরা জেনে গেছে আমি চলে যাবো।শিক্ষক এবং ছাত্র-ছাত্রীরা স্বল্প পরিসরে বিদায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।সেদিন ছিল ০৩/০২/১৯৯৭ ইং আমরা সকল শিক্ষক তাড়াতাড়ি শ্রেণী কক্ষের পাঠদান শেষ করি অনুষ্ঠান শুরু করার জন্য।তৎমুহুর্তে স্কুলে আসলেন ঘিলাছড়ি আর্মী ক্যাম্পের জৈনিক অধিনায়ক ক্যাপ্টেন ইমরান সাহেব।আমরা উনাকে অফিস রুমে বসালাম এবং বিভিন্ন গল্প বলা কথাবার্তা শুরু করি।শিক্ষকেরা মনে মনে চিন্তা করতেছেন উনি কোন জেনে গেলেন নাকি আমার চলে যাওয়ার কথা।পরে অবশ্য গল্প গুজব করে ক্যাম্পে চলে যান।আমরা তখন বিদায় অনুষ্ঠান পর্ব শুরু করি।
সেদিনের বিদায় লগ্নের ক্ষণটি এখনও আমার চোখের সামনে ভেসে উঠে।যাহা কখনও ভূলতে পারবো না।সকল ছাত্র-ছাত্রী আমাকে পায়ে ধরে সালাম করে অশ্রুসজল নয়নে বিদায় জানায়।আমিও সেদিন প্রাণ খুলে আর্শীবাদ করেছিলাম তাদের কোন রকম নিজেকে সামলে নিয়ে।শুরু হল আমার আরও এক নতুন অজানা, অচেনা পথে পথ চলা সংগ্রামী জীবনের সম্পুর্ণ নতুন অধ্যায়।অবশ্য এক বছরের মধ্যে আবার ফিরে আসি নিজ মাতৃভূমির কোলে।রাজনৈতিক কারণে প্রধান শিক্ষক তাপস ত্রিপুরা দা এ্যারেস্ট হলে স্কুলটি একটু নড়েবড়ে হয় ফলে এলাকাবাসী আবারও আমাকে স্কুলের শিক্ষক হিসাবে পেতে চায়। পরবর্তীতে স্কুল পরিচানলা কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক স্কুলের হাল ধরতে শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করি।
আর হ্যাঁ একটি কথা না বললে নয়, স্কুলের কাজ শুরু থেকেই যারা একনিষ্ঠ ভাবে সাহায্য সহযোগিতা করে কায়িক,মানসিক,আর্থিক ভাবে শ্রম দিয়েছেন, তাদের মধ্যে -১।নিহার বিন্দু চাকমা(বাজার চৌধুরী),২।শান্তি ময় দেওয়ান ও ৩।বিমল কান্তি চাকমা প্রমুখ।অবশ্য পরবর্তীতে শান্তি ময় দেওয়ান ও বিমল কান্তি চাকমা কার্য্যক্রম থেকে নিষ্ক্রীয় হয়ে যান।কিন্তু নিহার বিন্দু চাকমা আমার বড় ভাই (বাজার চৌধুরী)শুরু থেকে বর্তমান পর্যন্ত স্কুলের পিছনে তার জীবনের মহা মূল্যবান সময় ব্যয় করে চলেছেন,যা সত্যিই প্রসংশনীয়।কাজের শুরুতে উনাকে না পেলে হয়তো এতোদূর আসতে আরো অনেক বেগ পেতে হতো।আমি অশেষ কৃতজ্ঞ আমার বড় ভাই বাজার চৌধুরীর প্রতি।ভগবানের কাছে তার দীর্ঘায়ু ও মঙ্গল কামনা করছি।
ঘিলাছড়ি হাইস্কুলটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই একটি মহল উঠে পড়ে লেগে যায় বিদ্যালয়টি অন্যত্র স্থাপন করার জন্য।ঘিলাছড়ির ইউ/পির তখনকার সময়ে চেয়ারম্যান বাবু তীর্থ কুমার চাকমার নেতৃত্বে গোপনে এলাকা বাসীর নিকট থেকে গণ স্বাক্ষর অভিযান শুরু করেন -বাবু কালো চিজি চাকমা ও অক্ষয় ময় চাকমা স্কুলটি পুকুর ছড়ি গ্রামে স্থানান্তর করার জন্য।ন্যায়ের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র কখনও সফল হয় না।তেমনি তাদের অভিযান ও সফল হয় নি।সুভাগ্য আমার সেদিন ১৪/১০/১৯৯৫ ছাত্র পরিষদের জরুরী কাজে রাঙ্গামাটি গিয়েছিলাম।ফেরার পথে বিশেষ কাজে কুতুক ছড়ি বাজারে নামি এবং করুণা কান্ত চাকমা (সাবেক ৪নং ঘিলাছড়ি ইউপি চেয়ারম্যান বর্তমানে নানিয়ারচর উপজেলা চেয়ারম্যান)দোকানে বসি।বসে দেখি একটা ডায়েরী ভিতরে কিছু কাগজ।হাতে নিয়ে দেখি বিপরীত কান্ড সাথে২ গণস্বাক্ষরের কাগজ গুলি আমার ঝোলার মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলি এবং আবার রাঙ্গামাটি চলে যায়।সমস্ত কাগজ পত্র কয়েক কপি করে ফটো কপি করি, পরের দিন স্কুলে এসে স্কুল কমিটির লোকদের ডেকে বিষয়টি অবহিত কর।সাথে পাহাড়ী ছাত্রপরিষদ নেতা অমর জীবন চাকমা এবং অভিলাষ চাকমাকে জানাই।জে,এস,এসের নিম্ন থেকে উচ্চ স্তর পর্যন্ত এক কপি করে প্রেরণ করি এবং দ্রুত এ্যাকশন হয়,জে এস,এস হাই কম্যান্ড থেকে নির্দেশ আসে স্কুলটি যেখানে আছে সেখানে থাকবে।এভাবে স্কুলটিকে কঠোর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ঠিকিয়ে রাখি।
পরবর্তীতে তাপস ত্রিপুরা দাদা কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর স্কুল থেকে চলে গেলে স্কুল কমিটি আমাকে প্রধান শিক্ষক মনোনিত করেন এবং কিছুদিন দায়িত্ব পালন করি।
এলাকা বাসী এবং আমার বিচক্ষণতার প্রতিরোধের মুখে তীর্থ বাবুর ষড়যন্ত্র সেদিন সফল হয়নি।এলাবাসীর ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টাই স্কুলটি ঘিলাছড়ি সদরেই প্রতিষ্ঠা লাভ করে।পরবর্তীতে আমরা ০৮/০৮/১৯৯৯ ইং ঘিলাছড়ি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় উন্নয়ন কল্পে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড চেয়ারম্যানের নিকট আবেদন করা হয় এবং ২৯/১২/১৯৯৯ ইং পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের মাননীয় ভাইস চেয়ার ম্যান বাবু তারা চরণ চাকমা ঘিলাছড়ি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং বিদ্যালয় ভবন নির্মাণের জায়গা পরিদর্শন করেন।উনার অনুদানে বর্তমান স্কুল ভবনটি নির্মিত হয়েছে।আমি ব্যক্তিগত ভাবে এবং ঘিলাছড়ি এলাকা বাসী বাবু তারা চরণ চাকমার কাছে চির কৃতজ্ঞ।উনার পদধূলি পড়ে বিদ্যালয়টি ভবনে রূপান্তরিত হয়েছে।আজ আমি নিজেকে খুব গর্বিত মনে করি ঘিলাছড়ির একজন সন্তান হিসাবে।এলাকার ছেলে মেয়েরা এখন আর আমাদের মতো কষ্ট করে শিক্ষা অর্জন করতে হচ্ছে না।সবাই এখন বাড়ীর ভাত পানি খেয়ে এস,এস,সি পাশ করতে পারছে,এটাই ছিল আমার স্বপ্ন,এটাই আমার আনন্দ,এটাই আমার খুশী এটাই ছিল আমার চাওয়া এবং পরম পাওয়া মনের ভিতর লালন করার স্বপ্ন আজ বাস্তবে রূপদান করতে পেরেছি।
সেই ১৯৯৫-২০২৩ ইং ২৮ আটাশশ বছরের মধ্যে কি আমূল পরিবর্তন ঘটেছে।যেই গ্রাম এবং এলাকায় একসময় উচ্চশিক্ষিত লোকের খুব অভাব ছিল,সেই গ্রাম এবং এলাকা এখন কি রাতারাতি পরিবর্তন হয়ে গেলো শিক্ষা-দীক্ষায়।গ্রামের এবং এলাকার প্রতিটি ঘরে২ মেট্রিক,আই,এ এবং বি,এ পাশ করা ছেলে-মেয়ে হরহামেছা চোখে পড়ে।অনেকে সরকারী ও বেসরকারী বিভিন্ন দপ্তরে চাকুরীতে নিয়োজিত রয়েছেন।তবে হ্যাঁ সেদিন যদি আমি আমার সেই কাকার কথায় দমিয়ে যেতাম স্কুল প্রতিষ্ঠার কথা না ভাবতাম তাহলে আমরা সত্যিই আরো ২৮ বছর পিছিয়ে পরে থাকথাম।
এখন এক অভাবনীয় পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।আসলে সত্যিই আনন্দ লাগে গ্রামের শিক্ষিত ছেলে মেয়েদের দেখলে।এগিয়ে যাও তোমরা নবীনের দল,বদলিয়ে দাও গ্রাম আর এলাকার পরিবেশ।বর্তমানে স্কুলে কর্মরত সকল সহকারী শিক্ষক এবং প্রধান শিক্ষক মহোদয়কে অনুরোধ করবো প্রতিষ্ঠানটি একান্ত নিজের মনে করে তারা যেন ছাত্র/ছাত্রীদের দক্ষ করে গড়ে তোলার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যান।কারণ উনারাই হচ্ছেন মানুষ গড়ার নিখুঁত কারিগর,তারাই পারেন সমাজ,দেশ,জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে।
আমাদের অবশ্যই যার যার অবস্থান থেকে যে যেভাবে পারে সমাজ উন্নয়ন,শিক্ষা বিস্তার, ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং মানবিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রাখতে হবে। সমাজকে বদলে দিতে হলে সকলকেই কাজে নেমে পড়তে হবে লেগে থাকতে হবে তবেই আমরা সাফলতার স্বাদ গ্রহণ করতে পারবো। আমিও এভাবে স্কুল করার স্বপ্ন দেখতাম না যদি না আমার ৬/৭ কিলোমিটারের পথ পায়ে হেটে স্কুলে যাওয়া লাগতো না। সেই দুঃখ কষ্টের বোঝা থেকেই আমার মনে দৃঢ় প্রত্যয় চেপে বসেছিল আমার এলাকায় স্কুল করার জন্য এবং সেটা বাস্তবে রূপদান দিতে সক্ষম হয়েছি প্রচেষ্টায় অটল ছিলাম বলে।
আমাদের প্রত্যেককে সাথে নিয়ে বাঁচতে হবে। শুধুই একাই ভাল থাকবো অন্যের ভালমন্দ দেখবো না এমন হলে চলবে না সেটা মানবতা নয়। আজ যদি আমি ভাল কাজ না করি আমার পরবর্তী প্রজন্ম ভাল কাজ করবে না কারণ তারা অনুকরণ করার কিছুই পাবে না। আর আমি যদি ভাল কাজ করি আমার সেই ভাল কাজগুলি তারা ফলো করবে নিশ্চই অনুপ্রাণিত হবে তারাও ভাল কিছু করার চেষ্টা করবে। আমি সময় সুযোগ পেলে ভাল কিছু করার চেষ্টা করি। প্রতিবছর পিতৃ মাতৃহীন শিক্ষার্থীদের কলেজে ভর্তি করিয়ে দিই। অনেক বিত্তহীন অসহায় রোগীর পাশে দাঁড়িয়েছি, কতো রোগীর জন্য লিখে লিখে মানুষের কাছে হাত পেতেছি।মানুষ আমাকে হতাশ করেনি কারণ আমি সবসময় স্বচ্ছতা বজায় রেখেছি ফলে মানুষের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছি।
বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনায় পঙ্গু শিশু অটল চাকমাকে একটা ভবিষৎ তহবিল ক্রিয়েট করে দিয়েছি বর্তমানে তার তহবিলে দেড় লাখের মতো টাকা জমা হয়েছে। অটলের জন্য অনেকে লেখালেখী করেছে কিন্তু তার ভবিষ্যতের কথা কেউ চিন্তা করেনি তাই আমরা ৫ জন লোক মিলে তহবিল সংগ্রহ করতে থাকি এবং সফলও হয়েছি।এগুলি করার অর্থ এই নয় যে যে আমি সুনামের জন্য করি। আমার লক্ষ্য হলো সমাজকে বদলে দেওয়া মানুষকে শিখানো দেখানো কিভাবে কি করলে মানুষের মঙ্গল হয়, সমাজের মঙ্গল হয়, শিক্ষা বিস্তারে সহায়ক হয়। আজ আমাকে তরুণ ও বর্তমান প্রজন্মের অনেকে ফলো করেন তারাও আমার মতো করে কাজ করে যাচ্ছেন, অসহায় রোগীদের চিকিৎসা করছেন,গরীব ছাত্রদের সহযোগিতা দিচ্ছেন, মানবতার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন অবিরত। আমি কখনও হতাশ কিংবা নিরাশ হই না আমি সবসময় বুকে আশা বাধি, স্বপ্ন দেখী, পরিবর্তনের পাল্লাটা সবসময় ভারী রাখি।
সামাজিকতার পাশাপাশি আমি ধর্মকেও অন্তরে লালন করি সময় সুযোগ হলে মহাপুরুষদের দর্শনে কখনও পিছপা হইনা। পৃথিবীতে যখনি অনাচার,দূরাচার বেড়ে যায় তখনি কিন্তু মহা মনবদের আর্বিভাব হয়। আমাদের পাহাড়ের দিকে তাকালে আমারা আয়নার মতো পরিস্কার করে দেখতে পায় পরম পূজ্য বনভান্তের হিতোপদেশে কিভাবে পাহাড়ে অন্ধকারময় কুসংস্কার গুলি নির্মুল হয়েছিল এটা এক বিরাট পরিবর্তন। আজ তারই শিষ্য মন্ডলীর প্রধান ভদন্ত পূজনীয় নন্দপাল ভান্তে মহোদয় যেভাবে দেশে বিদেশে তার ধর্মীয় অমূল্য সূধা বিলিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন তা আমাদের পার্থিব জীবনে মহা ফলদায়ক হচ্ছে।যারা পূজনীয় ভান্তের হিতোপদেশ মেনে চলছেন তারা সকলেই ভাল আছেন এটা একবাক্যে সকলেই স্বীকার করবেই যারা শ্রদ্ধের ভান্তের ভক্ত অনুরাগী পূজারী আছেন। ব্যক্তিগতভাবে আমিও ভান্তের একজন ভক্ত পূজারী নিসন্দেহে পূজনীয় ভান্তের আশীর্বাদে আমিও অনেক অনেক ভাল আছি। এবারে আমাদের ভারত বাংলার পাহাড়ের আলোকবর্তিকা পূণ্য পুরুষ পূজনীয় নন্দপাল ভান্তের ৭১ তম জন্মদিনে প্রতি বছরের মতো একটি উজ্জ্বল স্মারক গ্রন্থ প্রকাশ হচ্ছে জেনে আমি অনেক আনন্দিত। এভাবে আমাদের মহাপুরুষদের স্মরণীয় বরণীয় করে রাখতে হবে তাদের স্মণের মধ্য দিয়ে। পরিশেষে পূজ্য বনভান্তের যোগ্য উত্তরসুরী পূজনীয় নন্দপাল ভান্তে মহোদয়ের দীর্ঘ জীবন কামনা করছি। বুদ্ধ শাসনে নিরাপদে নির্ভয়ে ধর্মদান, পূণ্যদান অভয়দানের কাজগুলি সুচারুভাবে করে যেতে পারে মহা কারুণিক তথাগতের কাছে প্রার্থনা নিবেদন করছি, জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক ## প্রিয়দর্শী চাকমা(পুলিশ ইন্সপেক্টর বাংলাদেশ পুলিশ)

Loading