ওপরের নির্দেশে’ মোরশেদকে হত্যা

প্রকাশিত: ১:৩৭ অপরাহ্ণ , এপ্রিল ১০, ২০২২
হত্যার শিকার মোরশেদ

কক্সবাজারে ইফতার পর্যন্ত প্রাণে না মারার আকুতি জানিয়েও খুনের শিকার আলোচিত মোরশেদ আলী ওরফে মোরশেদ বলি হত্যায় মামলা করা হয়েছে।শনিবার সন্ধ্যায় কক্সবাজার মডেল থানায় চাঞ্চল্যকর মোরশেদ বলি হত্যাকাণ্ডের মামলাটি করেন নিহতের ছোট ভাই শাহেদ আলী। মামলায় ২৬ জনের নাম উল্লেখ ও ৮-১০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে ১৫-১৬ জনই স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মী। এ ঘটনায় এ পর্যন্ত তিনজন গ্রেফতার হয়েছেন।

এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন সদর মডেল থানার ওসি মনিরুল গিয়াস।

মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, কক্সবাজার সদর উপজেলার পিএমখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি সিরাজুল মোস্তফা আলাল ও ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক জয়নাল আবেদীন হত্যাকাণ্ডের সময় উপস্থিত শত শত মানুষকে উদ্দেশ্য করে হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন— তোমরা মোরশেদ বলিকে বাঁচাতে কেউ আসবে না। তাকে মেরে ফেলার জন্য ওপরের নির্দেশ আছে।

এদিকে ক্ষমতাসীন দল ও অঙ্গ সংগঠনের দুই তৃণমূল নেতা ‘ওপরের নির্দেশ’ প্রাপ্ত হয়ে একজন নিরীহ ব্যক্তিকে শত শত মানুষের সামনে পৈশাচিকভাবে হত্যার ঘটনাটি নিয়ে এলাকায় তোলপাড় চলছে।

পবিত্র রমজান মাসে একজন রোজাদার মানুষকে ইফতারি কিনার সময় একদম প্রকাশ্য দিনের বেলায় এমন নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনাটি বিবেকবান মানুষের হৃদয় ছুঁয়েছে।

৩০-৩৫ জন সন্ত্রাসী বাজারের একটি গলি ঘিরে বন্দুক, ধারালো দা, হাতুড়ি, ছোরা, কিরিচ ও লোহার রড দিয়ে এ জঘন্য হত্যাকাণ্ড ঘটায় বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।

একজন নিরীহ মানুষকে হত্যা করার জন্য ‘ওপরের নির্দেশ’ থাকার বিষয়টি এখন ‘টক অব দ্য কক্সবাজার’ হয়ে উঠেছে।

এ ব্যাপারে কক্সবাজার সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক মাহমুদুল করিম মাদুর বলেন, নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সময় এমন কথাটি পিএমখালী ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক জয়নাল আবেদীন বলেছেন বলে শুনেছি। তবে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজুল মোস্তফা আলাল এমন কথা বলেছেন বলে শুনিনি।

কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান জানিয়েছেন, মামলার এজাহারে আসামি হওয়া সকল দলীয় নেতাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হবে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মোরশেদ বলি নামের প্রবাসী ব্যক্তিকে হত্যার শিকার হতে হয়েছে স্থানীয় তৃণমূল পর্যায়ের বিএনপি নেতা ও সাবেক মেম্বার মোহাম্মদুল হকের সঙ্গে ঝগড়াকে কেন্দ্র করে। আর পুরো হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের তৃণমূল নেতাদের নেতৃত্বে।

লোকজন বলছেন, রাজনীতির আদর্শে বিভক্ত হলেও বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের পিএমখালী এলাকার নেতাকর্মীরা খুনোখুনিতে একাকার হয়ে পড়েছেন। তাও আবার হত্যাকাণ্ড ঘটানোর জন্য বিএনপি নেতা মোহাম্মদুল হকের দুই ভাই মোহাম্মদ আলী প্রকাশ মোহাম্মদ ও ছৈয়দুল হক সুদুর সৌদি আরব থেকে বিপুল অংকের টাকা নিয়ে সম্প্রতি দেশে ফিরেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।

বাজারে হত্যাকাণ্ড ঘটার জন্য যখন সংঘবদ্ধ খুনির দল মোরশেদকে ঘিরে ধরেছিল তখন রোজাদার মোরশেদ তাদের কাছে আকুতি জানিয়ে প্রাণ ভিক্ষা চেয়ে বলেছিলেন-আমি রোজাদার। আমাকে তোমরা মেরেই যখন ফেলবে তবে ইফতারটা করার সময় দাও।

প্রত্যক্ষদর্শী আবু তাহের এ কথা জানিয়ে আফসোসের সুরে বলেন, নরপিশাচরা সেই সুযোগটিও দিল না।

গত বৃহস্পতিবার বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে পিএমখালী ইউনিয়নের চেরাংঘর স্টেশনবাজারে ইফতারি কিনতে গিয়ে খুনের শিকার হন ওই ইউনিয়নের মাইজপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মোরশেদ আলী প্রকাশ মোরশেদ বলি (৪০)।

মোরশেদ বলি এক দশক ধরে পরিবার নিয়ে সৌদি আরবে প্রবাস জীবনের পর দুই বছর আগে গ্রামে ফিরেন। তিনি গ্রামে এসে মাছের ঘেরসহ ক্ষেত-খামার শুরু করেন। এলাকায় আসার পর থেকে পানি সেচ প্রকল্প নিয়ে স্থানীয় বিএনপি নেতা ও সাবেক মেম্বার মোহাম্মদুল হকের সঙ্গে বিরোধের সৃষ্টি হয়।

ঘটনার সময় নিহত মোরশেদ বলী যখন চেরাংঘর স্টেশনের তরকারি দোকানের সামনে এসে কেনাকাটা করছিলেন তখনই আওয়ামী লীগ নেতা সিরাজুল মোস্তফা আলাল এবং যুবলীগ নেতা জয়নাল আবেদীন গলিটি ঘিরে লোকজনের আসা-যাওয়ার পথ বন্ধ করে দেয়।

এসময় দুজনই সমস্বরে বলতে থাকেন-ওপরের নির্দেশ আছে মোরশেদ বলীকে মেরে ফেলার জন্য। এমন হুঁশিয়ারির সঙ্গে সঙ্গেই মামলার এক নম্বর আসামি আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল মালেক তার হাতের লম্বা কিরিচ নিয়ে প্রথমে মোরশেদের মাথা লক্ষ্য করে কোপ মারে।

এরপর সৌদি আরব থেকে হত্যার মিশন নিয়ে আসা আসামি মোহাম্মদ আলী প্রকাশ মোহাম্মদ হাতুড়ি দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য মোরশেদের অন্ডকোষে বারবার আঘাত করে।

ঘটনার অন্যতম প্রধান নায়ক আসামি মোহাম্মদুল হক এ পর্যায়ে ধারাল কিরিচ দিয়ে মোরশেদের ডান হাতের কব্জিতে কোপ দিয়ে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।

এরপর জাহাঙ্গীর আলম, মতিউল ইসলাম, ছৈয়দুল হক, হামিদুল হক, তাহেরুল ইসলাম, ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি ও মেম্বার আরিফুল্লাহ, আক্কাস, শাহিন, খোরশেদ আলম, সৈয়দ মোহাম্মদ আলী প্রকাশ আলী ভাইয়ের ভাই মাহমুদুল করিম ও গ্রেফতার হওয়া দিদারুল আলম, আবদুল্লাহ, আবদুল আজিজ, আবদুল হাই, উমর ফারুক, ইয়াছিন, সাইফুল ইসলাম, ওসমান, আজহারুল ইসলাম ও জাহেদুল ইসলামসহ অন্যান্যরা ছোরা, লোহার রড দিয়ে মোরশেদকে উপর্যুপরি আঘাতে আঘাতে ঝাঝরা করে ফেলে। এলাকার লোকজনের মতে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু নিশ্চিত করে সংঘবদ্ধ খুনির দল এলাকা ছাড়ে।

নিহত মোরশেদ বলির ছোট ভাই ও মামলার বাদী শিক্ষানবিশ আইনজীবী জাহেদ আলী জানান, স্থানীয় বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ১১ জনের একটি সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরে আমাদের এলাকাজুড়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে আসছিল। তারাই আমাদের পরিবারের সেচ পাম্পটি দখলে নিয়ে কৃষকদের জিম্মি করে অতিরিক্ত টাকা আদায় করছিল। এমনকি সিন্ডিকেট সদস্যরাই এলাকায় করছিলেন ভূমিদস্যুতা থেকে যাবতীয় অপকর্ম।

তিনি বলেন, নিহত মোরশেদ অন্যায়ের বিরুদ্ধে একটু প্রতিবাদী ছিলেন। তিনি সিন্ডিকেটের অবৈধ কাজের প্রতিবাদ করতে গিয়েই খুনের শিকার হলেন।

মামলার বাদী জাহেদ আলী জানান, সাবেক ইউপি মেম্বার ও বিএনপি নেতা মোহাম্মদুল হক সেচ পাম্পটি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে তার চাচাত ভাই এবং ইউনিয়ন যুবলীগের সহ সভাপতি ও আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল মালেকের মাধ্যমে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের নিয়ে সিন্ডিকেটটি গঠনে অন্যতম ভূমিকা পালন করেন।

কক্সবাজার সদর মডেল থানার ওসি মুনিরুল গিয়াস বলেন, মোরশেদ হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে মামলা রেকর্ড করা হয়েছে। ইতোমধ্যে মামলার তিন আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশ আসামিদের গ্রেফতারের জন্য অভিযান অব্যাহত রেখেছে।-যুগান্তর

Loading