চাপের মুখে বাংলা ভাষা নিউজ ৭১ অনলাইন নিউজ ৭১ অনলাইন প্রকাশিত: ১০:৩২ পূর্বাহ্ণ , ফেব্রুয়ারি ৪, ২০২১ হাবিবুর রহমান বাংলা ভাষা এখন বহুমুখী চাপের মুখে। দেশে ইংরেজি এবং পশ্চিমবঙ্গে হিন্দি ও ইংরেজি ভাষা বাংলাকে প্রবল চাপের মধ্যে ফেলেছে। তবে বাংলাদেশে বাংলা ভাষার অবস্থা পশ্চিমবঙ্গে বাংলার মতো অতটা ত্রিশঙ্কু নয়। পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতার রাস্তায় বাংলায় লেখা সাইনবোর্ড বা হোর্ডি চোখেই পড়ে না।তবে তৃণমূল সরকারের আমলে কলকাতা শহরে বাংলায় লেখা বিলবোর্ড প্রচুর দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। কলকাতার রাস্তাঘাটে, বিপণিবিতানে বাংলার চেয়ে হিন্দি ভাষায় বেশি মানুষ কথা বলে। অনেকে বিষয়টির পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন এ কথা বলে যে, কলকাতা একটি কসমোপলিটন শহর।এ শহরে নানা জাতের, নানা ভাষার, নানা সংস্কৃতির প্রচুর মানুষ বাস করে। তাই এখানে হিন্দির ব্যবহার বেশি হবে এটা স্বাভাবিক। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে তো বাংলাই প্রধান ভাষা।কিন্তু কলকাতা শহরে হিন্দির ব্যাপক ব্যবহার শুধুই কি কসমোপলিটন সিটির কারণে? নাকি এর জন্য সেখানকার মানুষের মাতৃভাষার প্রতি কিছুটা অবহেলা এবং দিল্লির শাসকদের হিন্দি সম্প্রসারণবাদী নীতি দায়ী? বহুদিন আগে কলকাতার একটি আবাসিক হোটেলে ম্যানেজারের সঙ্গে কথা হচ্ছিল।মধ্যবয়সী লোকটি কলকাতার স্থায়ী বাসিন্দা কিন্তু অবাঙালি। আমি বাংলায় প্রশ্ন করছিলাম আর তিনি উর্দুতে উত্তর দিচ্ছিলেন। তার অনেক কথাই বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল। লোকটি ইংরেজিতে সাবলীল ছিলেন না। বললাম, বাংলায় বলুন। বললেন, বাংলা নেহি আতা! বিস্মিত হয়েছিলাম এতদিন কলকাতায় থাকছেন অথচ বাংলা জানেন না, এটা কী করে হয়! বাংলা ভাষার এ অবজ্ঞা কেন?সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একবার বলেছিলেন, ভবিষ্যতে ঢাকা হবে বাংলা ভাষার রাজধানী। তিনি কী ভেবে বলেছিলেন জানি না। তবে অমূলক বলেননি। পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী চন্দ্রিল ভট্টাচার্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন- ‘একটি দেশে বা শহরে কোন ভাষা চলবে তা ঠিক করে সেখানকার উচ্চকোটির মানুষেরা।’পুঁজিপতি, ব্যবসায়ী, শিল্পপতিরাই আদতে ভাষার ক্ষেত্রে মূল নিয়ামক শক্তি। কারণ পুঁজি তাদের কাছে, তাই ক্ষমতাও তাদের হাতেই। পশ্চিমবঙ্গে পুঁজিপতি ও ব্যবসায়ীরা মূলত অবাঙালি।বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও যেন এ কথা সত্য হতে চলেছে। যেভাবে দেশে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করার হিড়িক পড়েছে তাতে প্রতীয়মান হচ্ছে বাংলাদেশেও পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি তৈরি হতে বেশিদিন লাগবে না। দেশের উঠতি বড়লোক ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি এখন তাদের সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যমে পড়াতে অতি আগ্রহী।ঢাকার একজন স্বল্পশিক্ষিত ধনী মানুষ তাদের সন্তানদের একটি নামকরা ইংরেজি মাধ্যমে পড়াচ্ছেন। তার ভাষ্য হচ্ছে, ‘বাংলায় আর কাম হইবো না।’ বললাম, আপনি তো কাজ ভালোই চালাচ্ছেন, তাহলে আপনার সন্তানদের হবে না কেন? উত্তর দিলেন- ‘আমাগো দিন শ্যাষ, অহন ইংরেজি ছাড়া চলন যাইব না।’আসলেই কি বাংলা ভাষার দিন শেষ হতে চলছে? গ্লোবালাইজেশনের কারণে ইংরেজি ভাষার প্রয়োজনীয়তা অনেকাংশে বেড়েছে। এ কথা অস্বীকার করা যাবে না। একটি আন্তর্জাতিক ভাষা শিখেও কি মাতৃভাষা চর্চা করা যায় না? ইউরোপের প্রায় সব জাতির মানুষ নিজের ভাষার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষা শেখেন। কিন্তু তারা কাজকর্মে মাতৃভাষাকেই সর্বাগ্রে রাখেন। চীনা ও জাপানিরা মাতৃভাষাকে প্রাধান্য দিয়ে এখন বিশ্বজয়ের দ্বারপ্রান্তে।বাংলা একটি সমৃদ্ধ ও আধুনিক ভাষা। বাংলায় জন্ম নেওয়া বিশ্বসেরা মনীষীদের সাধনায় বাংলা সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি দারুণভাবে সমৃদ্ধ এবং বিশ্বজুড়ে সুনামের অধিকারী। ফলে বাংলা ভাষা নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভোগার কোনো কারণ নেই। আজ যারা বাংলা ভাষাকে অবহেলা করছেন, তাদের উত্তরসূরিদের চড়া মূল্য দিতে হবে।একটি জাতি বা জনগোষ্ঠীর প্রথম ও প্রধান পরিচয় হচ্ছে তার ভাষা। তাই ভাষা হারিয়ে গেলে মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে। বহু শতাব্দীর ও বহু মানুষের সাধনায় তৈরি হওয়া আমাদের মাতৃভাষাকে অবহেলায় অপাঙ্ক্তেয় হতে দেয়া যায় না কোনোক্রমেই। তাই বাংলা ভাষা আরও গভীরভাবে অনুশীলন ও ব্যবহার করা আমাদের ভবিষ্যৎ মঙ্গলের জন্যই জরুরি।হাবিবুর রহমান : প্রাবন্ধিক ##যুগান্তর শেয়ার অতিথি কলামবিষয়: