সংকটকালে ঘর-সংসার

যেভাবে চলছে বাজার-সদাই

প্রকাশিত: ৯:৩৪ পূর্বাহ্ণ , সেপ্টেম্বর ২, ২০২২

উত্তর বাড্ডা কাঁচাবাজারে প্রতি সপ্তাহে বাজার করেন সাঈদা হোসনে আরা (৫০)। পেশায় তিনি স্কুলশিক্ষিকা। বাজার করার সময়ে সময় সং বাদের সঙ্গে আলাপ হলো তার। ছবি তুলতে আপত্তি জানালেও বর্তমান বাজার দর নিয়ে লম্বা সময় কথা বললেন।

সময় সংবাদকে হোসনে আরা বলেন, ‘প্রতিটি জিনিসের দাম বেশি, এটা কিন্তু নতুন কথা না। প্রথম কদিন হা হুতাশ করলেও এখন খাপ খাইয়ে নেয়ার চেষ্টা করছি। আগে প্রতি সপ্তাহে হয় ইলিশ মাছ নয়তো গরুর মাংস কিনতাম। এখন এ অভ্যাসটি বাদ দিতে হয়েছে। আগে পুকুরের পাঙাশ কিনতাম না, এখন কিনছি। তবে দুঃখের কথা হচ্ছে, আগে হাতে টাকা কম থাকলে ১২০ টাকা কেজিদরে পাঙাশ ও ১৫০ টাকা কেজিদরে তেলাপিয়া কিনে বাসায় ফেরা যেত। এখন এসব মাছের দামও বেড়ে গেছে। তেলাপিয়ার কেজি হয়ে গেছে ২০০ টাকা। পুকুরের পাঙাশ বিক্রি হচ্ছে ১৮০ টাকা কেজিতে।’

একদিকে বাড়ছে প্রতিটি খাদ্যপণ্যের দাম, অন্যদিকে মানুষের অন্যান্য খরচও বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তরা নিজেদের সাংসারিক বাজেট সীমাবদ্ধ করে জীবন কাটাচ্ছেন।

সাংসারিক বাজেট নিয়ে কথা হয় ব্যাংক কর্মকর্তা মকবুল হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ব্যাংকে কিন্তু বেতন ভালো। আগে প্রতি মাসে ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা সঞ্চয় ছিল, এখন সেটি প্রায় শূন্যের ঘরে এসে নেমেছে। উল্টো বাজারের যে দশা, এতে প্রায় প্রতি মাসেই সঞ্চয় ভেঙে খেতে হচ্ছে। মাঝে মরিচের দাম বেড়ে গেল। কেজি দাঁড়াল ২৫০ টাকায়। এবার দাম কমায় ২ কেজি মরিচ কিনে নিয়ে বউকে বলেছি বেটে ডিপ ফ্রিজে রেখে দিতে। কখন কোনটার দাম বেড়ে যায় কিছুই আন্দাজ করা যায় না।’

মূল্যস্ফীতি নিয়ে অর্থনীতিতে একটি কথা প্রচলিত আছে। বলা হয়ে থাকে, মূল্যস্ফীতি নিম্নবিত্তকে দেয় ক্ষুধার কষ্ট, মধ্যবিত্তের সঞ্চয় নিয়ে আসে তলানিতে আর উচ্চবিত্তের মনে বিরক্তির উদ্রেক করে।

অর্থনীতির তত্ত্বকথা কতটুকু বাস্তবমুখী সে নিরীক্ষা চালাতেই আলাপ হয় রিকশাচালক আসাদ আলির সঙ্গে। সময় সংবাদকে তিনি বলেন, ‘আমি রিকশা চালাই, আর আমার বউ বাসা-বাড়িতে ছুটা বুয়ার কাম করে। আগে যে আয় হইতো তা দিয়া ৪ জনের পরিবার ভালোই চলত। মনে করেন প্রতি সপ্তাহে মুরগি-মাছ থাকত। দুই তিন দিন ডিম খাইতাম। প্রতিদিন তরকারির লগে ডাইল থাকত। এহন যেমনে দাম বাড়ছে গত এক মাস হইলো মাংস খাই না। আগে কুঁচা চিংড়ি দিয়া তরকারি রানতো। এহন ঐডাও বাদ। খালি তরকারি আর ভাত। ডিমের দাম বাড়ছিল বইলা ডিম খাওয়াও বাদ দিছিলাম।’

সাব্বির খান একটি ফার্মে চাকরি করেন। বাড়তি আয়ের জন্য অ্যাপে বাইকও চালান। সময় সংবাদকে তিনি বলেন, ‘আগে অফিস শেষে বাইক চালিয়ে বাসায় আসার সময় দুইটা খ্যাপ মারলে পকেটে ৩০০-৫০০ টাকার মতো থাকত। ওই টাকা দিয়ে বাচ্চাদের জন্য চকলেট-চিপস, স্ত্রীর জন্য ছোটখাটো কোনো শৌখিন জিনিস কিনে নিয়ে যেতাম। এবার ডিজেলের দাম বাড়ায় এ বাড়তি আয়ের আশা ছাড়তে হয়েছে। খালি হাতেই বাসায় ফিরতে হয়। বাচ্চাদের মন খারাপ হয়। তাদের তো আর বর্তমান বাজার দর বোঝানো যায় না। এখনতো টিকে থাকতেই কষ্ট হচ্ছে।’

কদিন আগে বনশ্রী ফ্ল্যাট কিনেছেন একটি বায়িং হাউসের কর্মকর্তা ইহসান উল্লাহ শামিম। তিনি বলেন, ‘মানুষ ভাবে নিজের ফ্ল্যাটে থাকি, বড় চাকরি করি- কষ্ট কীসের। কিন্তু ভাই, আমরা যারা চাকরি করে ঢাকায় একটা ফ্ল্যাট কিংবা গাড়ি কিনেছি, তাদের সিংহভাগই ব্যাংক ঋণের সাহায্য নিয়েছি। আগে ঋণের মাসিক কিস্তি ছিল ৩০ হাজার টাকা। বেতন থেকে ওই টাকা দেয়ার পরও বাজার-সদাই করে মাসে কিছু টাকা হাতে থাকত। এখন হাতে টাকা থাকা দূরে থাক, বাজার করে, সংসারের খরচ চালিয়ে ঋণের কিস্তির টাকা দিতে হিমশিম খাচ্ছি। সেদিন স্ত্রীর সঙ্গে পরিকল্পনা করলাম ফ্ল্যাটের একরুম সাবলেট দেব। এ ছাড়া তো উপায় নেই। মাসে যদি ১০-১২ হাজার টাকাও আসে, তাতেও কিস্তির চাপ কিছুটা কমে।’

টানা দুই বছর করোনার করাঘাতের ধাক্কা সামলাতে না সামলাতেই রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত সংকটে ফেলেছে সমগ্র বিশ্বকে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পড়েছে রিজার্ভে টান, বেড়ে গেছে আমাদানি খরচ। বাংলাদেশেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। উচ্চ মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে নিম্নবিত্ত- সবাইকে সংসার চালাতে নতুন করে হিসাব কষতে হচ্ছে। কমিয়ে আনতে হচ্ছে খরচ, পরিমিত করতে হচ্ছে সাংসারিক ব্যয়।

মানুষ কতটা রয়ে-সয়ে পণ্য কিনছেন এ কথা জানা যায় ব্যবসায়ীদের থেকে। পূর্ব বাড্ডা কৃষি ব্যাংকের গলিতে গরুর মাংসের ব্যবসা করেন কসাই সালামত মোল্লা। তিনি বলেন, ‘আগে মনে করেন একেক জন শুক্রবার আইসা ৫-৬ কেজি গরুর মাংস কিনা নিয়া যাইত। এহন যতই কামাক না ক্যান, ৩ কেজির ওপরে গরুর মাংস কিনে না কেউ। আমি জিন্দেগিতে আধাকেজি গরুর মাংস বেচি নাই। এ বছর আইসা বেচতে হইতেছে। মানুষ কী করব কন। ৫ জনের পরিবারে পেট ভইরা খাইলে এক কেজি গরুর মাংস এমনিই লাগে। এক কেজি মানে এক ধাক্কায় ৭২০ টাকা শ্যাষ। সেদিন একজন আইসা কইল বাচ্চারা গরু খাওয়ার বায়না ধরছে আধা কেজি মাংস দেন। মানুষের আয়-উন্নতি কই গিয়ে ঠেকছে দেখছেন!’

সবকিছুর দাম বাড়লেও তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাড়েনি বেতন। বিশেষ করে বেসরকারি অফিসের কর্মকর্তাদের স্বল্প বেতনে সংসার চালাতে গিয়ে উঠছে নাভিশ্বাস। প্রতিদিন মাছ ও মাংসের বাজার থেকে খালি হাতে, শূন্য ব্যাগে ফিরে যান অসংখ্য ক্রেতা। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সামঞ্জস্য না থাকায় সাধ আর সাধ্য এক হয় না তাদের।

বাজার থেকে খালি ব্যাগ নিয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন রফিকুল ইসলাম। মাছ-মাংস কিছু কিনলেন না কেন জানতে চাইলে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রফিক বলেন, ‘ভাইরে, দাম বাড়ছে সব জিনিসের, কমছে কেবল মানুষের!’ – সময় সংবাদ

Loading