ভাবিয়ে তুলছে প্রশাসনকে

প্রকাশিত: ১০:১২ পূর্বাহ্ণ , আগস্ট ৪, ২০২১

মডেলিংয়ের আড়ালে অপরাধ সাম্রাজ্যে বিচরণ ও আন্ডারওয়ার্ল্ড কানেকশনে অবৈধ অস্ত্র সংগ্রহসহ গ্রেফতারকৃত মডেলদের বিভিন্ন কানেকশন তদন্তে নেমেছে একাধিক সংস্থা। দেশের বেশ কয়েকটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার ও ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানেরা নিয়মিত গ্রেফতারকৃত মডেলদের মাদকের আড্ডায় যাতায়তের কারণে এদের মাধ্যমে রাষ্ট্রের কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেশের বাইরে পাচার হয়েছে কি না তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক অস্ত্র চোরাকারবারের মাধ্যমে মডেল পিয়াসা কোটি টাকা দামের স্বর্ণের প্রলেপযুক্ত সর্বাধুনিক উজি পিস্তল কেনা বিষয়টি তদন্তে জোর দিয়েছেন গোয়েন্দারা। শুধু তাই নয়, মাদক-বিনিদোন আড্ডায় প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার বা ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানদের মধ্যে যাদের যাতায়ত ছিল তাদের তালিকা তৈরি করতে মাঠে নেমেছে একটি সংস্থা। একই সাথে এদের সাথে বিভিন্ন পেশার প্রভাশালী কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততা থাকার বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে প্রশাসনকে। এরই মধ্যে মডেল পিয়াসা, মৌ ও পাপিয়াসহ ১০জন মডেল ও অভিনেত্রীর বাসার সিসিটিভি ফুটেজসহ গুরুত্বপূর্ণ আলামত সংগ্রহ করছে গোয়েন্দারা। এদের মধ্যে মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা ও মরিয়ম আক্তার মৌকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিসা ও এলকোহল বিশ্বের প্রায় সকল দেশের ক্লাব বা হোটেলে আগতদের সরবরাহ করা হয়। সিসা মধ্যপ্রাচ্যের হোটেলের বাইরে বড় বড় বিনোদন কেন্দ্রেও ব্যবহার হতে দেখা যায়। বিদেশে সিসা মাদকের তালিকায় পড়ে না।

সাবেক আইজিপি ও এমপি নূর মোহাম্মদ দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, গ্রেফতারকৃত মডেলদের উগ্র আচরণ ও তাদের কানেকশন উদ্বেগের বিষয়। বিত্তশালী পরিবারের সন্তানসহ যাদের এসব বাসায় যাতায়ত ছিল তারা সবাই প্রভাবশালী। এ সব ব্যক্তিদের মাধ্যমে সহজেই রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ এবং প্রভাববিস্তার করা সম্ভব। শুধু তাই নয়, গ্রেফতারকৃত একজন মডেল অবৈধ অস্ত্র সংগ্রহ করেছেন তা যদি সঠিক হয় যা রাষ্ট্রের জন্য উদ্বেগের বিষয়।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সুন্দরী নারীদের দিয়ে ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করা পুরাতন কৌশল। তাই এ ধরনের আড্ডায় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের না যাওয়াই উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের প্রেফেসর ড. জিয়া রহমান দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, সবাই এখন হিরো হতে চায়। মানুষের মাঝে প্রচÐ লোভ রয়েছে। তবে তাদের যোগ্যতা নেই। লোভ ও যোগ্যতা মেচ না করায় নেগেটিভ কাজ বেচে নেয় মানুষ। তাই মানুষকে বø্যাকমেইল করে। এ ধরনের অপরাধীদের সঠিক বিচার হলে এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ হবে বলে মনে করেন তিনি।

তিনি আরো বলেন, যে সব মাদক ও সিসাসহ মডেলদের গ্রেফতার করা হয়েছে তা কোনো দেশেরই বড় ধরনের অপরাধ নয়। বিশ্বের অনেক দেশেই ক্লাব ও বিভিন্ন হোটেলে সিসাসহ নানা ধরনের এলকোহল সেবন করতে দেখা যায়।

পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, পিয়াসা ও মরিয়ম আক্তার মৌকে গ্রেপ্তারের পর অন্যদের টনক নড়েছে। আরো কয়েকজন মডেলকে নজরদারির আওত্য়া আনা হয়েছে। তারা কোথায় যাচ্ছেন, কি করছেন তা পর্যবেক্ষণ করছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। ইতিমধ্যে তাদের তালিকা করা হয়েছে। তারা সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের টার্গেট করে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিত।

সূত্র জানায়, গতকাল পিয়াসা ও মৌয়ের রিমান্ডের প্রথম দিন অতিবাহিত হয়েছে। দুই জনকে মুখোমুখি করে কয়েক দফা জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন তদন্তকারী সংস্থার কর্মকর্তারা। জিজ্ঞাসাবাদে তারা ধনাঢ্য ব্যক্তিদের বø্যাকমেইল করার কথা কিছুটা স্বীকার করেছেন। পিয়াসা তার বাসায় নিয়মিত মাদকের আসর বসা নিয়ে খোলাামেলা কথা বলতেন।

জানতে চাইলে ডিএমপি পুলিশের ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ডিবি-উত্তর) হারুন অর রশীদ গতকাল মঙ্গলবার বলেন, পিয়াসা ও মৌকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। দুজনই একটি সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য। তাদের বিরুদ্ধে অনেক বø্যাকমেইলের অভিযোগ পেয়েছি। তিনি আরো বলেন, ওইসব ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে তাদের বাসায় অভিযান চালানো হয়। উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের বেশি টার্গেট করতেন তারা। বাসায় আসলে তারা তাদের সঙ্গে আপত্তিকর ছবি-ভিডিও ধারণ করে রাখতেন। পরবর্তীতে তারা সেসব ভিডিও ও ছবি ভিক্টিমদের পরিবারকে পাঠাবে বলে বø্যাকমেইল করে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিতেন। এই রকম অসংখ্য অভিযোগ আছে তাদের বিরুদ্ধে। দুই জনের মধ্যে পিয়াসা চলাফেরা ছিল বেপরোয়া। টার্গেট পুরণ না হলেই অন্যদের ফাঁসানোই ছিল তার কাজ। এসব ঘটনার সঙ্গে আরো কয়েকজন জড়িত আছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রশাসনের কোনো কর্মকর্তাদের সাথে তাদের কানেকশন ছিল কি না তা তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্তে এ ধরনের তথ্য পাওয়া গেলে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে অবহিত করা হবে।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামেই জন্ম ও মডেলিংয়ে হাতেখড়ি হয়েছিল পিয়াসার। ২০০৯ সাল থেকে ঢাকার অভিজাত মহলে পরিচিতি পান মডেল পিয়াসা হিসেবে। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে উঠলেও অল্প সময়ের মধ্যেই ৩২ বছর বয়সী পিয়াসার হাত হয়ে উঠে অনেক লম্বা। তাকে সমীহ করে চলেন অনেক বাঘা বাঘা শিল্পপতিও।

এ প্রসঙ্গে ডিএমপির এক কর্মকর্তা বলেন, বারিধারা আবাসিক এলাকার ৯ নম্বর রোডের একটি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে ভাড়া থাকতেন পিয়াসা। সার্ভিস চার্জ ও সিকিউরিটি বিল বাদে শুধু ফ্ল্যাট ভাড়াই দেড় লাখ টাকার মতো। অথচ দৃশ্যমান কোনো আয় নেই পিয়াসার। বিশাল ফ্ল্যাটে তিনি একাই থাকেন। তার রান্নাবান্নাসহ ব্যক্তিগত কাজের জন্য কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া আছে। শাহজাহান নামের এক বাবুর্চি তার ফ্ল্যাটে রান্নার কাজ করেন। তাকে আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করেছি।

তিনি আরো বলেন, পিয়াসার ফ্ল্যাটে প্রভাবশালীদের যাতায়াত ছিল নিয়মিত। করোনায় পাঁচতারকা হোটেলগুলো বন্ধ হয়ে গেলে নিয়মিত পার্টি হতো তার ফ্ল্যাটেই। পিয়াসার বাবার নাম মাহবুব আলম। তিনি কাস্টমস কর্মচারী ছিলেন। পিয়াসার শিক্ষাগত যোগ্যতা এইচএসসি পাস হলেও নিজেকে কখনো এমবিএ, আবার কখনো ব্যারিস্টার বলে পরিচয় দিয়ে আসছিলেন। তিন বোনের মধ্যে পিয়াসা থাকেন ঢাকায়। অন্যরা থাকেন চট্রগ্রামে।

ডিবি পুলিশের এক কর্মকর্তা গতকাল বলেন, পিয়াসা ও মৌকে পৃথক পৃথক মামলায় ৩ দিন করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। গত রোববার রাতে রাজধানীর বারিধারা থেকে পিয়াসা ও মোহাম্মদপুরের বাবর রোডের বাসা থেকে মৌকে আটক করার পর তাদের বিরুদ্বে পৃথক পৃথক মামলা দায়ের করা হয়। এই দুজনের বিরুদ্বে বø্যাকমেইল করার অভিযোগ হাতে নিয়ে বেশকিছু দিন গোয়েন্দা নজরদারি চালায় মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এ সব অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেয়েই অভিযান চালানো হয়।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, পিয়াসার সঙ্গে আন্ডারওয়ার্ল্ড মাফিয়ারও ঘনিষ্ঠতার তথ্য পাওয়া গেছে। ওই মাফিয়া চক্রের মাধ্যমে অস্ত্রের কারবার সিন্ডিকেটের ঘনিষ্ঠ হয় সে। ধনাঢ্য পরিবারের উঠতি বয়সি তরুণদের কাছে অবৈধ অস্ত্রের তথ্য আদান-প্রদানে কাজ করে সে। অত্যাধুনিক উজিগান হাতে পোজ দেওয়া পিয়াসার একটি ছবি এরই মধ্যে ভাইরাল হয়েছে। ওই অস্ত্রটি কার সে সম্পর্কে রিমান্ডে পিয়াসাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পিয়াসার ঘনিষ্ঠভাজনদের নামের তালিকা বেশ লম্বা। প্রভাবশালীদের অনেকেই রয়েছেন তার বন্ধু কিংবা বয়ফ্রেন্ডের তালিকায়। পিয়াসার ঘনিষ্ঠভাজনদের মধ্যে সবার উপরে আছে একটি শিল্প গ্রæপের অন্যতম কর্ণধার। একে একে পিয়াসার বন্ধু তালিকায় যোগ দেন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তা ও ধনাঢ্য ব্যবসায়ীরা। সুন্দরী তরুণীদের মাধ্যমে তাদের নিয়ন্ত্রণ করতো পিয়াসা। এ জন্য রয়েছে তার ১০০ জনের সুন্দরী নারীর সিন্ডিকেট।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তদন্তের সাথে সম্পৃক্ত ডিবির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, পিয়াসা বারিধারা, উত্তরা এবং গুলশানের কয়েকটি বাসায় মাঝে মধ্যেই পার্টির আয়োজন করতেন। ওই পার্টিতে আমন্ত্রণ জানানো হতো বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রভাবশালী ব্যক্তিদের। প্রতিটি পার্টিতেই গোপন ক্যামেরা বসাতেন পিয়াসা। রাখা হতো মদ, ইয়াবাসহ বিভিন্ন নেশাজাতীয় দ্রব্য। একপর্যায়ে টার্গেটকৃত ব্যক্তি নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললে কৌশলে তাকে গোপন একটি কক্ষে পাঠিয়ে দেয়া হতো। পরবর্তীতে ওইসব দৃশ্য সামনে রেখেই তার কাছ থেকে নিয়মিতভাবে হাতিয়ে নেয়া হতো মোটা অঙ্কের অর্থ।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পিয়াসা ও মৌ প্রশাসন বা প্রভাবশালীদের মাধমে কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ বা অন্য কোনো প্রভাবশালী চক্রের সাথে জড়িত রয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আমরা এদের আড্ডায় আগতদের তালিকা তৈরি করছি। এর মাধ্যমে সব বেরিয়ে আসবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

সূত্র জানায়, গত বছর ২২ ফেব্রæয়ারি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে জাল টাকা বহন ও অবৈধ টাকা পাচারের অভিযোগে শামিমা নূর পাপিয়াকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি নরসিংদীর যুব মহিলা লীগের নেত্রী ছিলেন। তার স্বামী মফিজুর রহমানও ছাত্রলীগের সাবেক নেতা। তারা দু’জনই সুন্দরী নারীদের নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে অনৈতিক ব্যবসা করে আসছিলেন। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলে বø্যাকমেইল, অবৈধ অস্ত্র-মাদক ব্যবসা ও চাঁদাবাজি করতেন তিনি। এর মাধ্যমে তিনি অল্প সময়ে নরসিংদী ও ঢাকায় একাধিক বিলাসবহুল বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লটসহ বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থের মালিক হয়েছেন। তিনি গুলশানের একটি অভিজাত হোটেলের প্রেসিডেন্ট স্যুট নিজের নামে বুক করে নানা ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপ চালিয়েছেন। ## ইনকিলাব

Loading