আযানের ধ্বনি কত সুমধুর

প্রকাশিত: ৮:১৬ পূর্বাহ্ণ , এপ্রিল ২৮, ২০২২

এ. কে. এম. ফজলুর রহমান মুন্শী

বালক বেলায় যখন উস্তাদজীর নিকট দোয়া-কালাম, আমপারা ও কোরআন পাঠ শিখতাম, তখন তিনি আমাদেরকে আযান কবিতার এই লাইনগুলো মুখস্ত করিয়েছিলেন;
‘কে ঐ শুনাল মোরে আযানের ধ্বনি,
মর্মে মর্মে সেই সুর বাজিলকি সুমধুর,
আকুল হইল প্রাণ নাচিল ধমনী।’

আজ জীবন যাত্রার পড়ন্ত বেলায় সে কবিতার লাইনগুলো হৃদয়ের তারে তারে প্রাণের শোনিতধারে গুঞ্জরিত হয়ে চলেছে এবং শিরা উপশিরায় তীব্র প্রভঞ্জন সৃষ্টি করছে। এ যেন এক অতি প্রাকৃতিক আহ্বান ধ্বনি, যার মাঝে ‘যাতে এলাহী ও নূরে এলাহীর’ নূরের বিকিরণ প্রতিনিয়ত ঘটেই চলেছে। কেননা, ঘূর্ণায়মান পৃথিবীর এমন কোনো মুহূর্ত নেই, যাতে কোথাও না কোথাও আযানের ধ্বনি উচ্চারিত হচ্ছে না।

আরবি আযান শব্দের অর্থ হলো ‘আল-ই’লাম’ অর্থাৎ জানিয়ে দেয়া, শুনিয়ে দেয়া ঘোষণা জারি করা। আযান উচ্চারণের মাধ্যমে নামাজে উপস্থিত হওয়ার ঘোষণাই নিকট ও দূরের মুমিন-মুসলমানদেরকে জানিয়ে দেয়া হয়।
আযান শব্দটির বহুরূপী ব্যবহার আল্ কোরআনে লক্ষ্য করা যায়। নিম্নে আমরা সে দিকগুলো সম্পর্কে আলোকপাত করতে প্রয়াস পাব। আসুন, এদিকে লক্ষ্য করা যাক।

(ক) আযান শব্দটি সরাসরি আল কোরআনের নয় নং সূরা তাওবাহ-এর তিন নং আয়াতে সন্নিবেশিত হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে : ‘আর মহান হজ্জের দিনে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে লোকদের প্রতি ঘোষণা করে দেয়া হচ্ছে যে, আল্লাহ মুশরেকদের থেকে দায়িত্বমুক্ত এবং তাঁর রাসূল ও। অবশ্য যদি তোমরা তাওবাহ কর তবে তা তোমাদের জন্যে কল্যাণকর, আর যদি মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে জেনে রেখ, আল্লাহকে তোমরা পরাভূত করতে পারবে না। আর কাফেরদেরকে মর্মান্তিক শাস্তির সুসংবাদ দাও’।

এই আয়াতে কারীমার ‘ইয়াত্তমাল হাজ্জিল আকবারে’ অর্থাৎ মহান হজ্জের দিনে বাক্যের অর্থ ও মর্ম নিয়ে তাফসীর কারদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.), হযরত ওমর ফারুক (রা.), হযরত আবদুল্লাহ বিন ওমর (রা.) এবং হযরত আবদুল্লাহ বিন যুবায়ের (রা.) প্রমুখ সাহাবায়ে কেরাম বলেন : ‘ইয়াওমাল হাজ্জিল আকবারি’ বাক্যের অর্থ আরাফাতের দিন। কারণ, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল হাজ্জু আরাফাতুন’ অর্থাৎ হজ্জ হল আরাফাতের দিন। (সুনানে আবু দাউদ)।

আবার কেউ কেউ বলেন, এর অর্থ কোরবানির দিন বা দশই যিল হজ্জ। হযরত সুফিয়ান সাওরী (রহ:) ও কতিপয় ইমামগণ উল্লেখিত উক্তিগুলোর সমন্বয় সাধনের উদ্দেশ্যে বলেছেন, হজ্জের প্রথম পাঁচ দিন হলো হজ্জে আকবারের দিন। এতে আরাফাত ও কোরবানির দিনগুলোও শামিল রয়েছে। তাছাড়া ওমরার অপর নাম হলো হজ্জে আসগর বা ছোট হজ্জ। এর থেকে হজ্জকে পৃথক করার জন্য বলা হয়েছে, হজ্জে আকবার। (খ) আযান শব্দের মূলধাতু ‘ইজনুন’ হতে উৎপন্ন ‘আযযানা’ ও ‘মুয়াজ্জিনুন’ শব্দের ব্যবহার ও আল-কোরআনে লক্ষ্য করা যায়।

কোরআনুল কারীমের সাত নং সূরা আল আ’রাফের ৪৪ নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে : ‘জান্নাতীরা দোজখীদেরকে ডেকে বলবে: আমাদের সাথে আমাদের প্রতিপালক যে ওয়াদা করেছিলেন, তা‘আমরা সত্য পেয়েছি। অতএব তোমরাও কি তোমাদের প্রতিপালকের ওয়াদা সত্য পেয়েছ? তারা বলবে, হাঁ, অতঃপর একজন ঘোষক (মুয়াজ্জিন) উভয়ের মাঝখানে ঘোষণা করবে (আজ্জানা) : আল্লাহর অভিশম্পাৎ জালেমদের ওপর’।

এই আয়াতেকারীমায় আযান শব্দের মৌলিক অর্থের ব্যবহার মূর্ত হয়ে ফুটে উঠেছে। বস্তুত : নামাজের সময় হলে মুসল্লীদেরকে নামাজের জন্য প্রস্তুত হওয়ার ও জামাআতে হাজির হওয়ার জন্য আহ্বান জানানোকেই কোরআনী পরিভাষায় আযান বলা হয়। আযান নামাজের উদ্দেশ্যে মুসল্লীদেরকে ডাকার জন্য ইসলামের স্থায়ী বিধান। এ বিধান নড়চর হওয়ার কোনো জো নেই।

(গ) আযান ও উহার বাক্যসমূহ রাসূলুল্লাহ (সা.) স্বয়ং আল্লাহপাকের নিকট হতে ওহীর মাধ্যমে জানতে পেরেছিলেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন : ‘নিশ্চয়ই আযান দেওয়ার রীতি নামাজ ফরয হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহপাকের নিকট হতে অবতীর্ণ হয়েছে’। এ কথার অকাট্য প্রমাণ আল কোরআনের নিম্নোক্ত আয়াত-দ্বয় হতেও লাভ করা যায়।

যথা : (১) আল কোরআনের পাঁচ নং সূরা আরাফ-এর আটান্ন নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে । ‘আর যখন তোমরা নামাজের জন্য আহ্বান কর, তখন তারা একে উপহাস ও খেলাবলে মনে করে। আর এর কারণ এই যে, তারা আসলে বিবেক বুদ্ধিহীন লোক’। এই আয়াতে নামাজের জন্য ঘোষণা দাও অর্থ হলো, মুয়াজ্জিন যখন নামাজের জন্য আযান দেয়।

(২) আল কোরআনের বাষট্টি নং সূরা জুম্য়া-এর ৯ নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে : ‘জুময়ার দিন যখন নামাজের জন্য আযান দেয়া হয়, তখন আল্লাহর জিকিরের দিকে দৌঁড়ে এস’।

উপরোক্ত দু’টি আয়াত মদীনায় অবতীর্ণ। আর আযান দেওয়ার রেওয়াজ যে মদীনা শরীফেই চালু হয়েছে, তা’ হাদীস হতে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত। সুতরাং আযান নিছক স্বপ্নযোগে প্রাপ্ত বিষয় নয়। বরং ইহা নিঃসন্দেহে আল্লাহর নিকট হতে ওহী যোগেও অবতীর্ণ।

Loading