নিহত শিশুর সংখ্যা ছাড়াল ৪ হাজার

প্রকাশিত: ৬:০৫ পূর্বাহ্ণ , নভেম্বর ৭, ২০২৩

ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ডে দখলদার ইসরাইলের নির্বিচার হামলায় নিহতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৯ হাজার ৭০০। নিহতদের মধ্যে শিশুর সংখ্যাই চার হাজারের বেশি। ইসরাইলের এই হামলা থেকে বাদ যাচ্ছে না গাজার কোনও অবকাঠামো। তারা মসজিদ, গির্জা, স্কুল, হাসপাতাল, শরণার্থী শিবিরসহ বেসামরিক মানুষের বাড়ি-ঘর সব জায়গায় হামলা চালিয়ে আসছে।

গাজায় চলমান যুদ্ধে অন্তত ৪ হাজার ৮ শিশু নিহত হয়েছে এবং গত প্রায় এক মাসে ইসরাইলি বোমা হামলায় মৃতের সংখ্যা ৯ হাজার ৭৭০ জনে পৌঁছেছে বলে ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। গাজার আল-আকসা হাসপাতালের কর্মকর্তারা জানিয়েছে, রোববার বিকেলে মধ্য গাজার বুরেজি শরণার্থী শিবিরে একটি স্কুলের কাছে কয়েকটি বাড়িতে ইসরাইলি বিমান হামলায় কমপক্ষে ১৩ জন নিহত হয়। বুরেজ ক্যাম্পটি তুলনামূলকভাবে ছোট শরণার্থী শিবির যা গাজা উপত্যকার মাঝখানে অবস্থিত। ইউনাইটেড নেশনস রিলিফ অ্যান্ড ওয়ার্কস এজেন্সি ফর প্যালেস্টাইন রিফিউজিস (ইউএনআরডব্লিউএ)-এর নিবন্ধিত প্রায় ৪৬ হাজার ফিলিস্তিনি শরণার্থীর আবাসস্থল হচ্ছে এই শিবির।

গত বৃহস্পতিবারও এই শিবিরে ইসরাইলি হামলার ঘটনা ঘটে এবং তাতে ১৫ জন নিহত হন। মূলত গত সপ্তাহে ইসরাইল গাজার অভ্যন্তরে শরণার্থী শিবিরগুলোতে অসংখ্য হামলা চালিয়েছে। সেগুলোও আবার প্রায়শই এমন সব এলাকায় যা অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ কিছু এলাকা বলে পরিচিত। ইসরাইল বলেছে, সশস্ত্র ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাসের কমান্ডারদের লক্ষ্যবস্তু করছে তারা। যদিও ইসরাইলের হামলায় নিহতদের বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক।

জাতিসংঘের মতে, গাজার ২৩ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে ১৫ লাখ মানুষই এখন অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। একইসঙ্গে গত ৮ অক্টোবর থেকে গাজায় সর্বাত্মক অবরোধও আরোপ করে রেখেছে ইসরাইল। এতে করে ফিলিস্তিনি নাগরিকরা খাদ্য, জ্বালানি, খাবার পানি ও ওষুধের সংকটে পড়েছেন। তবে এতো কিছুর পরও সারা বিশ্বের আবেদন ও প্রতিবাদ উপেক্ষা করে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু গাজায় হামলা বন্ধের কোনও সম্ভাবনা আবারও প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের বন্দিদের প্রত্যাবর্তন ছাড়া কোনও যুদ্ধবিরতি হবে না, আমরা আমাদের শত্রু এবং আমাদের বন্ধু উভয়কেই এটি বলছি। আমরা তাদের পরাজিত না করা পর্যন্ত আমরা হামলা চালিয়ে যাব।’

এদিকে, ইসরাইলের সামরিক বাহিনী দাবি করেছে, তারা গাজাকে কার্যত দুই ভাবে বিভক্ত করে ফেলেছে। সেনাবাহিনীর মুখপাত্র ড্যানিয়েল হাগারি বলেছেন, সেনারা গাজায় প্রবেশ করে উপকূল পর্যন্ত পৌঁছে গেছে এবং কার্যতভাবে তারা গাজা উপত্যকাকে দুই ভাগ করে ফেলেছে। একটি হচ্ছে উত্তর গাজা এবং আরেকটি দক্ষিণ গাজা। এর আগে তিনি বলেন, সেনারা গাজার শহরটিকেও ঘিরে ফেলেছে। হাগারি বলেন, ইসরাইল এখনো গাজার উত্তরাঞ্চল থেকে দক্ষিণাঞ্চলে যেতে বাসিন্দাদের জন্য একটি ‘করিডর’ খোলা রেখেছে। ইসরাইল ঘোষণা করেছে তারা হামলা আরো জোরদার করবে এবং গাজা উপত্যকা এবং গাজা শহর ঘিরে স্থল অভিযানও আরো শক্তিশালী করা হবে।

যুদ্ধবিরতিতে জিম্মি মুক্তির শর্ত নাকচ আরব নেতাদের : গাজায় একটি মানবিক বিরতির বিষয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে ওয়াশিংটন। রোববার আম্মানে আরব পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে বৈঠক করেন যেখানে আরব রাষ্ট্রগুলো মানবিক বিরতির পরিবর্তে জরুরী অস্ত্রবিরতির প্রস্তাব আনেন।

জেরুসালেমে থাকা বিবিসির সংবাদদাতা লাইস ডুসেট বলেন, জর্ডানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আয়মান সাফাদি জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ কূটনীতিক অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের সাথে ‘খুব বিস্তারিত, স্পষ্ট এবং খোলামেলা আলোচনা হয়েছে।’ তিনি বলেন, সব আরব দেশ বেসামরিক নাগরিকদের মুক্তির আহ্বান জানাচ্ছে। কিন্তু তিনি ইসরাইলের বিরুদ্ধে ‘২৩ লাখ ফিলিস্তিনিকে জিম্মি করার’ অভিযোগ আনেন। ইসরাইল এসব মানুষদের নিত্য প্রয়োজনীয় সেবা পাওয়ার সুযোগ না দেয়া এবং তাদের বাড়িঘর ধ্বংস করার মাধ্যমে জিম্মি করেছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

গত সপ্তাহে জর্ডান তেল আবিব থেকে তার রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এ ধরনের পদক্ষেপ নেয়া জর্ডানই প্রথম আরব দেশ। ইসরাইলের সাথে জর্ডানের শান্তি চুক্তি ঝুঁকিতে পড়তে পারে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘সবকিছু নিয়েই আলোচনার সুযোগ রয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘ইসরাইল সরকারের মতো আমরা রাগের বশবর্তী হয়ে কিছু করছি না এবং এ কারণে আমরা সামগ্রিক চিত্রটি থেকে বঞ্চিত হচ্ছি না।’

২৪টি ট্যাংক ধ্বংসের দাবি হামাসের : গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি সেনাদের শক্তি পরীক্ষা নিচ্ছে হামাস যোদ্ধারা। গত ৪৮ ঘণ্টায় পাল্টা প্রতিরোধে ইসরাইলের ২৪টি ট্যাংক ধ্বংসের দাবি করেছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠনটি। সুড়ঙ্গের মাধ্যমে গেরিলা কৌশলে চালানো হামলায় ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করছে তারা। হামাসের এই সুপরিকল্পিত হামলা অব্যাহত থাকলে শিগগিরি গাজায় ইসরাইলের স্থল অভিযান মুখ থুবড়ে পরবে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের।

ফিলিস্তিনের গাজায় ৩ সপ্তাহ বিরামহীন বিমান হামলা চালানোর পর গত ২৮ অক্টোবর অঞ্চলটিতে স্থল অভিযান শুরু করে ইসরাইল। এতে কয়েকশ’ ট্যাংক-সাঁজোয়াযানসহ বিশাল ইসরাইলি সেনাবহর অংশ নেয়। তবে হামাসও ব্যাপক প্রস্তুতি ও দক্ষতার সাথে ইসরাইলি বাহিনীর এসব হামলা মোকাবিলা করছে। হামাসের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, ২ দিনে ২৪টি ইসরাইলি ট্যাংক ধ্বংস করেছে যোদ্ধারা। এছাড়া গাজায় স্থল হামলায় অংশ নেয়ার পর হামাসের হামলায় ৩২ সেনা নিহতের কথা জানিয়েছে ইসরাইল। এ নিয়ে যুদ্ধে নিহত ইসরাইলি সেনা নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৩৪৬ জনে পৌঁছেছে। তবে হামাস বলছে, স্থল অভিযানে ইসরাইলি সেনা নিহতের সংখ্যা অনেক বেশি। এ ছাড়া হামাসের সাথে লড়াইয়ে কমপক্ষে ৫৮ জন পুলিশ সদস্যের মৃত্যুর কথা জানায় তেল আবিব।

মধ্যপ্রাচ্যে পারমাণবিক সাবমেরিন পাঠাল যুক্তরাষ্ট্র : যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে গাজায় হামলার তীব্রতা আরও বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে ইসরাইল। এই পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্যে পারমাণবিক সাবমেরিন পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ইতোমধ্যেই সেই সাবমেরিন নির্দিষ্ট এলাকায় পৌঁছেও গেছে। এ নিয়ে মার্কিন সামরিক বাহিনীর সেন্ট্রাল কমান্ড (সেন্টকম) একটি বিবৃতি দিয়েছে। রোববার গভীর রাতে দেয়া ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘৫ নভেম্বর ওহাইও-শ্রেণির একটি সাবমেরিন ইউএস সেন্ট্রাল কমান্ডের দায়িত্বের এলাকায় পৌঁছেছে।’

পরমাণু বোমা হামলার হুমকি দেয়া ইসরাইলের সেই মন্ত্রী বরখাস্ত : গাজায় পরমাণু বোমা হামলা করার আহ্বান জানিয়েছিলেন ইসরাইলের এক মন্ত্রী। এর ফলে বিতর্ক সৃষ্টি হওয়ায় তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। রোববার ইসরাইলের মন্ত্রী ইলিয়াহু বলেছিলেন, ‘গাজায় পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহার করা হোক।’ তারপরই প্রধানমন্ত্রীর অফিস জানিয়েছে, ‘ইলিয়াহুকে বরখাস্ত করা হয়েছে। তার বিবৃতি, বাস্তবসম্মত নয়। আন্তর্জাতিক আইন মেনে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনী আক্রমণ করছে। নিরাপরাধরা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সেটাও তারা দেখছে।’ সূত্র : আল-জাজিরা, বিবিসি, রয়টার্স।

Loading