অমুসলিমদের মর্যাদা ও অধিকার

প্রকাশিত: ২:০১ অপরাহ্ণ , আগস্ট ২৬, ২০২২

মাহমুদ আহমদ

বিশ্বাসের স্বাধীনতা হচ্ছে সব মানুষের মৌলিক অধিকার। ইসলাম ধর্মের বিধানমতে ‘ধর্ম’ হচ্ছে নিজ, পছন্দের একটি বিষয়। এটি এক সুস্পষ্ট ধর্ম। এ ধর্ম গ্রহণের পরও চাইলে কেউ এটা ত্যাগ করতে পারে। তাতে কোনো বাধা নেই। তবে এর বিচার সর্বশক্তিমান আল্লাহ নিজ হাতেই করেন।

ধর্মে যদি বল প্রয়োগের বিধান থাকত, তাহলে মক্কা বিজয়ের পর হজরত রাসূল (সা.) অমুসলিমদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করতেন এবং মক্কায় বসবাসে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি! এতে প্রমাণিত হয়, ধর্মের খাতিরে বল প্রয়োগ ইসলামের কোনো শিক্ষা নয়।

ইসলাম সব ধর্ম এবং সব ধর্মীয় উপাসনালয়কে শ্রদ্ধা ও সম্মানের সঙ্গে দেখার নির্দেশ দেয়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘আল্লাহ যদি এসব মানুষের একদলকে অন্য দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তাহলে সাধু-সন্ন্যাসীদের মঠ, গির্জা, ইহুদিদের উপাসনালয় এবং মসজিদগুলো, যেখানে আল্লাহর নাম অধিক স্মরণ করা হয়, তা অবশ্যই ধ্বংস করে দেওয়া হতো’ (সূরা হজ, আয়াত : ৩৯)। হাদিসে উল্লেখ আছে, বিশ্বনবি (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি বিধর্মী কোনো জিম্মিকে হত্যা করে, সে জান্নাতের ঘ্রাণ পাবে না। এ ঘ্রাণ তো এত তীব্র যে, চল্লিশ বছরের দূরত্বে থেকে তা উপলব্ধি করা যায়’ (বুখারি, কিতাবুল জিযিয়া)।

মহানবি (সা.) বিশ্ববাসীর নেতা ছিলেন, তথাপি তিনি নিজ স্বার্থে কোনো প্রতিশোধ নিতেন না বরং শত্রুদের সঙ্গে এবং বিধর্মীদের সঙ্গেও উত্তম ব্যবহার করেছেন। মহানবি (সা.) তার উম্মতকেও এ নির্দেশই দিয়েছেন তারাও যেন ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী নির্বিশেষে সবার সঙ্গে উত্তম আচরণ করে।

হজরত মুহাম্মাদ (সা.) তার জীবন দ্বারা এ কথা প্রমাণ করে গিয়েছেন, ধর্মের নামে কোনো অন্যায়-অবিচার নেই। সব ধর্মের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ ও তাদের ধর্মীয় উপাসনালয়গুলো শ্রদ্ধার বস্তু। মহানবি (সা.) সমাজের সর্বক্ষেত্রে এবং সব জাতির মাঝে শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন। অন্যান্য ধর্মের অধিকারকে যেভাবে তিনি নিশ্চিত করেছেন তেমনি খ্রিষ্টানদের নাগরিক ও ধর্মীয় অধিকারকেও তিনি নিশ্চিত করেছেন এবং কেয়ামত পর্যন্ত যেন তা বলবৎ থাকে, সে ব্যবস্থাও করেছেন।

খ্রিষ্টানদের নাগরিক ও ধর্মীয় অধিকার নিশ্চিতকারী মহানবি (সা.) প্রদত্ত ৬২৮ খ্রিষ্টাব্দের ঘোষণা পত্রে উল্লেখ রয়েছে : ‘এটি মোহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ (সা.) প্রণীত কাছের এবং দূরের খ্রিষ্টীয় মতবাদ পোষণকারী প্রত্যেকের জন্য ঘোষণাপত্র : আমরা এদের সঙ্গে আছি। নিশ্চয়ই আমি নিজে আমার সেবকবৃন্দ মদিনার আনসার এবং আমার অনুসারীরা এদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছি। কেন না, খ্রিষ্টানরা আমাদের দেশেরই নাগরিক আর আল্লাহর কসম! যা কিছুই এদের অসন্তুষ্টি ও ক্ষতির কারণ হয়, তার আমি ঘোর বিরোধী।

এদের প্রতি বলপ্রয়োগ করা যাবে না, এদের বিচারকদের তাদের দায়িত্ব থেকে অপসারণ করা যাবে না আর এদের ধর্মযাজকদেরও আশ্রয়স্থল থেকে সরানো যাবে না। কেউ এদের উপাসনালয় ধ্বংস বা এর ক্ষতিসাধন করতে পারবে না। কেউ যদি এর সামান্য অংশও আত্মসাৎ করে সে ক্ষেত্রে সে আল্লাহর সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গকারী এবং তার রাসূলের অবাধ্য সাব্যস্ত হবে। নিশ্চয়ই এরা (অর্থাৎ খ্রিষ্টানরা) আমার মিত্র এবং এরা যেসব বিষয়ে শঙ্কিত, সেসব বিষয়ে আমার পক্ষ থেকে এদের জন্য রয়েছে পূর্ণ নিরাপত্তা। কেউ এদের জোর করে বাড়িছাড়া করতে পারবে না অথবা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতেও এদের বাধ্য করা যাবে না। বরং মুসলমানরা এদের জন্য যুদ্ধ করবে। কোনো খ্রিষ্টান মেয়ে যদি কোনো মুসলমানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়, সে ক্ষেত্রে তার (অর্থাৎ সে মেয়ের) অনুমোদন ছাড়া এটি সম্পাদিত হতে পারবে না। তাকে তার গির্জায় গিয়ে উপাসনা করতে বাধা দেওয়া যাবে না। এদের গির্জাগুলোর পবিত্রতা অবশ্যই রক্ষা করতে হবে। এগুলোর সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে বাধা দেওয়া যাবে না। আর এদের ধর্মীয় অনুশাসনগুলোর পবিত্রতাহানি করা যাবে না। এ উম্মতের কোনো সদস্য এ ঘোষণাপত্র কেয়ামত দিবস পর্যন্ত লঙ্ঘন করতে পারবে না।’ [অগ্রপথিক সীরাতুন্নবী (সা.) ১৪১৬ হিজরী, ১০ বর্ষ, ৮ সংখ্যা, ইসলামী ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ-এর প্রকাশনা, ১ম সংস্করণ, আগস্ট ১৯৯৫]।

ভিন্ন ধর্মের প্রতি মর্যাদাবোধ ও তাদের উপাসনালয় ও সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের যে দৃষ্টান্ত মহানবি (সা.) দেখিয়েছেন, তা তার সিরাতের উজ্জ্বলতম অধ্যায়। তাই আমাদের দায়িত্ব, নিজ দেশে অবস্থানকারী সব অমুসলিম ভাইদের জানমাল যেন নিজেদের জানমাল মনে করে রক্ষা করি ও সিরাতে নববি (সা.)-এর শিক্ষাগুলোকে যেন নিজেদের মধ্যে বাস্তবায়িত করে ধর্মের নামে রক্তপাত বন্ধ করি। মহানবি (সা.)-এর আদর্শ এতটাই অতুলনীয় ছিল যে তিনি ইহুদির লাশকেও সম্মান দেখিয়েছেন। হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, একবার এক ইহুদির লাশ বিশ্বনবি (সা.)-এর সামনে দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল আর এতে মহানবি (সা.) সেই লাশের সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে ছিলেন ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ না লাশটি তার সামনে থেকে চলে যায়। পাশ থেকে হজরত জাবের (রা.) বলেছিলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এটি তো ইহুদির লাশ। এতে আল্লাহর রাসূল উত্তর দিয়েছিলন, সে কি মানুষ ছিল না? (সহিহ বুখারি, হাদিস নং ১৩১১)। যে নবি এক ইহুদির লাশকে সম্মান জানানোর জন্য তার সাথিদের নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন সেই নবির উম্মতের পক্ষে কীভাবে সম্ভব শুধু ধর্মীয় মতপার্থক্যের কারণে কারও ওপর অন্যায় অত্যাচার করা।

হজরত সুফিয়ান ইবনে সালিম (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, মহানবি (সা.) বলেছেন, ‘মনে রেখ যদি কোনো মুসলমান অমুসলিম নাগরিকের ওপর নিপীড়ন চালায়, তার অধিকার খর্ব করে, তার কোনো বস্তু জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেয়, তাহলে কেয়ামতের দিন আমি আল্লাহর আদালতে তার বিরুদ্ধে অমুসলিম নাগরিকদের পক্ষাবলম্বন করব’ (আবু দাউদ)। হজরত আবু বকর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কোনো অমুসলিম নাগরিককে হত্যা করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন’ (মুসনাদে আহমদ)। এ ছাড়া মহানবি (সা.) এটিও বলেছেন, ‘তোমরা মজলুমের বদদোয়া থেকে বেঁচে থেকো, যদিও সে কাফির হয়। তার মাঝখানে আর আল্লাহর মাঝখানে কোনো পর্দা নেই (অর্থাৎ তার বদদোয়া দ্রুত কবুল হয়ে যায়)।’ (মুসনাদে আহমদ)।

এমনই ছিল মানবদরদি রাসূল ও শ্রেষ্ঠ রাসূল মহানবির (সা.) আদর্শ। আমরা যদি মহানবি (সা.)-এর জীবনাদর্শ পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখতে পাই, তিনি কতইনা উত্তম আচরণ করেছেন অন্যান্যা ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে আর একই শিক্ষা আমাদের দিয়ে গেছেন। তিনি (সা.) যে দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন, এরূপ দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। তাই এরূপ আজিমুশ্বান নবির (সা.) ওপর লাখ লাখ দরুদ ও সালাম।

আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে বিশ্বনবি (সা.)-এর জীবনাদর্শ অনুসরণ করে জীবন পরিচালনার তৌফিক দান করুন, আমিন।

লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট

Loading