প্রধানমন্ত্রীর ১১ নির্দেশনা

সচিবরা শুধু নিজেদের সুবিধা চাইলেন

প্রকাশিত: ৮:২৩ পূর্বাহ্ণ , নভেম্বর ২৮, ২০২২

দীর্ঘ প্রতিক্ষিত সচিব বৈঠকে রাষ্ট্রের সবচেয়ে উচ্চপদে কর্মরত আমলারা (সচিব) প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিজেদের সুযোগ সুবিধার দাবিই বেশি জানালেন। মানুষের কল্যান ও প্রশাসনকে গতিশীল করতে নানামুখি পদক্ষেপ, সুপারিশ ও প্রস্তাবনা তাদের কাছে যেন গৌন। প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে ১২/১৩ জন সিনিয়র সচিব ও সচিব বক্তব্য দিয়েছেন। তবে বক্তব্যের তালিকায় ১৭ জনের নাম ছিল। প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিদেশ প্রশিক্ষণ ও বিদেশ সফর ব্যবস্থা থাকাসহ নিজেদের জন্য নানান সুযোগ সুবিধার দাবি করেছেন। তবে তাদের দাবিতে তেমন সাড়া দেননি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দাবি গুলোর মধ্যে শুধু সরকারি কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব দিতে হবে না এ বিষয়ে প্রস্তাবে সাড়া দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তবে তিনি সচিবদের সব কথা শুনলেও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে করণীয়, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত, আমদানি ইস্যুতে ব্যয় সংকোচন, বিদেশী ঋনের টাকার প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে ফিজিবিলিটি স্টাডি ঠিকভাবে করা এবং কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধিকরাসহ ১১ নির্দেশনা দেন।

গতকাল রোববার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস-সংক্রান্ত জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির (নিকার) সভা ও সচিব সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা দুটিতে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৈঠখ শেষে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। তিনি জানান, ভবিষ্যতে বাংলাদেশ যাতে অর্থনৈতিক সংকটে না পড়ে, সে জন্য সংশ্লিষ্টদের আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে করণীয়, আমদানি ইস্যুতে ব্যয় সংকোচন, প্রকল্প বাস্তবায়নে ফিজিবিলিটি স্টাডি ঠিকভাবে করা, কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধি, তথ্য-প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে আয়, রেমিট্যান্স বাড়ানোর বিষয়ে পদক্ষেপ, জঙ্গি ইস্যুতে সতর্ক থাকা, বাজার দর নিয়ন্ত্রণ, ভূমির ই- রেজিট্রেশন ইস্যু এবং প্রশাসনে সুশাসনের উপর জোর দেয়ার উপর নির্দেশনা দিয়েছেন।

করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্টি বৈশ্বিক পরিস্থিতির কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমরা এখনই যে বিপদে পড়েছি তা কিন্তু না। কিন্তু আমার কথাটা হচ্ছে, আমার আগাম ব্যবস্থাটা নিতে হবে যেন ভবিষ্যতে কোনো বিপদে দেশ না পড়ে বা দেশের মানুষ না পড়ে। আমাদের সেই সতর্কতাটা একান্তভাবে দরকার এবং সেই সতর্কবার্তাটাই কিন্তু আমরা দিচ্ছি। সরকারি কর্মকর্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। আত্মবিশ্বাসী থাকতে হবে, সেভাবে মানুষকে সঙ্গে নিজে কাজ করতে হবে। তবে এ অবস্থায় বাংলাদেশ যেন কখনোই সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষের কবলে না পড়ে সেজন্য জনসচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে সচিবদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, এটি আমার কথা নয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বলা হচ্ছে যে বিশ্বে দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। দুর্ভিক্ষ আমাদের দেশকে কখনই যেন ক্ষতিগ্রস্ত করতে না পারে সেজন্য এখন থেকেই আমাদের আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। উন্নত দেশগুলোর রিজার্ভের প্রসঙ্গ তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, যুদ্ধের কারণে দু-একটি দেশ হয়তো খুব লাভবান, কিন্তু বেশিরভাগ দেশ একেবারে যারা উন্নত দেশ তারাও কিন্তু হিমশিম খাচ্ছে। সেই দিকে লক্ষ্য রেখেই আমাদের এখন ব্যয় সীমিত করা দরকার, সাশ্রয়ী হওয়া দরকার।

সচিব সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের রিজার্ভ যেটা হচ্ছে আমাদের তিন মাসের খাদ্য কেনার মতো রিজার্ভ থাকলেই যথেষ্ট। সেখানে আমাদের পাঁচ-ছয় মাসের হিসাব আছে। তারপরও এখন যা অবস্থা, তাতে আমাদের একটু সাশ্রয়ী হতে হবে, আরেকটু সচেতন হতে হবে।

সবাইকে সাশ্রয়ী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আমি মনে করি আমাদের নিজেদেরও সাশ্রয়ী হওয়া এই কারণে দরকার, আবার আমি বলছি যে, আমরা ভবিষ্যতে যাতে সমস্যায় না পড়ি। কাজেই এখন থেকে আমাদের সেই ব্যবস্থা নেওয়া একান্তভাবে দরকার। এ সময় বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার পরামর্শ দেন শেখ হাসিনা।
গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বিচার করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রকল্প নেওয়ার নির্দেশনা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আমাদের সব পরিকল্পনা বা প্রকল্প বাছাই করতে হবে। বেছে নিয়ে এবং কোনগুলো দ্রুত শেষ করা যায়, আমরা সেগুলো আগে শেষ করে নতুনটি যাতে ধরতে পারি সেই ব্যবস্থা নিতে হবে।

মাদক-জঙ্গিবাদের বিষয়ে সবাইকে সচেতন থাকার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের একটি ঘটনা ঘটেছিল হলি আর্টিজানে। আমরা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সেটি নিয়ন্ত্রণ করি। তারপর থেকে আর বাংলাদেশে এই রকম কোনো দুর্যোগ দেখা দেয়নি। কিন্তু তারপরও বাংলাদেশের ওপর অনেকেরই নানা রকম প্রভাব আছে। শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের এসব বিষয়ে সবসময় সজাগ থাকতে হবে। মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। মাদক-জঙ্গিবাদ থেকে আমাদের যুবসমাজ যেন দূরে থাকে, সেইদিকে আমাদের বিশেষভাবে দৃষ্টি দেওয়া একান্তভাবে দরকার।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, প্রতিবছর আয়কর রিটার্ন দাখিলের সময় এক পৃষ্ঠায় সম্পদের যে বিবরণী দিতে হয়, সেটি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় দাখিল করবেন সরকারি কর্মচারীরা। সরকারি কর্মচারীদের আর আলাদা করে সম্পদের হিসাব সরকারকে দিতে হবে না। এনবিআর, আমি ও জনপ্রশাসন সচিব বসেছিলাম। বিষয়টি ক্লিয়ার করে দিয়েছি, সম্পদের হিসাব আর আলাদা করে দেওয়ার দরকার নেই। প্রতিবছর আমরা যে রিটার্ন দেই সেখানে একটি পৃষ্ঠার মধ্যে সম্পত্তির হিসাব দিতে হয়, ওই পেইজটা জনপ্রশাসনকে দিয়ে দেবো। এ বিষয়ে এনবিআর অনাপত্তি দিয়েছে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, এনবিআর বলেছে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। এখন সার্কুলার হয়ে যাবে। আমরা ওই পেইজটাই অনলাইনে জনপ্রশাসনকে জমা দিয়ে দেবো। সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯’ অনুযায়ী পাঁচ বছর পর পর সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদ বিবরণী দাখিল এবং স্থাবর সম্পত্তি অর্জন বা বিক্রির অনুমতি নেওয়ার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা এ নিয়ম মানছেন না,এ বিষয়ে এতদিন সরকারেরও কোনো তদারকি ছিল না। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুশাসনের পরিপ্রেক্ষিতে বিধিমালাটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে সম্পদ বিবরণী দাখিল ও স্থাবর সম্পত্তি অর্জন বা বিক্রির নিয়ম মানতে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সিনিয়র সচিব/সচিবদের কাছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে গত বছরের ২৪ জুন চিঠি পাঠানো হয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এই চিঠির পর মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো অধীন দপ্তর-সংস্থাসহ নিজেদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তাগিদ দিয়েই যাচ্ছে। কিন্তু সম্পদের হিসাব দিতে সাড়া নেই সরকারি কর্মকতাদের।

সচিব সভায় জ্বালানি বিভাগের সিনিয়র সচিব মো.মাহবুব হোসেন জানিয়েছেন, ব্রুনাই থেকে আগামী বছরের শুরুতে এলএনজি আমদানি শুরু হতে পারে। ব্রুনাই সফররত বাংলাদেশি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করার বিষয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। ব্রুনাই বছরে অন্তত দেড় মিলিয়ন টন এলএনজি বাংলাদেশকে দেবে বলে আশা করা হচ্ছে। চুক্তিটি হলে সেটি হবে ১০ থেকে ১৫ বছর মেয়াদি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সচিবালয়ে কর্মরত এক কর্মচারী ইনকিলাবকে বলেন, বর্তমান বাজারে যে অবস্থা সেখানে ১৬/২০ হাজার টাকার চাকরি করে সংসার চলা কঠিন হয়ে পড়েছে। অর্থচ প্রশাসনের বড় বড় সচিবরা যে দাবি করেন সেই সরকার বাস্তবায়ন করছেন।

Loading