চট্টগ্রামে করোনার চিকিৎসা

রোগীদের হাহাকার কমেছে বেড়েছে সক্ষমতা

প্রকাশিত: ৯:১৬ পূর্বাহ্ণ , জুলাই ৯, ২০২০

চট্টগ্রামে করোনা রোগীদের চিকিৎসায় যে হাহাকার ছিল তা কমে এসেছে। চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল ও বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ট্রপিক্যাল ডিজিজেস বিআইটিআইডি, ইউএসটিসিসহ বিভিন্ন হাসপাতালে করোনা রোগী ভর্তি কমেছে। ১৫ দিন আগেও এসব হাসপাতালে শয্যার বেশি বা শয্যাভর্তি রোগী ছিল। সেই চাপ কমে এসেছে। তবে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে রোগীর চাপ রয়ে গেছে।

কিছু দিন আগেও এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতাল ঘুরে ঘুরে সিট না পেয়ে বা সিট থাকার পরও ভর্তি হতে না পেরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। নমুনা পরীক্ষায় ভোগান্তিও ছিল অবর্ণনীয়। পরীক্ষার পরিসর বৃদ্ধি পাওয়ায় কোনো একটি হাসপাতালে নমুনা পরীক্ষার জন্যও রোগীদের সেই চাপ আর নেই।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত প্রশাসন থেকে বেসরকারি হাসপাতালে রোগী ভর্তির বিষয়ে সার্ভেইল্যান্স টিমের মনিটরিং করা, বেসরকারি পর্যায়ে বেশ কিছু আইসোলেশন সেন্টার গড়ে তোলা, মূল্যবান চিকিৎসা সরঞ্জাম নিয়ে ধনাঢ্যদের এগিয়ে আসা, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোয় আইসোলেশন সেন্টার করা, অক্সিজেন সরবরাহ স্বাভাবিক করাসহ নানা পদক্ষেপের কারণে করোনা রোগীর চিকিৎসাবঞ্চিত হওয়ার যে হাহাকার ছিল, তা এখন অনেকাংশে কমেছে।

চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. শেখ ফজলে রাব্বি জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আরও ২৯৫ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এ নিয়ে চট্টগ্রামে মঙ্গলবার পর্যন্ত করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৭৭২ জনে। এদের মধ্যে ৭ হাজার ৫০২ জন নগরের ও ৩ হাজার ২৭০ জন উপজেলার বাসিন্দা। আক্রান্তদের ৭ হাজার ৯৩৭ জনই পুরুষ। নতুন করে ১৪ জন সুস্থ হয়েছেন। এ পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন ১ হাজার ২৭৯ জন। তবে করোনায় চট্টগ্রামে ২০৪ জন মারা গেছেন।
সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কোভিড ‘রেড’ ও ‘ইয়েলো’ জোনে রোগী ভর্তি ছিলেন ১৬৬ জন। এক সপ্তাহ আগেও এ সংখ্যা দু’শর বেশি ছিল। চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউসহ ১০০ বেডের বিপরীতে বুধবার ভর্তি রোগীর সংখ্যা ছিল ১০১ জন।
এই হাসপাতালে যেখানে আইসিইউ খালি পাওয়া যেত না, সেখানে বুধবার ৪টি আইসিইউ খালি ছিল। ফৌজদারহাট বিআইটিআইডিতেও রোগী ভর্তি কমেছে। কমেছে নমুনা পরীক্ষার জন্য আসা রোগীর চাপও।
বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল হাসপাতাল তথা ইউএসটিসির কোভিড ইউনিটে কর্মরত ডা. মোহাম্মদ ফরহাদ বুধবার দুপুরে যুগান্তরকে বলেন, তাদের ৪০ শয্যার কোভিড ওয়ার্ডে এক সপ্তাহ আগেও ৩৩ জন রোগী ভর্তি ছিলেন। বুধবার কোভিড রোগী ছিলেন ১৪ জন। তিনি জানান, প্রথম প্রথম রোগীর যে চাপ ছিল সেটা এখন কিছুটা কমেছে।
চট্টগ্রামের ১৮টি বেসরকারি হাসপাতালে গত ৪ জুন করোনা সন্দেহে ৮০ জন ও করোনা আক্রান্ত ৪ জন রোগী ভর্তি ছিলেন। এক মাসের মাথায় এসব হাসপাতালে করোনা সন্দেহে ২৮৬ জন ও করোনা আক্রান্ত হয়ে ৯১ জন রোগী ভর্তি হন।
আইসিইউতে কোভিড রোগী ভর্তি ছিলেন ৬৭ জন। মূলত বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে কোভিড রোগী ভর্তি ও চিকিৎসা দিতে এক প্রকার বাধ্য করার কারণেই কোভিড ইউনিট ও আলাদা বেড চিহ্নিত করে রোগী ভর্তি করা হয়েছে।
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) ও বেসরকারি হাসপাতাল মনিটরিংয়ের জন্য গঠিত সার্ভেইল্যান্স টিমের প্রধান মিজানুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘চট্টগ্রামে কোভিড রোগী নিয়ে স্বজনদের যে যন্ত্রণা সইতে হয়েছে তা অকল্পনীয়। হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরে ভর্তি হতে না পেরে বিনা চিকিৎসায় বেশ কিছু মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। বেসরকারি হাসপাতালগুলো যদি শুরু থেকেই কোভিড রোগীর চিকিৎসায় এগিয়ে আসত তবে এ সমস্যা হতো না। শেষ পর্যন্ত প্রশাসনের পক্ষ থেকে বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে একপ্রকার বাধ্য করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সরঞ্জাম, বিশেষ করে অক্সিজেন, ভেন্টিলেটর, আইসিইউ সংকট প্রকট ছিল। যে কারণে কোভিড রোগী চিকিৎসা পায়নি। এরই মধ্যে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে আইসোলেশন সেন্টার গড়ে ওঠে। এসব সেন্টারে অক্সিজেন সরবরাহসহ কোভিড রোগীর প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। শিল্পপতি ও দানশীল ব্যক্তিদের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেনের ব্যবস্থা করা, আইসোলেশন সেন্টারে অক্সিজেন দেয়া, ভেন্টিলেটর প্রদান, হাইফ্লো অক্সিজেন ন্যাজাল ক্যানুলার ব্যবস্থা করে দেন। উপজেলা পর্যায়েও আইসোলেশন সেন্টার গড়ে তোলা হয়। মূলত এসব কারণে কোনো একটি হাসপাতালে আর রোগীর চাপ নেই।
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও কোভিড-১৯ সংক্রান্ত সমন্বয় কমিটির চট্টগ্রাম বিভাগীয় প্রধান ডা. আ ম ম মিনহাজুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘শুরুর দিকে কারও প্রস্তুতি ছিল না। হাসপাতালগুলোর সক্ষমতা ছিল না। অনেকের মধ্যে ভয় ছিল। যে কারণে দ্রুত করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। তা সামাল দিতে আমাদের সবাইকে হিমশিম খেতে হয়েছে। রোগীদের মধ্যে সচেতনতা গড়ে ওঠা, আক্রান্ত হলেই আইসোলেশনে চলে যাওয়া, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শে বাসায় বসে চিকিৎসা নেয়াসহ নানা কারণে করোনা আক্রান্ত রোগীদের হাহাকার অনেকাংশেই কমে এসেছে।
তিনি বলেন, ‘সংক্রমণ যাতে আরও নামিয়ে আনা যায়, সে জন্য আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রোগীকে আইসোলেশনে চলে যেতে হবে। এটাই হচ্ছে এখন উপযুক্ত সময়। তাহলে আক্রান্ত ব্যক্তির মাধ্যমে নতুন করে করোনা ভাইরাস ছড়ানোর সুযোগ থাকবে না।’ যুগান্তর

Loading