ঈদের আগেই বাড়ছে ট্রেনভাড়া

প্রকাশিত: ১২:৪৬ অপরাহ্ণ , মার্চ ১৭, ২০২৪

ঈদুল ফিতর উপলক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ রেলওয়ের ঈদযাত্রা শুরু হচ্ছে আগামী ৩ এপ্রিল থেকে। এর দুদিন আগে থেকে অর্থাৎ ১ এপ্রিল থেকে বাড়ছে রেলের ভাড়া। সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছে কর্তৃপক্ষ। এক্ষেত্রে রেয়াতি সুবিধা প্রত্যাহার করে যাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর আগে, গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে দেশে বেড়েছে বিদ্যুতের দামও।

জানা গেছে, রেলে যাত্রী পরিবহনে দূরত্ব-রেয়াতি সুবিধা প্রত্যাহার এবং অতিরিক্ত সংযোজিত কোচের টিকিট বিক্রিতে রিজার্ভেশন চার্জ আরোপ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। ট্রেনের ভাড়ায় ১০০ কিলোমিটারের পরবর্তী ১৫০ কিলোমিটার ২০ শতাংশ ছাড় দেওয়া হয়। অর্থাৎ ১০১ থেকে ২৫০ কিলোমিটারে মেলে ২০ শতাংশ ছাড়। এরপর ২৫১ থেকে ৪০০ কিলোমিটার পর্যন্ত ২৫ শতাংশ এবং ৪০১ থেকে তদূর্ধ্ব কিলোমিটার পর্যন্ত ৩০ শতাংশ ছাড় দেওয়া হয়। এই রেয়াতি সুবিধা বাদ দেওয়ার প্রস্তাব অনুমোদন পেয়েছে। এছাড়া অগ্রিম আবেদনের মাধ্যমে সংযুক্ত বাড়তি কোচ বা বাড়তি চাহিদার সময়ে সংযোজিত কোচের টিকিটে শোভন শ্রেণীর ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ, স্নিগ্ধা ও অন্যান্য উচ্চশ্রেণিতে ৩০ শতাংশ রিজার্ভেশন সার্ভিস চার্জ আরোপ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে কর্তৃপক্ষ।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক সরদার শাহাদাত আলী জানান, ট্রেনে রেয়াতি সুবিধা প্রত্যাহার করা হবে। সমন্বয় করা হবে ভাড়ার হার।

জানা গেছে, বাংলাদেশ রেলওয়ে লোকসানে জর্জরিত। এ কারণে ভাড়া বৃদ্ধির নানা যুক্তি তুলে ধরেন কর্মকর্তারা। এবারও একই পথে হাঁটছেন তারা। অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প ও অযৌক্তিক ব্যয় কমাতে না পারলেও যাত্রীভাড়া বৃদ্ধিতে অনড় রেলপথ মন্ত্রণালয়।

তাছাড়া ট্রেনে এবারের ঈদযাত্রায় টিকিট কিনতে পাসওয়ার্ড তথা ওটিপি লাগবে। কালোবাজারি রোধের যুক্তিতে এটি চালু করা হচ্ছে। এতে ভোগান্তির আশঙ্কাও রয়েছে। কারণ দিনমজুর থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের সবার কাছে নেই স্মার্টফোন। রয়েছে পড়াশোনার স্বল্পতাও।

রেলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, রেয়াতি সুবিধা প্রত্যাহার ও রিজার্ভেশন চার্জ আরোপের মাধ্যমে ভাড়া বাড়ানো হলে রেলের বার্ষিক রাজস্ব আয় বাড়বে প্রায় ৩শ কোটি টাকা। অথচ বছরে লোকসান অন্তত দেড় হাজার কোটি টাকা।

পরিবহন খাতের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যাত্রী বহনে ভাড়া বৃদ্ধি না করে পণ্যের পরিবহন বাড়ানো এবং রেলের জমিকে কাজে লাগিয়ে আয় বাড়ানোর ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। এতে লোকসানি খাতের তকমা থেকে বেরিয়ে লাভজনক হতে পারে রেল। কিন্তু সে পথে না হেঁটে যাত্রীদের ওপর দায় চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

বুয়েটের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, রেল গণমানুষের জন্য। স্বল্প আয়ের মানুষের ভরসাস্থল ট্রেন। সেখানে রেয়াতি সুবিধা বাদ দেওয়া অগ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত। এতে মানুষের ওপর চাপ আরও বাড়বে। এরকম চলতে থাকলে ধীরে ধীরে গণপরিবহন থেকে রেলের নাম মুছে যেতে থাকবে।

এই যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, রেল নতুন নতুন প্রকল্প নিচ্ছে। এক্ষেত্রে অনিয়ম-দুর্নীতি রোধ করা জরুরি। রেলের জমির বাণিজ্যিক ব্যবহার বাড়িয়ে ভাড়া বরং আরও কমানো যায়। আয়ের উৎস বাড়ানোর দিকে দৃষ্টি দিতে হবে; পণ্য বহনে বাড়াতে হবে সক্ষমতা। রেলের মাধ্যমে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরসহ সারাদেশে পণ্য পরিবহন করা সম্ভব। সেসব বিষয়ে দৃষ্টি না দিয়ে যাত্রীদের ওপর চাপ দেওয়া হচ্ছে, ভাড়া বাড়ানো হচ্ছে।

একই বিষয়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, প্রকল্পের নামে লুটপাট বন্ধ না করে জনগণের দৃষ্টি ভিন্নদিকে সরিয়ে নিতে ভাড়া বাড়ানো হচ্ছে। প্রতিবেশী ভারতে যেখানে যাত্রীপরিবহনে ছাড় দেওয়া হচ্ছে, সেখানে আমাদের কর্তৃপক্ষ ভাড়া বাড়িয়ে গণপরিবহন থেকে ট্রেনকে বাদ দিতে চাইছে। মানুষের জীবনযাপনে এমনিতেই নাভিশ্বাস দশা। সব মিলিয়ে, কোনোভাবেই ভাড়া বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত মানা যায় না।

এছাড়া রেলের ভাড়া বৃদ্ধির জেরে অন্যান্য খাতেও বেড়ে যাবে ব্যয়। তিনি বলেন, রেলে আয় বৃদ্ধির নানা দিক আছে। সারাবিশ্বে যাত্রীপরিবহনের পরিবর্তে পণ্য ও জমিসহ অন্যান্য বাণিজ্যিক খাত থেকে আয় করে রেলওয়ে। সেদিকে কোনো নজর নেই কর্মকর্তাদের।

জানা গেছে, রেলের ভাড়ায় দূরত্বভিত্তিক রেয়াতি সুবিধা চালু হয়েছিল ১৯৯২ সালে। আর ২০১৬ সালে সর্বশেষ ভাড়া বৃদ্ধি করেছিল সরকার।

আয়ের তুলনায় রেলের ব্যয় বেশি। ব্যয়ের মধ্যে রেলের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, পেনশন ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া রেল পুলিশ, নিরাপত্তা বাহিনী-আরএনবি, রেলওয়ের আওতাধীন স্কুল ও হাসপাতালের ব্যয়বৃদ্ধিতে রেলের ব্যয় বেড়েছে। এর খেসারত যাত্রীদের কেন দিতে হবে? এমন প্রশ্ন সংশ্লিষ্টদের। কিন্তু এ বিষয়ে কিছুই বলছেন না কর্মকর্তারা।

সর্বশেষ, ২০২২-২৩ অর্থবছরে রেলের আয় ছিল ১ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা। আর ব্যয় ৩ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা। একই অর্থবছরে রেলের মোট লোকসান হয় ১ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা। যাত্রীবাহী ট্রেনের দৈনিক গড় আয় সাড়ে তিন লাখ টাকা, সেখানে একটি মালবাহী ট্রেনের গড় আয় প্রায় ৭-৮ লাখ টাকা। ৩৫০টির অধিক যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করলেও মালবাহী ট্রেন মাত্র ২০-২৫টি চলাচল করে। ফলে রেলের আয় কম হচ্ছে।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর থেকে এ পর্যন্ত রেলে মোট ৯৯টি নতুন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এডিপিতে বাংলাদেশ রেলওয়েতে ২৫টি বিনিয়োগ প্রকল্প এবং ৩টি কারিগরি সহায়তা প্রকল্প অর্থাৎ মোট ২৮টি উন্নয়ন প্রকল্প চলমান। ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে রেলওয়েতে আয়-ব্যয়শেষে উদ্বৃত্ত অর্থ ছিল প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা।

এরপর সময় যত গড়িয়েছে, লাভজনক থেকে ক্রমেই লোকসানি প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে রেল। আগে ১ টাকা আয় করতে গিয়ে ৯৬ পয়সা ব্যয় করতে হতো সংস্থাটিকে। সেখানে বর্তমানে ১ টাকা আয় করতে গিয়ে রেলওয়ের ব্যয় হচ্ছে ২ টাকা ৭৮ পয়সা। ২০১০ সালের পর এক লাখ কোটি টাকারও বেশি বিনিয়োগ হয়েছে রেলে।

কিন্তু বিনিয়োগ বৃদ্ধির পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে বাড়ছে লোকসানের মাত্রা। কোনো সংস্থা বা কোম্পানির ব্যবস্থাপনা কতটা দক্ষ, তা সহজেই যাচাই করা যায় ‘অপারেটিং রেশিও’র মাধ্যমে। মূলত একটি নির্দিষ্ট সময়ে মোট ব্যয়কে মোট আয় দিয়ে ভাগ করে এটি নিরূপণ করা হয়। অপারেটিং রেশিও যত বেশি হবে, প্রতিষ্ঠানের পরিচালন দক্ষতা তত দুর্বল হিসেবে গণ্য হবে।

গতকাল রেলমন্ত্রী জিল্লুল হাকিম জানিয়েছেন, সারাদেশে রেলের ২৩ হাজার একরের বেশি জমি বেদখল হয়ে আছে। অনেকে ভুঁয়া কাগজপত্র তৈরি করে রেলের জমি ভোগদখল করছেন। এবার নিজের জমি দখলে নেওয়ার চেষ্টা করছে রেল।

সংশ্লিষ্টরা জানান, সারাদেশে রেলওয়ের প্রায় ৬০ হাজার একর জমি রয়েছে। এসব জমি সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হবে। পরিহার করতে হবে যাত্রী পরিবহনের ওপর নির্ভরশীলতা। মালামাল পরিবহনে গুরুত্ব দিয়ে সে অনুযায়ী অবকাঠামো ঢেলে সাজাতে পারলে রেল লাভজনক হতে পারে। তখন যাত্রীভাড়া কমানোও সম্ভব হবে।

ট্রেনের ভাড়া বাড়ানোর বিষয়ে গতকাল রাজবাড়ীতে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে রেলপথমন্ত্রী বলেন, আপাতত ট্রেনের ভাড়া বৃদ্ধি করার কোনো পরিকল্পনা আমাদের নেই। তবে বর্তমান যে ভাড়া আছে তা ২০১৬ সাল থেকে আছে। অথচ তেলের দাম বেড়েছে, বগির দাম বেড়েছে, ইঞ্জিনের দাম বেড়েছে, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বেড়েছে; শুধু টিকিটের দাম বাড়েনি। যখন আমরা ট্রেনের টিকিটের ভাড়া বাড়াব, তখন আগে থেকে আপনাদের (সাংবাদিকদের) জানিয়েই বাড়াব।

Loading