কবি ওমর আলীর একটি চিঠি এবং প্রাসঙ্গিক-কথা

প্রকাশিত: ১০:০৯ পূর্বাহ্ণ , অক্টোবর ২০, ২০২০

কবি ওমর আলী। বাংলা সাহিত্যে একজন বিখ্যাত কবি। তিনি ১৯৩৯ সালে আজকের এই দিনে পাবনা সদর থানার চর শিবরামপুর গ্রামে, মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও একুশে পদক প্রাপ্ত কবি। 

কবি ওমর আলী বাংলাদেশের কবিতাধারায় অভিনবত্ব সৃষ্টি করে বিস্ময় সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁর ‘এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি’ বাংলা কাব্যসাহিত্যে কিংবদন্তিতুল্য কাব্যগ্রন্থ। এ গ্রন্থের অনেক কবিতা সেসময় পাঠকের মৃখে মুখে উচ্চারিত হতো। আমার এ আলোচনা সেদিকে নয়। তাঁর সাথে আমার যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল এবং আমাকে লেখা তাঁর একটি চিঠির প্রসঙ্গ নিয়েই এ আলোচনা-সীমাবদ্ধ।

কবি ওমর আলী আমার সরাসরি শিক্ষক। তার সাথে আমার অনেক স্মৃতি। ক্লাসে-ক্লাসের বাইরে-তাঁর বাড়িতে-পরিবারের সাথে-পথেঘাটে বহু স্মুতি রয়েছে আমার। আমি কবিতা লিখি-কবিতা ভালোবাসি-এ কারণেই আমি তার স্নেহধন্য হয়ে উঠতে পেরেছিলাম মনে করি। কবি ওমর আলী পাবনা সরকারি শহীদ বুলবুল কলেজে ইংরেজি বিভাগের প্রধান ছিলেন। আমি সেই কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়েছি। আমি ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়ে চলে এলেও তাঁর সাথে আমার শেষপর্যন্ত নিয়মিত যোগাযোগ ছিল-মাঝেমধ্যে দেখা-সাক্ষাতও ঘটতো। আমার বাড়ি থেকে তাঁর বাড়িটা বেশি দূরের নয়। কুষ্টিয়ার কুমারখালীর কয়া গ্রামে অঅমার বাড়ি। কবি ওমর আলীর বাড়ি শিলাইদহ পদ্মার ঘাট পেরিয়ে সাইকেলে পনের বিশ মিনিটের পথ। আমি বাড়িতে গেলেই সাইকেলে স্যারের বাড়িতে চলে যেতাম। স্যার খুশি হতেন।

আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অনিয়ম চুম্বনের সিঁড়ি ধরে’-এর দ্বিতীয় সংস্করণ সবেমাত্র তখন হাতে পেয়েছি। সেসময়ে আমার আরো কিছু বই বেরিয়ে গেছে। পত্রিকাতে নিয়মিত লেখা বেরুচ্ছে- এসব ওমর আলী স্যারের দৃষ্টিগোচরে ছিল। ‘অনিয়ম চুম্বনের সিঁড়ি ধরে’ কাব্যগ্রন্থে স্যারকে নিয়ে লেখা একটা কবিতা ছিল। আমার উপন্যাস ‘ভাঙন’ও তখন বেশ আলোচিত। এ উপন্যাসেও প্রাসঙ্গিকভাবে স্যারের কবিতার প্রসঙ্গ ছিল। স্যারের নাম উল্লেখ করেই। ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে এক সকালে সাইকেলে চড়ে স্যারের বাড়িতে হাজির হই। স্যার তখন বাড়ির দেঁউড়ির পাশে বাঁশঝাড়ের ছায়ায় খেজুরপাতার পাটিতে বসে কবিতায় ধ্যানমগ্ন। কবিতা লিখছেন। আমাকে দেখেই খুশি হলেন। হাসিমুখে পাশে বসতে বললেন। আমি আমার দুটি বই স্যারকে দিই। স্যার বউ দুটি গভীর মনোযোগ সহকারে নেড়েচেড়ে দেখে রেখে দিলেন। নিজের থেকেই বললেন, ‘রকিব, তোমার লেখা আমি পড়ি। তোমার এই বই দুটি পড়ে আমি জানাবো।’

স্যারের সঙ্গে বেশকিছু সময় কাটিয়ে আমি ফিরে আসি। স্যার মোবাইল ব্যবহার করতেন না। যোগাযোগ করা কঠিন ছিল। স্যার আত্মভোলা মানুষ ছিলেন। আমার বই পড়ে আমাকে তাঁর জানাবেন-এটা তো একরকম অবিশ্বাস্যই। নিজের ঘর-সংসার এমনকি নিজেকেও ভুলে থাকা মানুষ তিনি-সাধারণ এক ছাত্রের বই পড়ে আবার তাকে নিজের মতামত জানাবেন-এটা ভাবাও কঠিন।

একদিন সব ভাবনা বিস্ময় দূর করে স্যারের একটা খাম এলো আমার ঢাকার বাসার ঠিকানায়। খামটা হাতে নিয়ে ভাবছি, এটাও সম্ভব! স্যার আমাকে চিঠি লিখেছেন! খামটা খুলি অপার এক আনন্দে। বিস্ময় আরো বাড়ে-প্রখ্যাত কবি ওমর আলী আমার বই নিয়ে আলোচনা লিখে চিঠির সাথে যুক্ত করে দিয়েই ক্ষ্যান্ত হননি, এটা কোথায় ছাপতে দিতে হবে-কার কাছে লেখাটা পৌঁছাতে হবে-সব নির্দেশনা চিঠিতে উল্লেখ করে দিয়েছেন। এটা কী একজন ছাত্রের প্রতি শিক্ষকের গভীর স্নেহবোধ! জানিনা। আনন্দে আমার চোখ ভিজে ওঠে। আমি তো কবি ওমর আলীকে খুব কাছ থেকে দেখেছি-জেনেছি। নিজেকে ভুলে থাকা কাব্যসাধক এ-মানুষটির কাছ থেকে এ পাওয়া যে কতো বড় পাওয়া তা বলে বোঝাতে পারবো না। যা শুধুই অনুভব করা যেতে পারে।

আমি স্যারের নির্দেশনা মোতাবেক আমার কাব্যগ্রন্থ ‘অনিয়ম চুম্বনের সিঁড়ি ধরে’ এর একটা কপি ও আলোচনাটা নিয়ে- সে সময়ের বিখ্যাত ‘দৈনিক আজকের কাগজ’-এর সাহিত্য সম্পাদক কবি শামীম রেজার কাছে পৌঁছে দিই।এখানে উল্লেখ্য যে, স্যার চিঠিটি লিখেছিলেন ১৫ জুলাই ২০০৬ সালে। এটা আমার হস্তগত হওয়ার পরের দিনই দৈনিক আজকের কাগজে গিয়ে কবি শামীম রেজাকে দিয়েছিলাম। কবি শামীম রেজা স্যারকে অসম্ভবরকম সম্মান করতেন। তিনি এটা হাতে পেয়ে খুশিমুখে বলেছিলেন, ‘সামনের সংখ্যাতেই ছেপে দেবো।’ পরের সপ্তাহে দেখি দৈনিক আজকের কাগজের সাহিত্যপাতা সুবর্ণরেখায় লেখাটা প্রকাশিত হয়েছে। তারিখটা ছিল ২৪ আগস্ট ২০০৬। স্যারের প্রতি কবি শামীম রেজার অতল এই শ্রদ্ধাবোধ আমাকে মুগ্ধ করেছিল। প্রসঙ্গক্রমেই কবি ওমর আলীর সেই আলোচনাটা এখানে পুরোটাই তুলে ধরছি।

অনিয়ম চুম্বনের সিঁড়ি ধরে
ওমর আলী
এই কব্যগ্রন্থের কবি রকিবুল হাসান। তিনি ঔপন্যাসিক আকবর হোসেনের কয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার কবিতাগুলো পাঠকের মনে সাড়া জাগাতে সমর্থ হবে। রকিবুল জীবনকে খাঁটিভাবে দেখেছেন। তার প্রতিটি কবিতা সম্পূর্ণ ও আমেজময়। গোটা কবিতা একটা প্রচ্ছন্ন কাহিনী তুলে ধরে। সমাজের নারী হত্যা, ভালোবাসার ব্যর্থতা ও হাহুতাশ রকিবুল হাসানের কবিতার উপজীব্য বিষয়। তিনি নিসর্গকে দেখেছেন এবং তার কল্পনাশক্তি প্রখর। তার কবিতা কোমলভাবে আমাদের মনকে নাড়া দেয়। যেমন- ‘অনিয়মের সিঁড়ি ধরে হাঁটছি একাকী/ দোচালা টিনের চন্দনমাখা রাতে যে তুমি সুন্দর/ চুম্বনের প্রজাপতি জুড়ে থাকে রাঙা ঠোঁটে কবিতা হয়ে/ সে তুমি রাতের দুপুরে হৃদপিণ্ডে একগুচ্ছ চেতনা আমার’ (অনিয়ম চুম্বনের সিঁড়ি ধরে)। ভালোবাসার ছদ্মবেশে রয়েছে আমাদের সমাজে খুনি। রকিবুল হাসান বলেন, ‘শ্যামলী, তুমি কাকে জড়িয়েছ শরীরে/ ভালোবেসে প্রচুর সুরভি আর সৌন্দর্য ভেবে’ (শ্যামলী)। কবি আরো বলেন, একই কবিতায় প্রেমিক পুরুষের নিষ্ঠুরতা, প্রতারণা এবং কপটতা সম্পর্কে, ‘শ্যামলী, তুমি যাকে জড়িয়েছ শরীরে/ সেখানে কি পেয়েছ একমুঠো বিশ্বাস/ প্রকৃত সুগন্ধ?/ একদিন প্রেমিকের মধু সম্ভাষণ ফণাধারী সাপের ছোবল হয়ে দেখা দেয়/ একদিন প্রেমিকের দশটি সুকোমল আঙ্গুল/ ঘাতকের হাত হয়ে দেখা দেয়/ গোলাপের ভাঁজের মতো তাজা কণ্ঠনালীতে।’

কবি রকিবুল হাসান বিগত প্রেমের কথা তুলে ধরেন ‘নীহারিকা’ কবিতায়। ঘরের রমণী এই অভাব মেটাতে পারে না। কিন্তু নীহারিকাকে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে পেলে সুখ হতো। তিনি বলেন, ‘সাত বছর আগে নীহারিকার কাছে একদিন/ আমি তো ফেলে এসেছি প্রকৃত ‘আমি’কে/..সাত বছর আগেকার নীহারিকা পারভীন/ সে আমার কবিতার সুকেশী সমুদ্র সুঘ্রাণ।’ এই সমালোচককে উৎসর্গীত একটি কবিতা চমৎকার আবহ সৃষ্টি করেছে, ‘তারপর একদণ্ড ফিরে দেখি/ তৃষ্ণার্ত অস্থির এক প্রিয় পাখি/ এক ব্যাগ ধুলোবালি কাঁধে নিয়ে ফিরছে প্রতিদিন/ শহর থেকে গাঁয়ের পথে পা’র শব্দ মেখে/ তারপর একদণ্ড ফিরে’- কী চমৎকার কাব্যিক বর্ণনা গ্রামে বসবাসকারী বাংলাদেশের একজন বরেণ্য কবি সম্পর্কে-যিনি প্রতিদিন ময়লা ধূলিবালিমাখা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে প্রতিদিন শহরে যাতায়াত করেন। ঐ কবিতায় রকিবুল হাসান আরো বলেন,  ‘তারপর একদণ্ড ফিরে দেখি/ বুকপোড়া সেই পাখিটির বুকের ভেতর/ শাদা ধবধবে মসৃণ কাগজের পাতায় মাথা উঁচু করে/ একটি কবিতা শুধু একটি কবিতা-জীবনের কবিতা।’ কী সুন্দর দক্ষতায় রকিবুল হাসান প্রোট্রেট এঁকেছেন প্রকৃতভাবে একজন গ্রামে বসবাসকারী আধুনিক কবির। কারণ এই কবি গ্রামে থেকেও তার জীবন সমৃদ্ধ নিসর্গে ভরপুর কবিতা রচনা করেন রবীন্দ্রনাথের মতো কোলকাতা শহর ছেড়ে এসে। রকিবুল হাসানের মতো আমাদের আরেকজন কবির কথা মনে পড়ছে, তিনি আবুল হাসান। রকিবুল হাসানও তার মতো মিষ্টি কবিতা লেখেন। তার কবিতার বাক-প্রতিমা বাক-চাতুর্য মুগ্ধ করে। তিনি নব্বই দশকের একজন সফল কবি নিঃসন্দেহে। জীবন সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা ব্যাপক। সর্বশেষে আর একটি কবিতার উদাহরণ দিতে চাই- সব আগুন নিভে যায়/ শুধু/ হিংসার আগুন/ শুধু/ হিংসার আগুন/ নেভে না/ নেভে না/ নেভে না।’

বইটির ছাপা নির্ভুল ও সুন্দর হয়েছে। প্রচ্ছদ ও কাগজ চমৎকার। অনীক মাহমুদ যথার্থই বলেছেন, ‘হৃদয়বেদ্য এই কাব্যের কবিতাগুলো পাঠকদের ভালো লাগবে বলে আমি একান্তভঅবে মনে করি।’ আমারও একই মত।

কবি ওমর আলী-যিনি আমার শিক্ষক ছিলেন-যাকে দেখে কবিতার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়েছিল অনেক বেশি-কখনো ভাবিনি আমাকে লেখা তাঁর চিঠি এবং আমার বইয়ের আলোচনা নিয়ে আমাকেই একদিন লিখতে হবে। এমনটা চিন্তা করলে হয়তো বইয়ের আলোচনা কপিটাও কবি শামীম রেজার কাছে পৌঁছে দেয়ার আগেই ফটোকপি করে নিজের সংগ্রহে রেখে দিতাম। এসব ভাবনায় কখনো আসেনি। প্রিয়ভাজন আতাউল হক মাসুমের তাগিদেই সে ভাবনার জন্ম এবং এ লেখার প্রয়াস। তার প্রতি কৃতজ্ঞতা থাকছে।

(লেখক : কবি-কথঅসাহিত্যিক-গবেষক। বিভাগীয় প্রধান, বাংলা বিভাগ, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ।)

Loading