অনলাইন ডেস্ক

শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি

প্রকাশিত: ১:১৯ অপরাহ্ণ , আগস্ট ১৬, ২০২২

আজ ভাদ্রের প্রথম দিন, অর্থাৎ গ্রীষ্ম-বর্ষা পেরিয়ে যাত্রা শুরু করল শ্বেত-শুভ্র ঋতু ‘শরৎ’। যে ঋতুতে আকাশ দেখে চট্-জলদি মন ভালো হয়ে যায়। যে ঋতুতে ঝকঝকে কাচের মতো স্বচ্ছ নীলাকাশ, পেঁজা তুলার মতো সাদা মেঘমালা। আবার মুখ গোমড়া কালো মেঘের ছায়া।

বঙ্গাব্দ বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী ভাদ্র-আশ্বিন এ দুই মাস বাংলাদেশে শরৎকাল। সংস্কৃত অভিধানে বর্ণিত ঋতুর নাম ও ক্রম হলো—অগ্রহায়ণ-পৌষ নিয়ে ‘হিম’; মাঘ-ফাল্গুন নিয়ে ‘শিশির’; শ্রাবণ-ভাদ্র নিয়ে ‘বর্ষা’ এবং আশ্বিন-কার্তিক নিয়ে ‘শরদ’ বা ‘শরৎ’।

শরতে মানুষ বর্ষাকে বিদায় জানিয়ে ঘরের বাইরে এসে সাদা মেঘের কারুকার্যখচিত চিত্রালির উন্মুক্ত আকাশের নিচে শীতল হাওয়ায় নিজেকে অবমুক্ত করে। বাংলার আকাশ, বাতাস, নদী-নালা, হাওর, বনাঞ্চল মুখরিত হয় পর্যটকের কোলাহলে। নদীর ঢেউয়ের সঙ্গে দোল খায় নদীপারের সাদা কাশফুল। শিশির ভেজায় শারদ সকাল, ঘাসের ওপড় জমে থাকে চিক চিক শিশির বিন্দু। গাছের পাতা ঝড়া শুরু হয় শরৎ ঋতুতেই।

শরতে সবুজের বুকে সাদা কাশফুল ছাড়াও ফোটে উঠে গগন শিরীষ, আর শিউলি, শেফালী। ছাতিম, বকফুল, মিনজিরি, কলিয়েন্ড্রার দেখা মেলে শরৎ কালে। হেঁটে যেতে পায়ে দলে খুশবু মাখা সাদা শিউলি। পদ্ধবিলে ফুটে থাকে শাপলা। গ্রামের শিশু-কিশোর দলবদ্ধ হয়ে ঘুরে বেড়ায় বনজঙ্গল, এ গাছ ও গাছ চালতা, করমচা, ডেউয়া, ডুমুর, অলবরই আর আমলকির খোঁজে।

প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ এ ঋতুর চরিত্রের সঙ্গে বর্ণনা করেছেন প্রিয়তমাকে। তিনি তার ‘এখানে আকাশ নীল’ কবিতায় লিখেছিলেন— ‘এখানে আকাশ নীল-নীলাভ আকাশজুড়ে সজিনার ফুল/ফুটে থাকে হিম শাদা—রং তার আশ্বিনের আলোর মতন’।

বাংলা সাহিত্যের অমর বটবৃক্ষ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঋতু বন্দনার কবিতা, গান রচনা করেছেন প্রকৃতির সাথে মিশে। বিভিন্ন ঋতুভিত্তিক তার গান ও কবিতা আছে। আর ঋতুর রানি শরৎকে নিয়ে তার সৃষ্টি যেন বাঙময় হয়ে উঠেছে সৃষ্টিশীল কলমে। শরতের বর্ণনাময় কবিতা-গানে আমাদের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ ও সুবাসিত করেছেন কবিগুরু। তিনি লিখেছেন—

‘শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি/ছড়িয়ে গেল ছাড়িয়ে মোহন অঙ্গুলি। শরৎ তোমার শিশির ধোওয়া কুন্তলে/ বনের পথে লুটিয়ে পড়া অঞ্চলে/আজ প্রভাতের হৃদয় ওঠে চঞ্চলি।’

বাংলা সাহিত্যাকানে উজ্জ্বল ধূমকেতু কবি কাজী নজরুল ইসলাম। অন্যায়-অত্যাচার ও পরাধীনতা তাকে বিদ্রোহী করে তুললেও, প্রেম-বিরহের চির কাঙাল কবি শরতেরও জয়গান গেয়েছেন তার কবিতা আর গানে। চির সবুজ এসব কবিতা, গানে পুলকিত হয় পাঠকমন। বিদ্রোহী কবির গহীন হৃদয়ে ঝর্ণার মতো জমানো এত প্রেম, সত্যিই বিস্মিত করে তোলে।

কবিতায় কবি শরতের রূপ তুলে ধরেছেন এভাবে—

‘সই পাতালো কি শরতে আজিকে স্নিগ্ধ আকাশ ধরনি?

নীলিমা বাহিয়া সওগাত নিয়া নামিছে মেঘের তরণী!

অলাকার পানে বলাকা ছুটেছে মেঘদূত মন মোহিয়া

চক্ষু রাঙা কলমীর কুড়ি মরতের ভেট বহিয়া।

সখির গাঁয়ের সেঁউিতি বোটার ফিরোজায় ঢং পেশোয়াজ

আসমানি আর মৃন্ময়ী সখি মিশিয়াছে, মেঠোপথ মাঝ।’

অনেকের মতে, শরৎকালে নাকি ভালোলাগার অনুভবে মনটা নেচে ওঠে। ছুটির নেশা, উত্সবের নেশায় মন ছুটে যায়। কারণ, এ শরৎকালে মাঠে মাঠে সবুজ ধানের ওপর সোনালি আলোর ঝলমলে রূপ দেখা যায়। প্রতীক্ষায় থাকে কৃষকরা। আসন্ন নবান্নের আশায়।

আলোক-শিশিরে-কুসুমে-ধান্যে বাংলার প্রকৃতিও খুশি। আর বাঙালির সেই প্রাণের উত্সবটা তো রয়েছেই—শারদীয় দুর্গাপূজা। শরৎ শারদীয় আরাধনায় হিন্দু সমাজকে উৎবমুখর করে, বিজয়ার বেদনায় করে ব্যথিত।

Loading