রুমায় ব্যাংক লুটের একদিনের মাথায় থানচিতে দুই ব্যাংকে লুটপাট

প্রকাশিত: ২:৪৯ পূর্বাহ্ণ , এপ্রিল ৪, ২০২৪

পাহাড়ি জনপদ সশস্ত্র সংগঠন কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) দীর্ঘদিন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছে। চাঁদাবাজি ও অপহরণের পর এবার তারা ব্যাংক লুটে নেমেছে। রুমা উপজেলায় ব্যাংক লুটের একদিনের মাথায় থানচি উপজেলার দুটি ব্যাংকে সন্ত্রাসীরা লুটপাট চালিয়েছে। মঙ্গলবার রাতে বান্দরবানে সোনালী ব্যাংক এবং বুধবার থানচিতে সোনালী ও কৃষি ব্যাংকে তাণ্ডব চালানো হয়। এসব ঘটনার পর রুমা, থানচি ও রোয়াংছড়ি উপজেলার সব ব্যাংকে লেনদেন সাময়িক বন্ধ রাখা হয়েছে। রুমার ব্যাংক ম্যানেজারকে এখনো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তার মুক্তিপণ হিসাবে ১০ লাখ টাকা দাবি করা হয়েছে। এদিকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) জানিয়েছে, রুমার সোনালী ব্যাংকের শাখা থেকে কোনো টাকা খোয়া যায়নি। ভল্টে সব টাকা অক্ষত আছে।

সোনালী ব্যাংকের বান্দরবান জেলা কার্যালয়ের ডেপুটি ম্যানেজার জেনারেল (এজিএম) ওসমান গনি জানান, রুমায় ব্যাংকের ভল্ট খুলতে না পারায় কোনো টাকা খোয়া যায়নি। ভল্ট খুলে সব টাকা পাওয়া গেছে। তবে থানচি সোনালী ব্যাংকের শাখা থেকে ১৫ লাখ টাকা লুট করেছে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনায় নিরাপত্তা বিবেচনায় বান্দরবান জেলা সদর ছাড়া রুমা, থানচি, রোয়াংছড়ি, লামা, আলীকদম, নাইক্ষ্যংছড়ি-এ ছয় উপজেলায় ব্যাংকিং কার্যক্রম সাময়িক বন্ধ রাখা হয়েছে।

খবর পেয়ে সেনা, বিজিবি, পুলিশসহ প্রশাসন-আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এ ঘটনার পর ঘটনাস্থলসহ আশপাশের এলাকাগুলোয় নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করে থানচি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ মামুন জানান, ঘটনার পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়েছে। নিরাপত্তা বিবেচনায় ব্যাংকিং কার্যক্রম সাময়িক বন্ধ রাখা হয়েছে। এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতোমধ্যে যৌথ বাহিনী অভিযানে নেমেছে।

রুমায় ব্যাংক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অস্ত্রশস্ত্র লুটের ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, সন্ত্রাস দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যৌথভাবে কাজ করছে। আমাদের যথেষ্ট সক্ষমতা রয়েছে। কোনো দুষ্কৃতকারীর ভাবার কোনো সুযোগ নেই যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতার কোনো ঘাটতি আছে। হামলাকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। তিনি আরও বলেন, আমরা সতর্ক ছিলাম। দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। লুট করা অস্ত্র উদ্ধার এবং অপহৃত ব্যাংক ম্যানেজারকে উদ্ধারে যৌথ বাহিনী অভিযান চালাচ্ছে।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিশেষ পুলিশ সুপার শাহনেওয়াজ খালেদ জানান, রুমা উপজেলার সোনালী ব্যাংকের শাখা থেকে কোনো টাকা লুট হয়নি। ওই ব্যাংকের ভল্টে থাকা সব টাকা অক্ষত আছে। বুধবার বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে তিনি বলেন, সিআইডির চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার ইউনিটের দুটি দল রুমায় গিয়ে বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করেছে। ব্যাংকের ভল্ট খুলে সব টাকা গুনে দেখা হয়। দেখা যায়, মঙ্গলবার রাখা ১ কোটি ৫৯ লাখ ৪৬ হাজার টাকার পুরোটাই সেখানে রয়েছে। তিনি আরও বলেন, দুটি চাবি একসঙ্গে দিয়ে ভল্ট খুলতে হয়। কোনো কারণে অস্ত্রধারী ব্যক্তিরা হয়তো ভল্ট খুলতে পারেনি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, বুধবার দুপুর পৌনে ১টার দিকে সন্ত্রাসীরা থানচি বাজারে প্রবেশ করে একটি দোকানে নাশতা করে। এরপর দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে বাজারসহ আশপাশ এলাকা ঘেরাও করে তারা ফাঁকা গুলি ছুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। এরপর তারা সোনালী ব্যাংক শাখা থেকে ১৫ লাখ এবং কৃষি ব্যাংক শাখা থেকে ২ লাখ ৪৫ হাজার টাকা লুট করে। ১৫ থেকে ২০ মিনিটের মধ্যে তারা আবার ফাঁকা গুলি করতে করতে বাজার থেকে বের হয়ে যায়। এতে কেউ হতাহত হয়নি। কাউকে অপহরণও করা হয়নি। এ সময় ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছ থেকে ১৫টি মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেওয়া হয়। প্রত্যক্ষদর্শী জানে আলম ও সাগ্যচিং মারমা বলেন, চারদিক থেকে হঠাৎ করে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ৩০-৩৫ জন সশস্ত্র সন্ত্রাসী থানচি বাজার ঘেরাও করে। ফাঁকা গুলিবর্ষণ করে আতঙ্ক ছড়িয়ে লোকজনের মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়। পরে সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংকে হানা দিয়ে টাকা লুট করে তারা পালিয়ে যায়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আফজাল করিম।

এদিকে রুমা উপজেলায় সোলালী ব্যাংক ও ১৪টি আগ্নেয়াস্ত্র লুটের ঘটনায় এখনো মামলা হয়নি। অপহৃত ব্যাংক ম্যানেজারকে উদ্ধার করার জন্য পুলিশ, র‌্যাব, সেনাবাহিনী অভিযান চালাচ্ছে। বুধবার সকালে জেলা প্রশাসক শাহ মুজাহিদ উদ্দিন ও পুলিশ সুপার সৈকত শাহীনের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। এদিকে পুলিশ সুপার সৈকত শাহিন বলেন, পুলিশের আটটি চায়না রাইফেল, দুটি এসএমজিসহ ১০টি অস্ত্র ও ৩৮০ রাউন্ড গুলি এবং আনসারের চারটি শটগান, ৩৫ রাউন্ড গুলিসহ ১৪টি অস্ত্র লুট হয়েছে। এ ঘটনায় কারা জড়িত, তা ফিঙ্গার প্রিন্ট সংগ্রহ করে ক্রাইমসিন টিমের সদস্যরা তদন্ত করবেন। এছাড়া সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে বলা যাবে কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে। সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে। রুমা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শাজাহান জানান, বুধবার বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত এ বিষয়ে মামলা হয়নি।

জেলা প্রশাসক শাহ্ মোজাহিদ উদ্দিন জানান, ঘটনা সম্পর্কে প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ, ব্যাংকের ভল্ট চেক করলে জানা যাবে টাকা খোয়া গেছে কি না? ব্যাংক ম্যানেজারকে উদ্ধার করার জন্য পুলিশ, র‌্যাব, সেনাবাহিনীর অভিযান অব্যাহত আছে। আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নেওয়া হয়েছে।

রুমা উপজেলা পরিষদ কার্যালয়ে ঢোকার মুখে একটি দোতলা ভবনের নিচতলায় থাকেন সরকারি কর্মকর্তারা। দ্বিতীয় তলার একপাশে সোনালী ব্যাংক রুমা শাখা। আরেক পাশে থাকেন ব্যাংকের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ১০ পুলিশ সদস্য। রুমা সোনালী ব্যাংকের ক্যাশিয়ার উথোয়াইচিং মারমা জানান, ডরমিটরির বাইরে যুব উন্নয়ন অফিসের পাশের দোকানে চা খেতে গেলে মুখে কালি লাগানো অপরিচিত তিনজন লোক অস্ত্রের মুখে আমাকে দাঁড় করায় এবং পকেটে থাকা ১ হাজার ৫০০ টাকা ও ব্যাংকের চাবি নিয়ে নেয়। পরে পুলিশ ও সেনাবাহিনী আসার পর ব্যাংকে গিয়ে দেখেন অফিস সরঞ্জামগুলো ছড়ানো-ছিটানো রয়েছে। এছাড়া তার জানামতে ভল্টে ১ কোটি ৫৯ লাখ টাকা জমা ছিল। ভল্টের দুটি চাবির মধ্যে তার কাছে একটি এবং অপহরণের শিকার ম্যানেজারের কাছে অপরটি থাকত।

এদিকে অপহৃত ব্যাংক ম্যানেজার নিজাম উদ্দিনকে মুক্তিপণ বাবদ পরিবারের কাছে ১০ লাখ টাকা দাবি করা হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। মোবাইল ফোনে টাকা দাবি করা হয়। তবে এ ব্যাপারে অপহৃতের স্ত্রী মাইছুরা ইশফাত কোনো কথা বলতে রাজি হননি। মাইছুরা ইশফাত বান্দরবান ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষিকা।

ব্যাংক ডাকাতি, মসজিদে প্রবেশ করে মুসল্লিদের মোবাইল ফোন ছিনতাই, পুলিশ-আনসারের অস্ত্র লুট ও ব্যাংক ম্যানেজারকে অপহরণের প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে বিভিন্ন সংগঠন। সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারের দাবিতে রুমা ও জেলা সদরে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়। বান্দরবান প্রেস ক্লাবের সামনে পার্বত্য নাগরিক পরিষদ আয়োজিত কর্মসূচিতে বক্তব্য দেন নাগরিক পরিষদের চেয়ারম্যান কাজী মুজিবুর রহমান, আবুল কালাম, শাহা জালাল প্রমুখ। কাজী মুজিবুর রহমান বলেন, কেএনএফ পাহাড়ের নতুন আতঙ্কের নাম। পাহাড়ে সন্ত্রাসবিরোধী সাঁড়াশি অভিযানের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামকে রক্ষা করার দাবি জানাচ্ছি

Loading