বিজয় মাসে বিনয় ধারণা

মুক্তিযুদ্ধের কিছু কথা, কিছু স্মৃতি

প্রকাশিত: ৬:৩২ অপরাহ্ণ , ডিসেম্বর ৫, ২০২২
মইনুদ্দীন কাদেরী শওকত
ডিসেম্বর মাস আমাদের বিজয়ের মাস। ১৬ই ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস। এই মাসে আমরা গর্বের সাথে স্মরণ করি দেশের স্বাধীনতার জন্য, গণতন্ত্রের জন্য যাঁরা শাহাদাৎ বরণ করেছিলেন। পাকিস্তানের শোষণ থেকে দেশকে মুক্ত করার এবং গণতন্ত্র কায়েমের স্বপ্ন চোখে নিয়ে হাসিমুখে যাঁরা জীবন দিয়েছিলেন, সর্বস্ব হারিয়েছিলেন এবং যাঁরা পঙ্গু জীবনযাপন করেছেন। ব্যাথায় ও শ্রদ্ধা তাঁদের আত্মত্যাগের গর্ব নিয়েই আমাদের চাওয়া ও পাওয়ার হিসাব-নিকাশ মিলিয়ে নিতে হবে।
সে দিন আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং ভারতসহ যে সকল দেশ সাহায্য করেছিল, তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার লক্ষ্য ও আদর্শ ছিল বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা। কারো করুণা বা প্রলোভনের নিকট আত্মবিক্রি নয় বা কারো ভ্রু-কুটির ভয়ে নতশির বিকৃত জীবনযাপন নয়।
স্বাধীনতার ৫০ বছরের পথ পরিক্রম করতে গিয়ে আজ দেখছি, স্বাধীনতা যুদ্ধে সাহায্যদাতা ভারত গুপ্ত নখদন্ত বিকাশ করে আমাদের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে তাদের করুণার উপর নির্ভর করে রাখতে চেয়েছে। বাংলাদেশ থেকে ভারত এ পর্যন্ত নিয়েছে অনেক অনেক সুবিধা- দেয়নি উল্লেখযোগ্য কিন্তু।
আজ ৫০ তম বিজয় দিবসে দাঁড়িয়ে দুঃখ, ব্যাথা ও ক্ষোভে লক্ষ্য করছি, যে অর্থনৈতিক শোষণ, অবিচার হতে মুক্তি এবং গণতন্ত্রের জন্য আমাদের বীর সন্তানরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিল, আজ স্বাধীন বাংলাদেশে সেই গণতন্ত্র নির্মমভাবে শৃঙ্খলিত এবং অর্থনৈতিক শোষণ বন্ধ হয়নি- শোষণের কেন্দ্র পরিবর্তন হয়েছে। এই পরিবর্তনের জন্য আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণ বিসর্জন দেননি, আমরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করিনি। শোষণ মুক্তি ও গণতন্ত্রের জন্যই আমরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম।
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত একটা দেশের সংবিধান। সেই সংবিধানের করুণ ইতিহাস এবং তার সে তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে। আজ স্বাধীন বাংলাদেশে সংবিধান ক্ষমতার মুষ্টি নিপীড়নে বিবর্ণ, মুচ্ছিতবৎ। সংবিধান লঙ্ঘন ও সে দিনের সেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে আমাদের ব্যাপক গণআন্দোলন ও কর্মপন্থার প্রতি উপেক্ষা করে যারা ক্ষমাসীনদের কথায় মুগ্ধ হয়ে রাজনৈতিক ভ্রষ্টাচারের শিকার হয়েছিলেন, আজ সেই বিপদ শতবাহু প্রসারণে গণতন্ত্রের সামান্য বাতাবরণ ধ্বংস করতে উদ্যত। গণতান্ত্রিক রীতি নীতির প্রতিফলন ঘটে সংবিধানের লক্ষ্য ও আদর্শের মধ্যে যখন সেই সংবিধানে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ক্ষমতার সীমা ও জনগণের অধিকারের নিশ্চয়তা নির্দিষ্ট থাকে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বিশেষ সুযোগ-সুবিধার যে অধিকার, সেই ক্ষমতা বলে সংবিধান অনুযায়ী গৃহীত আইন কার্যকর করার দায়িত্ব সরকারি আমলাদের। সামরিক বাহিনী ও সরকারি আমলারা সংবিধানের রীতিনীতি ও আইনের রক্ষক।
পৃথিবীর যে কোন গণতান্ত্রিক দেশে সামরিক বাহিনীর কোন কর্মকর্তা নির্বাচিত প্রতিনিধির সাথে রাজনৈতিক বিতর্কে লিপ্ত হলে তাকে কাল-বিলম্ব না করে অপসারণ করা হয়। ১৯৬২ সালে চীন-ভারত সীমান্ত যুদ্ধের সময় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী কৃষ্ণ মেনন ও সেনাপ্রধান থিমিয়ার মতবিরোধ হয়। এজন্য শেষ পর্যন্ত থিমিয়াকে বিদায় নিতে হয়। কোরিয়া যুদ্ধের সময় মার্কিন সেনাধ্যক্ষ জেনারেল ম্যাক আর্থারকে যুদ্ধের নীতি-নির্ধারণী বক্তব্য দেবার কারণে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের সাথে তার মতবিরোধের পরিণতির জন্য দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ফিলিপাইনে তার বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের গৌরব রক্ষাকবচ হয়ে দাঁড়ায়নি। সাংবিধানিক মর্যাদা রক্ষার এই পূর্বশর্তের জন্যই ভারতে আইনের প্রতি, জনপ্রতিনিধিদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি আনুগত্যের ট্রাডিশন ছিল।
আর আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সমগ্র জাতির শ্রদ্ধার সুযোগ নিয়ে মুষ্টিমেয় পথভ্রষ্ট, লক্ষ্যভ্রষ্ট ও ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা লুটতরাজ, রাষ্ট্রীয় অর্থ লোপাটসহ সমাজবিরোধী কাজে লিপ্ত হয়। তাদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে একশ্রেণীর নীতিজ্ঞান শূন্য রাজনৈতিক নেতা নিজেদের হীনস্বার্থ উদ্ধার করেছে। শুধু তা নয়, এভাবে তারা মুক্তিযুদ্ধকে হেয় করার অপচেষ্টা করেছে। যারা অস্ত্র হাতে নিয়ে স্বশস্ত্র হয়ে পাক হানাদার এবং তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন- তারাই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। ভারতীয় তালিকাভুক্ত সকলেই মুক্তিযুদ্ধ করেনি। আবার ভারতে না গিয়ে দেশে প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেক যুবক মুক্তিযুদ্ধ করেছে। ভূয়া সুবিধাভোগী ও স্বার্থান্বেষীদের কারণে অপরাধ উৎসাহিত হয়ে সমাজ জীবনের স্তরে স্তরে দুর্নীতি ও ক্ষমতার লোভ দুর্নিবার করে তুলেছে। স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছরে ক্ষমতার কাড়াকাড়ি ও উচ্ছিষ্ট ভোগীদের কদর্য কলহের মধ্য দিয়ে দুর্নীতির পঙ্কিল স্রোতে লোক একশ্রেণীর অবগাহন করেছেন। গণতন্ত্রের ভক্তি-বিলাসের গদ গদ কণ্ঠের আবেদন এখন আর কারো মন কাড়তে পারছে না। চরিত্র ভ্রষ্ট কিছু রাজনীতিক ও উর্দি পরা গণতন্ত্রের প্রবক্তারা স্বাধীনতাকে উপহাসের বস্তুতে পরিণত করেছিল।
সত্যিকার সংসদীয় গণতন্ত্র এবং অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রভাবমুক্ত নির্বাচন ব্যতীত জনগণের শক্তি ও আত্মবিশ্বাস ফিরানো সম্ভব নয়। এক ব্যক্তির স্বৈরশাসন দেশের স্বাধীনতার ভিত দুর্বল করে তোলে এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ছত্রছায়ায় গদি রক্ষার জন্যই সার্বভৌমত্ব বিকাইয়া দিয়ে থাকে।
এবারের বিজয় মাস দেশের যুব সমাজের কাছে নিষ্ঠা, ত্যাগ আর তিতিক্ষার দাবি নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের রক্তের সাথে এদেশের মানুষ বিশ্বাস ঘাতকতা করতে পারে না। ৫০ বছর আগে এদেশের ছাত্র-যুবকরাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করে রক্ত দিয়ে একটি স্বপ্ন বুকে লালন করেছিল। সেই স্বপ্নের ফুলটি আজ বিরংসাগ্রস্থ লোলচর্ম বৃদ্ধের করতলে পিষ্ঠ। ইদানিং একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, ১৯৭১ সালের প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তরুণ প্রজন্মের অনেকেই ‘রাজাকার’ বলে আখ্যায়িত করতে অপচেষ্টা চলাচ্ছে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা পরস্পর পরিচিত। শত বিরোধ থাকলেও তাঁরা একজন অন্যজনকে ‘রাজাকার’ বলে না। রাজাকারের সন্তানরাই মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের নামে সংগঠন করে মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান দেখানোর ধৃষ্ঠতা দেখাচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এবার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা ও মুক্তিযুদ্ধের কিছু স্মৃতি সম্পর্কে সংক্ষেপে বলতে চাই।
বর্তমান মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধাদের নতুন করে আরেকটি তালিকা তৈরি করার জন্য উদ্যোগ নিচ্ছেন বলে জানা যায়। বার বার এ ধরণের তালিকা করে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সত্যিকারভাবে সম্মান দেয়ার না অপমান করার উদ্যোগ। এ ব্যাপারে অনেক মুক্তিযোদ্ধা মতামত আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছে ক্ষোভ ও অসন্তোষ। ২০০৮ সালে মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান ও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ১নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর (অব:) রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম এক সভায় বলেছিলেন, বিভিন্ন কারণে অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ভাতা নেয়ার জন্য তালিকাভুক্ত হননি।
মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ১৯৯৬ সালে ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব, ২০১৪ সালে চট্টগ্রাম সাংবাদিক কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ২০১৬ সালের ২৬ ডিসেম্বর বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এবং বিভিন্ন সংগঠন বিভিন্ন সময়ে সংবর্ধনা প্রদান করে। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি ব্যক্তিগতভাবে মুক্তিযোদ্ধাভাতা নিই না। বরং বিশ্বাস করি, ‘মুক্তিযোদ্ধারা টাকার জন্য যুদ্ধ করেননি, ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য যুদ্ধ করেননি- জীবন বিসর্জন দেননি। সেদিন লক্ষ্য ছিল একটাই স্বাধীনতা। স্বাধীনতা পেয়েছি, দেশ পেয়েছি- আর কি?
মুক্তিযুদ্ধের সময় যাঁদের সঙ্গী ছিলাম তাঁদের অন্যতম জাসদ নেতা অ্যাডভোকেট আবু মোহাম্মদ হাশেম ভাই, আওয়ামী লীগ নেতা কামাল উদ্দিন চৌধুরী, অ্যাডডভোকেট ইফতেখার উদ্দিন, জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দল চট্টগ্রাম মহানগরের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সনওয়ার আলী সানুসহ অনেকে একসাথে ছিলাম। পরবর্তীতে সকলে এক দলের রাজনীতি করেননি। মুক্তিযোদ্ধারা সকলে এক জায়গায়, একদলে নেই। তবে পরস্পরের সাথে সম্পর্ক আছে।
১৯৭২ সাল থেকে পাঁচবার বাংলাদেশ সরকার বা সরকারের অনুমতিতে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিবারেই মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ভিন্ন ভিন্ন হয়েছে বা কম বেশী হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে বিশেষ ঝামেলা নেই। ঝামেলা অন্যত্র : রাজনৈতিক কারণে তালিকাভূক্তি হওয়ার বা তালিকাভুক্তি করানোর বা তালিকা থেকে বাদ দেবার প্রবণতা অথবা কোন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার নাম ভূলক্রমে বাদ পড়ায় সেই নামটি তালিকাভুক্তি করার চেষ্টার সময় ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক বাঁধার সৃষ্টি। অভিযোগ আছে মুক্তিযুদ্ধে কোন ভাবেই অংশগ্রহণ করেননি, এমনকি পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছে সেই রকম অনেক ব্যক্তিও তৎকালীন (১৯৭২সালে) স্বরাষ্ট্র সচিবের স্বাক্ষর করা অথবা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানীর স্বাক্ষর করা সনদপত্র নীতি বহির্ভূত পন্থায় সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধার তালিকাভুক্ত হন। ১৯৭২ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে অস্থিতিশীল রাজনীতিক-প্রশাসনিক পরিবেশে তা ঘটে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই মারা গেছেন। অনেকেই অভিমানে ও বিভিন্ন কারণে দিগন্তে হারিয়ে গেছেন। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক সংখ্যা উদ্ধার করাও কঠিন হয়ে পড়েছে।’
মুক্তিযুদ্ধের ভাতা নেওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র আলহাজ্ব এ.বি.এম মহিউদ্দিন চৌধুরী ১৯৯৬ সালে, মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ সংবাদপত্র পরিষদের সাবেক সভাপতি সালাউদ্দিন আহমদ ২০০৩ সালে, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দীন ২০১৬ সালে আমাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, সেই পরামর্শ গ্রহণ করতে পারিনি।
প্রসঙ্গক্রমে: মুক্তিযুদ্ধের শুরু এবং শেষের কিছু স্মৃতি এখানে উল্লেখ করতে চাই,
১৯৯০ সালের ১৬ ডিসেম্বর দৈনিক আজাদী সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ আমাকে মুক্তিযুদ্ধের শুরু ও শেষের একটি সংক্ষিপ্ত স্মৃতি লিখার পরামর্শ দিয়েছিলেন। উনার জীবিত থাকাবস্থায় ২০০৩ সাল পর্যন্ত এ বিষয়ে লেখা আমার পক্ষে বিভিন্ন ব্যস্ততার কারণে সম্ভব হয়ে উঠেনি।
১৯৭১ সালের ১ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান ঢাকায় ৩ মার্চ আহুত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করলে আমরা বুঝে নিয়েছিলাম যে, পশ্চিম পাকিস্তানীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নির্বাচিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। ইয়াহিয়া খানের এই ঘোষণায় সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। এদেশের ছাত্রসমাজ দল-মত-নির্বিশেষে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করার জন্য মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
আমি তখন চট্টগ্রাম সরকারী আই.আই কলেজের ছাত্র ও ছাত্রলীগ কলেজ শাখার সভাপতি। ইয়াহিয়া খানের ঘোষণার প্রতিবাদে ৩ মার্চ, ১৯৭১-এ আই.আই কলেজের ঐতিহাসিক বটতলায় সর্বদলীয় ছাত্র সমাবেশ করি। কলেজ ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি হিসেবে আমার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সমাবেশ ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন, ১১ দফা পন্থী এন.এস.এফ, বাংলা ছাত্রলীগের প্রতিনিধিরা বক্তব্য রাখেন। ঐ সমাবেশে আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর- বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ ‘ভুট্টোর মুখে লাথি মার- বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ ‘ইয়াহিয়ার মুখে লাথি মার- বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ স্লোগান দিতে দিতে মিছিল নিয়ে লালদীঘি মাঠে এসে জমায়েত হই। লালদীঘি মাঠে চট্টগ্রাম শহর ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি জনাব আয়ুব বাঙালির সভাপতিত্বে বিরাট ছাত্র গণজমায়েত অনুষ্ঠিত হয়। ঐ জমায়েতেও স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার পুনঃ সংকল্প ব্যক্ত করা হয়। বিকেলে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি জনাব এম.আর. সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে লালদীঘি মাঠে অনুষ্ঠিত বিশাল জনসভায় নেতৃবৃন্দ স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করার পক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখেন।
এই সকল সমাবেশের খবরাখবর চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদীতে প্রকাশ হতে থাকে সবিস্তারে। চট্টগ্রামে তখন মরহুম ফজলুল কাদের চৌধুরী’র পৃষ্ঠপোষকতায় দৈনিক আজান নামে আরো একটি বাংলা পত্রিকা চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশ হচ্ছিল। কিন্তু, ঐ পত্রিকায় স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে তেমন কোনো খবরাখবর স্থান পেত না। চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের প্রথম সাংবাদিক সভাপতি নুরুল ইসলামের সম্পাদনায় প্রকাশিত পিপলস্ ভিউ পত্রিকায় স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষের সংবাদ প্রকাশিত হতো। দৈনিক আজাদী এমনিতেই স্বাধীনতার পক্ষে ছিল। অধিকন্তু, আরেকটি বিশেষ কারণ ছিল যে, ১৯৭০ এর ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে রাউজান-হাটহাজারী এলাকা থেকে দৈনিক আজাদী সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে বিপুল ভোটের ব্যবধানে মরহুম এ.কে.এম. ফজলুল কাদের চৌধুরীকে পরাজিত করে এম.এন.এ নির্বাচিত হয়েছিলেন। একদিকে জনমতের বাহন পত্রিকা, অপর দিকে জনগণের ভোটে নির্বাচিত নেতা সম্পাদক- এই দুয়ের সমন্বয়ে আজাদীর ভূমিকা ছিল বলিষ্ঠ, গণমুখী, বাস্তব ও সময়োপযোগী।
১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহ গত প্রায় পাঁচ দশকের মধ্যে সম্মানিত পাঠকরা জানতে পেরেছেন। ২৫ মার্চ পাক বাহিনীর দখল অভিযান শুরু হবার পর আমাদের কলেজ ছাত্রলীগের ১১জন নেতা ও কর্মী মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেই। যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন তাঁরা হলেন কলেজ ছাত্রলীগ সভাপতি মইনুদ্দীন কাদেরী শওকত, এস.এম. ফারুক, মোহাম্মদ সেকান্দর, ইফতিখার উদ্দিন, কলেজ ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক মরহুম নাসির উদ্দিন খান, গিয়াস উদ্দিন দিলদার, আহমদ হোসেন, আবুল হাশেম, এম. মনজুর হোসেন (পূর্ব ষোলশহর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক), মোহাম্মদ আতিকুর রহমান (শুলকবহর আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি) ও ওহীদুল আলম। আমরা ১১ জন এক সাথে ছিলাম না। কেউ চট্টগ্রাম শহরে আবার কেউ গ্রামে পাক হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের সাথে সম্মুখ সমর ও গেরিলা কায়দায় মোকাবেলা করছিলাম। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তাঁর এ ঘোষণার ফলে মুক্তিকামী, নিরস্ত্র বাঙালিদের মধ্যে সাহাসের সঞ্চার হয়। কারণ মুক্তি পাগল বাঙালি আশা করছিলো রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাথে সাথে নিয়মিত সামরিক বাহিনীর বাঙালিরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে স্বাধীনতা তরান্বিত করুক।
মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিনগুলোতে অর্থাৎ ১৯৭১ সালের মধ্য নভেম্বর হতে বিজয় দিবসের আগে পর্যন্ত আমরা রাউজান থানার ইয়াসিন নগরের কচুপাড়ায় শামসু মেম্বার (পরে যিনি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন) এর খামারে ছিলাম। আমরা এক কোম্পানী মুক্তিযোদ্ধা ঐ খামারে ছিলাম। আমাদের অপারেশন কমান্ডার ছিলেন চট্টগ্রাম জেলা ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি জনাব আবু মোহাম্মদ হাশেম (স্বাধীনতাত্তোর সময়ে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক দেশ বাংলা সম্পাদক, বর্তমান এডভোকেট ও জাসদ কেন্দ্রীয় নেতা) এবং কোম্পানী কমান্ডার ছিলেন জনাব কামাল উদ্দিন চৌধুরী (অধূনালুপ্ত বাকশাল, চট্টগ্রাম উত্তর জেলার সাধারণ সম্পাদক)। আমাদের গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন জনাব জাহিদ হোসেন খোকন।
মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিনগুলোতে রাউজান থানা এলাকায় দু’টি অপারেশনের কথা এই মুহুর্তে স্মৃতিতে ভেসে আসছে। একটি হল ১ ডিসেম্বর রাউজান রাবার বাগানের সামনে চট্টগ্রাম- রাঙ্গামাটি সড়কের উপর পশ্চিমা হানাদার বাহিনীর সাথে মুখোমুখি যুদ্ধ। আমাদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন কোম্পানী কমান্ডার কামাল উদ্দিন চৌধুরী। এই যুদ্ধে আমরা জয়ী হই।
এরপর ৬ ডিসেম্বর ভোরে রাউজান থানার মাদাইম্যারহাটে পাক হানাদার ও রাজাকার বাহিনীর ক্যাম্প আক্রমন করতে গেলে বেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হয়। এখানে সম্মুখে যুদ্ধ শুরু হলে রাউজান কলেজের ছাত্র আবদুল মান্নান, পংকজ বড়ুয়া, সিটি কলেজের ছাত্র, লাকসাম নিবাসী শামসুল আলম যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হন। শহীদ হবার আগে শামসুল আলম তাঁর চাঁদরটি আমাকে রাখতে দিয়েছিলেন। পরে আর সেটি পাওয়া যায়নি। আমি এবং সৈয়দ সানোয়ার আলী (নগর বি.এন.পি নেতা) সহ বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাও আহত হই। আহতদের কচুপাড়া ক্যাম্পে নিয়ে আসলে সৌভাগ্যক্রমে ডা: এম.এ. মান্নানকে দেখতে পাই। উনি বোয়ালখালী পাঁচলাইশ এলাকা থেকে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। উনি ঐ দিনই আমাদের ক্যাম্পে এসেছিলেন। ঐ সময় আহতদের সবাইকে উনি চিকিৎসা করেন।
এর ৩ দিন পর ঘটে সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা। ১০ ডিসেম্বর ভোরবেলা আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের বেশীরভাগই ঘুমের মধ্যে ছিলাম। হঠাৎ পাক হানাদার ও রাজাকার বাহিনী সম্মিলিতভাবে আমাদের ক্যাম্প ঘেরাও করে আক্রমন করে। আমরা প্রস্তুত হবারও সময় পাইনি। শত্রুদের এই আক্রমনে আমাদের বহু মুক্তিযোদ্ধা হতাহত হন। অনেক অস্ত্র-শস্ত্র ও গেলা-বারুদ বেহাত হয়। উল্লেখ্য যে, মাদাইম্যার হাটের অপারেশনে শহীদ শামসুল আলমকে রাউজান কলেজের বিপরীতে রাঙ্গামাটি সড়কের উত্তর পার্শ্বের পুকুর পাড়ে কবরস্থানে দাফন করা হয়। কচুপাড়া থাকা অবস্থায় আমরা উত্তর মহকুমা ছাত্ররীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক জনাব তোফায়েল আহমদের বেশ সহযোগিতা পাই এবং সেখানেই ভুলক্রমে সতীর্থদের গুলিতে ছাত্রনেতা নাজিমউদ্দিন খানের শহীদ হবার খবর পাই তোফায়েল আহমদের কাছে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু এবং শেষের কয়েকদিনের উল্লেখিত ঘটনা এখনো আবার স্মৃতিতে অম্লান।
দীর্ঘ পাঁচ দশকের মধ্যে একটা বিষয় স্পষ্ট লক্ষ্য করা গেছে যে, যারা সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তারা এখনো দেশকে ভালবাসেন, সৎ জীবনযাপন করছেন। আর যারা’৭১ এর ১৬ ডিসেম্বরের পর মুক্তিযোদ্ধা সেজেছেন, সার্টিফিকেট বানিয়ে ফায়দা লুটেছেন- তারা এখনো তা করছেন। সব সরকারের আমলেই ব্যক্তিগত ফায়দা হাসিল করে আসছে তারা। বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই এদের সহজে চিনতে পারবে না। ###
————————————————————————–
নিবন্ধক: মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক। বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল এবং ওয়ার্ল্ড এসোসিয়েশন প্রেস কাউন্সিলস্ নির্বাহী পরিষদের সাবেক সদস্য। চট্টগ্রামের ইজতিহাদ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। চট্টগ্রাম সাংবাদিক হাউজিং সোসাইটির সাবেক চেয়ারম্যান।

Loading