কখন দিলেন এতো ভালবাসা ম্যাম

প্রকাশিত: ৬:২২ অপরাহ্ণ , আগস্ট ১১, ২০২১

সাহিদা সাম্য লীনা

আমি আজ পর্যন্ত লেখাপড়ায় আছি। মানে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার স্তর হাঁটছি । জীবনের একটা বড় সিদ্ধান্তের কারণে সঠিক সময়ে শেষ করতে পারিনি। তবে কিছু ডিগ্রি মানুষ যখন তখন নিতে পারে। ২০১৮-১৯ ব্যাচের শিক্ষার্থী আমি প্রেস ইন্সটিটিউট বাংলাদেশ-পিআইবির : সাংবাদিকতায় ¯œাতকোত্তর ডিপ্লোমার।

আমি এই দিকে সৌভাগ্যবান ভাল ভাল টিচারদের সান্নিধ্য পেয়েছি। তার মধ্যে এই ডিপ্লোমা পড়তে এসে যাকে চিনেছি ,পেয়েছি তিনি কামরুন নাহার রুমা ম্যাম। অত্যন্ত মেধাবী,গুণি এই ম্যাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের একজন ছাত্রী। কর্মজীবনও শুরু করেন ডেপোডিল ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতার শিক্ষক হিসেবে। পরে আসেন পিআইবিতে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে। আমাদের ডিপ্লোমায় তিনি কো-অডিনেটর ছিলেন অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে।


এতো মুক্তমনা, আধুনিক ,উচ্ছল, প্রাণবন্ত, মিশুক, উদার,শালীনবোধ নারী মন একমাত্র তার মাঝেই দেখেছি। এতোটা ছাড় দিতে পারতেন, ভালবাসতে,আপন করে নিতে পারতেন । তুলনা নেই। দুর্দান্ত সাহসী। সময়ের যতো অনাকাঙ্খিত ঘটনা দুর্ঘটনা তিনি সহ্য করতেন না। সমাজের লেপ্টে থাকা দাগগুলোর ট্যাগ মারা দেয়ালে তিনি আহত সুরে প্রতিবাদ জানাতেন। মেয়েদের প্রতি অবমাননাকে কখনো মেনে নেন নি। দুদার্ন্ত লেখায় সেসব উঠে আসতো। সরকারি চাকরী করতেন বিধায় অধিকাংশ সময়ে চুপ থাকার নীতিতে প্রতিবাদী হতেন।

একজন ক্রীড়ামোদি মানুষ ছিলেন। স্পোটর্স সাংবাদিকতাও করেছেন ডেইলি অবজারভার ও কিছু দিন প্রথম আলোতে কাজ করেছেন। তথ্য মন্ত্রণালয়ে ছিলেন কিছুকাল।

খেলার জন্য এতো পাগল ছিলেন । পুঙ্খানুপুঙ্খ খেলা বুজতেন।ফেসবুকে লিখতেন সেসব পোষ্টে। খাবার প্রিয় মানুষটা মজার মজার রেসিপি যোগে রেঁধে খাওয়াতেন ভালবাসতেন, খেতেন খেলা দেখতে দেখতে। ভ্রমণ প্রিয় মানুষটা ঘুরেছেন দেশের এ প্রান্ত ওপ্রান্ত! প্রচন্ড মজা করা,কৌতুক করা মানুষ। আনন্দে, উদ্বেলিত থাকতেন রোজ! ৪ আগষ্ট ফেসবুকে শেষ পোষ্টটাও মজা করে লিখে বার্তা দিয়েছেন হাসপাতাল থেকে – ”বেড়াইতে আইসি। ভাব্লাম অক্সিজেন খাইয়া যাই।আমার অরোলা হইছে।”

করোনা মহামারি শুরু থেকে তিনি খুব সচেতন ছিলেন। নিয়মিত অফিস করতেন। ফেসবুকে একবার লিখেছেন একটু তো বাইরের অক্সিজেনও নিতে হবে। আমি রুমে দরজা বন্ধ রেখে মাস্ক খুলে রাখি। এমন একটা মানুষকে করোনা পরাজিত করে দিবে কে ভেবে রেখেছিল? ঘুনাক্ষরেও যে বুঝতে পারিনি।

ম্যামের গড়া শত শত শিক্ষার্থী, সহকর্মীরা গত পাঁচদিনে দোয়া করেছে ,আশায় বুক বেঁেধছে ম্যাম হাসিখুশির এই মায়ায় যেন আবার ফিরে আসে। কিছু ছাত্র রাতদিন একাকার করেছে ,ছুটেছে ম্যামের জন্য ঔষধ ,ইনজেকশন আনতে।

দেশের দুনীর্তির প্যাঁচ ম্যামের চিকিৎসা সেবায়ও পড়েছে। দ্বিতীয় ইনজেকশনটা কোথাও পাচ্ছিলনা। ১ লাখ ২৫ হাজার দামের টিকাটা যখন পায় ততোক্ষণে ম্যামের ফুসফুসের অবস্থা ৪০%!
তবু প্রত্যাশায় থাকে আপনজন শুভাকাঙ্খীরা। সেই মনের টানে সবাই অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু না ভাগ্য বিধাতা ম্যামকে এই জাদুর মায়ার পৃথিবীতে দ্বিতীয়বার ব্যাক হতে দেয়নি। সবাইকে কাঁদিয়ে ম্যাম চলে যায় অচেনা ভূবনে।

গতকাল সোমবার সকালে ফেসবুক খুলে নিউজফিডের প্রথমেই ম্যামের মৃত্যুর খবর দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ি। সাহেবকে ম্যামের কথা বলতে বলতে কাঁদলাম । সারাদিন রাতে, ঘুমেও ম্যামের সুন্দর, পবিত্র মুখ খানা।আজ ভোরে আজানের সাথে ঘুম ভাঙ্গে। ম্যামের কথা আবার মাথায় জেগে উঠে। কোথায় আছে তিনি, কি করে আছে কবরে ! জলদি, ওযু করে নামাজ পড়ি।

দোয়া করি ম্যামের জন্য। পরম করুণাময় যেন উনার সব গুণাহ ক্ষমা করে দেন। গত দিন থেকে সারাদিন এই দোয়াই করেছি। যতদিন এই ব্যাথাটা মুছবে না ততোদিন দোয়া করি মহামারির এই কঠিন আঘাতের কারণে হলেও ম্যামকে আল্লাহ মাফ করবেন।

আহারে ম্যাম! কত স্বপ্ন মায়াবী ওই চোখে ছিল! মাত্র ৩৯ বছর বয়স। কত ভালবাসতেন উনার স্বামীকে।লেট ম্যারেজে উনার মনে একটু দ্বিধা থাকলেও বুজতাম খুব সুখে ছিলেন। ফেসবুক পোষ্ট সহ আমাদের সাথে ক্লাসে লেকচারের ফাঁকে অনেক গল্প আসতো। কতো কথা, কত স্মৃতি শেষ হবে না এই দুই বছরের । জুনে উনার সাথে শেষ দেখা।

প্রচন্ড শাড়ী পাগল মানুষ ছিলেন। এমন শাড়ি পরা প্রিয় মানুষ আমি দেখিনি। যতটা দেখেছি কামরুন নাহার ম্যামের ক্ষেত্রে। পরে পরে সুন্দর, সুন্দর পিক দিতেন। কিছু ছবিতে লিখতেন উনার বরের ক্যাপচারে তোলা। এতো রসিক ,দিলখোলা মানুষটা আজ নেই ; গত দিন থেকে এই ধরাধামে।

বিশ্লাস হচ্ছে না। প্রথমে মানতে পারিনি। পিআইবিতে কেমনে যাব ভাবছি। ওখানে গেলে ম্যামের খোঁজে আমরা ছুটবো এই তো স্বাভাবিক।

শিক্ষক ছাত্রের সম্পর্ক টা আমরা ছোটবেলায় দেখেছি সন্মাণের, ভয়ের, দূরত্বের।কিন্তু কামরুন নাহার ম্যাম দেখলাম এই ডিজিটাল যুগের শিক্ষকের আধুনিক ভার্সন। তিনি তার ছাত্রঝছাত্রীদের কেবল শিক্ষক ছিলেন না। ছিলেন পরম বন্ধু। আমরা ডিপ্লোমার ছাত্রছাত্রীরা যদি এতো মায়ায়, এতো ভালবাসায় পড়ে যাই তাহলে উনার অগণিত রেগুলার ছাত্রছাত্রীরা কি হতে পারে! হ্যাঁ ,সেসব জেনেছি কেমন ছিলেন ওদের সাথে। তিনি বলতেন সব। আর পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত উনার লেখায় পড়েছি। একজন শিক্ষক যে কত বড় বন্ধু হতে পারে, মনের কথা বলার পরম আস্থা হতে পারে তা ম্যামকে না দেখলে, বুজতাম না।

প্রয়োজনীয় মানুষ কেন যে ,এতো জলদি চলে যায়, আরো কত কিছু এই দেশকে ,এই সমাজকে উনার দিবার ছিল। জীবন তো সবে শুরু হয়েছিল! ঢাকা শহরে ব্যস্ত শহরময় একজন নির্ভরতার শিক্ষক যদি বলা হয় এই কামরুন নাহার ম্যাম।

গত বছর একটি কাজে আমাকে ডিজির কাছে যেতে হয়। ম্যাম তা জানতেন। কিন্তু আশস্ত কথা না পাওয়ায় ম্যামের কাছে জানাই। ম্যাম দেখলো আমি প্রচন্ড মর্মাহত। তিনি তখনি ফোন দিয়ে আমাকে শান্তনা দেন। একটা লাইন মনে পড়ে- ডিজি আসবে যাবে, কিন্তু আমরা টিচাররা সবসময় আছি।

আপনি যেকোন সমস্যা আমাদের বলবেন।আমরা আপনাকে সহযোগিতা করার চেষ্টা করবো। দশটা কথার একটা বুঝেই শান্তি হয়ে যাই।

মানুষ পৃথিবীতে সাময়িক সময়ের অতিথি। মৃত্যু আসা না অবধি তা আমরা বুঝতে পারি না। মানুষ, মানুষের জন্য। একেক জন একেক ভাবে মায়া লাগায়। ক্ষনিক মায়ার অপার বাঁধনে কখন যে জড়িয়ে যায় বুঝি না।

ম্যাম যে মায়া জাগিয়ে গেল তা কখনো ভোলার নয়।সময় ¯্রােত কোথায় ঠেকে আমরা জানি না। নিষ্ঠুর করোনা আমাদেরও কোন পর্যায়ে নিয়ে দাঁড় করাবে অজানা। শুধু জানি,যদি বেঁচে থাকি আমার হৃদয় পটে যারা ,যারা আঁচড় দিয়ে গেছেন তাদের নিয়ে একটা লাইন হলেও যেন বলতে পারি।দোয়া করতে পারি । ম্যাম আপনাকে যে এতো ভালবাসি কাল সকালে আপনার মৃত্যুর খবরে হাইমাউ করে কাঁদাতে বুঝেছি।

আসলেই ম্যাম আপনি একজন জিনিয়াস বন্ধু , শিক্ষক । আফসোস আর পাব না আপনাকে । মিষ্টি হাসি দিয়ে বলবেন না লীনা কি খবর. সব ঠিক তো! আহারে ম্যাম!

Loading