ঠান্ডা মাথায় খুন : এসপিকে অনতিবিলম্বে প্রত্যাহার দাবি রাওয়ার ঘটনার রাতেই মাকে ফোন দিলেও হত্যাকান্ডের বিষয়ে কিছুই বলেননি ওসি প্রদীপ : সিনহার মা সিনহার সহযোগী সিফাত জামিনে মুক্ত ৪

রহস্যের খোঁজে র‌্যাব

প্রকাশিত: ৯:১২ পূর্বাহ্ণ , আগস্ট ১১, ২০২০

মেজর (অব.) সিনহার খুনিরা চিহ্নিত হলেও গত ১০ দিনে খুনের রহস্য উদ্ঘাটন হয়নি। কেন তাকে চেকপোস্টে তল্লাশির নামে ঠান্ডা মাথায় নির্মমভাবে হত্যা করা হলো এর নেপথ্যে কারণ এখনও আড়ালে। তবে দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টিকারী এই হত্যাকান্ডের প্রকৃত রহস্য জানতে মাঠে নেমেছে র‌্যাবসহ একাধিক সংস্থা। এ হত্যাকান্ড সম্পর্কে একের এক চাঞ্চল্যকর তথ্য আসছে। হত্যা মিশনে থাকা টেকনাফ থানা থেকে প্রত্যাহারকৃত ওসি প্রদীপ এবং তার সহযোগী ও মদদদাতাদের মুখোশ খুলে পড়ছে। তদন্তকারী সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, স্পর্শকাতর এই মামলার প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটনে এসব তথ্য যাচাই-বাছাই চলছে। তারা আশাবাদী খুব শিগগির মোটিভ উদ্ঘাটন করা যাবে। অন্যদিকে সিনহার সহযোগী সাহেদুল ইসলাম সিফাতের জামিন মঞ্জুর করেছেন আদালত। একই সাথে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বদলি করে র‌্যাবকে ওই মামলার তদন্তভার দেয়া হয়েছে। গতকাল সোমবার টেকনাফ কোর্টের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বিচারক তামান্না ফারাহ এই জামিন আবেদন মঞ্জুর করেন। পরে জেল থেকে বের হওয়ার পর সিফাতকে আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুরা গ্রহণ করেন। তবে র‌্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, জেল গেইটে ৪ পুলিশকে জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের ১০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়েছে। জেল গেইটে পুলিশদের জিজ্ঞাসাবাদ ও সাাক্ষীদের জবানবন্দি নেয়ার পর ওসি প্রদীপসহ তিন পুলিশকে রিমান্ডে নেয়া হবে।

সিফাতের মামা মাসুম বিল্লাহর সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, সিফাত আমার সঙ্গেই আছে। কবে ঢাকায় ফিরবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, কয়েক দিন দেরি হবে। দুপুর ২টা ১০ মিনিটে সিফাত কারাগার থেকে মুক্তি পান। এসময় সিফাতের আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুরা তাকে গ্রহণ করেন বলে তিনি জানান। মেজর সিনহা হত্যা মামলার আইনজীবী এড. মো. মোস্তফা জানান, সিনহা হত্যার ঘটনায় পুলিশের দায়ের করা হত্যা ও মাদকের দুটি মামলার আসামি ছিল সিফাত। রোববার তার জামিন আবেদনের শুনানি হয়। শুনানি শেষে সোমবার জামিন আদেশের দিনধার্য করছিলেন আদালত। তার অংশ হিসেবে পুনঃজামিন শুনানি হলে আদালত সিফাতের জামিন মঞ্জুর করেন। একই সাথে তদন্ত কর্মকর্তা বদলির আবেদন করা হলে মঞ্জুর করেন আদালত।

এদিকে এই মামলায় রিমান্ড মন্জুর হওয়া ওসি প্রদীপ, আইসি লিয়াকত ও এসআই নন্দ দুলালেদের রিমান্ডে নেয়ার সব প্রস্তুতি নিয়েছেন তদন্তকারী সংস্থা র‌্যাব। গতকাল ওই তিন আসামির মেডিক্যাল পরীক্ষা ও সম্পন্ন হয়েছে বলে জানা গেছে একটি সূত্রে। তবে সোমবার রাত ৯টা পর্যন্ত তাদের রিমান্ডে নেয়া হয়নি বলে জানান জেল সুপার মুকাম্মেল হোসেন। তিনি বলেন, এই পর্যন্ত আসামিদের রিমান্ডে নেয়া হয়নি।

তদন্তের সাথে জড়িত র‌্যাবের একজন কর্মকর্তা দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, খুনের সময় কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মাসুদ হোসেনের সাথে ওসি প্রদীপ দাশ এবং পরিদর্শক লিয়াকত আলীর ফোনালাপেও স্পষ্ট হয়েছে এটি পরিকল্পিত হত্যা। ক্রসফায়ারের নামে মানুষ হত্যায় ভয়ঙ্কর কিলার হিসাবে পরিচিত ওসি প্রদীপ এবং তার সব কুকর্মের অন্যতম সহযোগী লিয়াকত সাবেক এই সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে ঠান্ডা মাথায়। আর এই হত্যাকান্ডের দায় পুলিশ সুপারও এড়াতে পারেন না। এরই মধ্যে তার বিরুদ্ধেও নানা অভিযোগ উঠেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছে, খুনের রহস্য উদ্ঘাটনে গায়েব হার্ডড্রাইভ এবং ল্যাপটপে থাকা তথ্য পাওয়া এখন খুবই জরুরি। গুরুত্বপূর্ণ এসব আলামত গোপনকারী প্রদীপ-লিয়াকতের কাছ থেকে এ ব্যাপারে আসল তথ্য বের হয়ে আসতে পারে। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সিনহার গাড়িতে থাকা সিফাতও এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে পারেন।

৪ আসামিকে ১০ দিনের রিমান্ডে চায় র‌্যাব : র‌্যাবের গণমাধ্যম শাখার প্রধান লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ জানিয়েছেন, যে ৪ জন আসামিকে জেল গেইটে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, তাদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আদালতে নতুন করে তাদের ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করা হয়েছে। রিমান্ডের আবেদনটি জমা দেয়া হয়েছে। আগামী ১২ আগস্ট আবেদনটির ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। ইতোমধ্যে এ ৪ আসামিকে কারাগারের জেল গেইটে দুই দিন ধরে জিজ্ঞাসাবাদ শেষ করেছেন তদন্তকারী র‌্যাব কর্মকর্তা।

তিনি আরো বলেন, আসামি পুলিশের চার সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে র‌্যাব। তাছাড়া মামলার জন্য সাক্ষী খুবই গুরুত্বপূর্ণ। র‌্যাবের তদন্ত দল দ্রুত সাক্ষী ও অন্য ৪ পুলিশকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ আগে করবে। পরে প্রদীপ ও আইসি লিয়াকতসহ তিনজনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তদন্তের গুরুত্ব বিবেচনা করেই এ পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। তদন্তের ক্ষেত্রে সাক্ষী খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

হত্যার রাতেই মাকে ফোন : সিনহাকে হত্যার পর ৩১ জুলাই রাত ১২টার পর টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ প্রথম ফোন করেছিলেন বলে জানান মেজর সিনহা রাশেদের মা। সিনহা সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য জানতে চাইলেও প্রদীপ সে সময় হত্যাকান্ডের বিষয়ে কিছুই বলেননি। গতকাল সোমবার উত্তরার নিজ বাসায় সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান সিনহার মা নাসিমা আক্তার। সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, রাতেই উত্তরা থানা থেকে পুলিশের একটি দল তাদের বাসায় এসে সিনহা সম্পর্কে আরো তথ্য জানতে চায়।

তিনি আরো বলেন, কথায় নয়, কাজে বিশ্বাসী ছিল আমার ছেলে। দেশকে নিয়ে অনেক ভাবতো। ছেলে আমাকে বলতো, আম্মি আমরা যদি দেশে ভালো কিছু রেখে যাই তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সেটা অনুসরণ করবে। একটা ডকুমেন্টারি করছি এখনো বলার মতো কিছু হয়নি, যখন হবে তখন বলব। এ সময় ছেলের নানা স্মৃতির কথা মনে করে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন তিনি। নাসিমা আক্তার বলেন, বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে আমি এখন পর্যন্ত সন্তুষ্ট। প্রধানমন্ত্রী, সেনাবাহিনী প্রধান, নৌ-বাহিনী প্রধানসহ আরও অনেকে আমাদের খোঁজ নিয়েছেন। মিডিয়া ভ‚মিকা রাখছে। আমরা চাই যারা এরসঙ্গে জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক।

আমি গর্বিত সিনহার মতো একটা ভাই ছিল : বোন শারমিন : সিনহার বিষয়ে বোন শারমিন শাহরিয়া বলেন, আমি খুবই গর্বিত যে ওর মতো একটা ভাই আমার ছিল। যাকে এত মানুষ ভালোবেসে ছিল, এত মানুষ ভালোবাসে। ভাই সিনহার মৃত্যুর পর তা আমি দেখতে পেয়েছি। আমি ওকে বলতাম, তুমি হচ্ছো মানুষের হৃদয়ের রাজপুত্র। সেটা সে (সিনহা) প্রুভ করেছে নিজের ভালোবাসা আর মানবিক গুণাবলি দিয়ে। আমি বিচারের কথা বলতে এখানে আসিনি। যেহেতু প্রধানমন্ত্রীসহ সবাই আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন, যে বিচারটা হবে।
তিনি আরো বলেন, আমাদের একটা আবেদন থাকবে সঠিক তদন্ত করে দ্রæতই যেন বিচার পাই। এটা যেন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। অন্যদের যেন মোটিভেট করে যে, আমরা আসলেই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।

সিনহাকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করা হয়েছে : রাওয়া চেয়ারম্যান : রিটায়ার্ড আর্মড ফোর্সেস ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের (রাওয়া) চেয়ারম্যান মেজর (অব.) খন্দকার নুরুল আফসার বলেন, সিনহা হত্যার বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে এ পর্যন্ত আমরা দেখেছি সরকারের মনোভাব পজিটিভ। আমরা আবেদন করব, যাতে সিনহা হত্যার বিচারপ্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত না হয়। এরই মধ্যে প্রমাণিত (অলরেডি প্রুভড) পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও তথ্য-প্রমাণে প্রতীয়মান যে, সিনহাকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করা হয়েছে। এ হত্যা যেন আর না হয়। গতকাল উত্তরায় মেজর (অব.) সিনহার মায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে রাওয়া চেয়ারম্যান আরো বলেন, আমরা চাই মেজর (অব.) সিনহার হত্যাকান্ডের ঘটনায় কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মাসুদ হোসেনকে যেন অনতিবিলম্বে প্রত্যাহার করা হয়। সিনহার ঘটনায় যারা কাস্টডিতে ছিলেন তাদের জামিন হয়েছে। আমরা অত্যন্ত খুশি, আলহামদুলিল্লাহ। সিনহা হত্যায় যে পুলিশ সদস্যরা জড়িত ছিল তাদের অস্ত্রগুলো যেন জব্দ করা হয়। হয়তো তদন্তের খাতিরে এটা করতেই হবে। যাদের ওপর তদন্তভার অর্পণ করা হয়েছে তারা অত্যন্ত দক্ষ। তিনি বলেন, সিনহা হত্যার বিচার যদি দ্রুত নিষ্পত্তি হয় তাহলে হয়তো সিনহা বা সিনহার মতো ভুক্তভোগীর আত্মা শান্তি পাবে।

রাওয়া চেয়ারম্যান বলেন, ১৪০টা যে মার্ডার করেছে ওসি প্রদীপ। আজ দেখেন আমরা সিনহা হত্যার ব্যাপারে সোচ্চার হতে পেরেছি। কিন্তু ওই যে দেখেন ওই সেই লোকগুলোর পরিবার তো মুখ খুলতে পারছে না। তাদের সাথে কোনো সংস্থা নেই, অবসরপ্রাপ্ত কল্যাণ সংস্থা নেই। মিডিয়াই পাশে দাঁড়িয়েছে, লিখেছে। আমরা চাই একটা একটা করে সব ঘটনার বিচার করা হোক। এক্সট্রা জুডিশিয়াল কিলিং যে প্রদীপ করেছে সেগুলোর বিচার হোক।
তিনি বলেন, এটা তো বলার অপেক্ষায় রাখে না, এক্সট্রা জুডিশিয়াল কিলিংয়ের কারণে যদি বাংলাদেশ ডিস্টার্ব হয়ে যায়! পুলিশ বাহিনী যাতে পুনর্গঠিত করে, পুলিশকে নিয়ন্ত্রণে যে সিস্টেম দেয়া আছে ডিসির আওতায় সেটা যেন থাকে এবং ডিসির ভিজিট করার কথা, দিকনির্দেশনা বিধিগুলো থাকার কথা সেটা যেন পালন করে। যদি সুপারভিশন ঠিক থাকে তাহলে তখন একটা পুলিশও উদ্ধৃত হতে পারে না। একটা রঙ কনফিডেন্স গ্রো করেছে, কারণ তার কোনো বিচার হয়নি। সে একটার পর একটা আকাম-কুকাম করে গেছে সেটা নজরে আসেনি। কী কারণে আসেনি, আমরা তা ঠিক বুঝতে পারছি না। আমরা চাই এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটুক, আর কোনো মায়ের বুক খালি না হোক, এসব ঘটনা নিয়ে আর কোনো কথাবার্তা হোক। সেনাবাহিনীও অনুসন্ধান (ইনকোয়ারি) করছে, সর্বক্ষণ মনিটরিং করছে। আমরা রাওয়ার পক্ষ থেকে জুডিশিয়াল ইনভেস্টিগেশন মনিটরিং সেল করেছি, আরেকটা করেছি মিডিয়া মনিটরিং সেল। চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে মেজর সিনহা নিহতের ঘটনাটি যেন বিচারবহির্ভূত শেষ হত্যাকান্ড হয় বলে আশা প্রকাশ করেন রাওয়া চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর খন্দকার নুরুল আফসার।

শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত বিচার চাইবেন শিপ্রা: র‌্যাবঃ শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত শিপ্রা দেবনাথ তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের বিচার চাইবেন। র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে এ কথা বলেছেন শিপ্রা দেবনাথ। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ এ কথা বলেন।
তিনি আরো বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে র‌্যাবের কাছে অত্যন্ত স্পর্শকাতর তথ্য দিয়েছেন শিপ্রা। ঘটনায় সাক্ষী হিসেবে প্রথমে শিপ্রাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, তারপর সিফাতকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। ইনকিলাব

Loading