প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব গ্রহণের মধ্যদিয়েই শেষ এফএও সম্মেলন

প্রকাশিত: ১২:৫৮ অপরাহ্ণ , মার্চ ১২, ২০২২

৩৬তম এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের আঞ্চলিক সম্মেলন। সবুজ টেকসই কৃষি ব্যবস্থার বাস্তবায়ন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় ক্ষতিপূরণের অর্থ আদায়, কৃষির ডিজিটালাইজেশনসহ সুনিদিষ্ট প্রস্তাব এসেছে দুই দিনব্যাপী সম্মেলনের পাস হওয়া প্রতিবেদনে।

সম্মেলনে অংশ নেয়া শ্রীলঙ্কার মন্ত্রী জানান, উপকূলীয় ছোট ছোট দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনে কিভাবে অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি। সম্মেলনে মালদ্বীপের প্রতিনিধি বলেছেন, মালদ্বীপের অস্তিত্বই থাকবে না।

তাই এটাকেই এখন বলা হচ্ছে- সবচেয়ে বড় সংকট। ভাবিষ্যৎ নয়, পরিবর্তনের প্রভাব দৃশ্যমান। সেখানে শুধু ফুড সিস্টেম নয়, জীববৈচিত্র্য রক্ষাই বড় চ্যালেঞ্জ।

ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো এখন আর ঋণ নয়, চায় ক্ষতিপূরণ। একজন মানুষও যেন পিছিয়ে না থাকে এজন্যে একটি সমন্বিত উদ্বেগের প্রস্তাব আসে আলোচনায়।

এমনিতেই বিশ্বে, খাদ্যপণ্যে উচ্চমূল্যের কারণে উৎকণ্ঠা খাদ্য ও কৃষি সংস্থার। সেই বাস্তবতায় চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে খাদ্যের দাম আরো বৃদ্ধির শঙ্কা সংস্থাটির।

করোনা মহামারিতে এমনিতেই মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে বিশ্বের কৃষি ব্যবস্থার। সার, বীজ, কীটনাশকের দাম কৃষকের নাগালের মধ্যে রাখাসহ খাদ্য সহায়তা কিভাবে অব্যাহত রাখা যায়, সে কৌশল খোঁজার তাগিদ দিয়েছেন সদস্য রাষ্ট্রের মন্ত্রিরা।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার দ্বি-বার্ষিক পরবর্তী সম্মেলন শ্রীলঙ্কায় হবে বলেও সিদ্ধান্ত এসেছে এবারের সম্মেলনে।

ঢাকায় চারদিনব্যাপী অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার এই সম্মেলনের শেষ দিনে নির্ধারিত সংবাদ সম্মেলনে এফএও-এর ঢাকা সম্মেলনের সিদ্ধান্তের কথা তুলে ধরেন কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক।

এসময় সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন- খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, কৃষি সচিব মো. সায়েদুল ইসলাম এবং খাদ্য সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম।

কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এবারের সম্মেলনের লক্ষ্য ছিল সাসটেইনেবল ডেভলপমেন্ট গোল (এসডিজি)-১ এ দারিদ্র্য শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা এবং এসডিজি-২ এ আছে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, অর্থাৎ নো হাঙ্গার। তৃতীয় বিষয়টি ছিল জলবায়ু পরিবর্তন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যেসব সমস্যা তৈরি হচ্ছে, এর যেসব প্রভাব প্রকৃতি ও কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার উপর পড়ছে। এগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মানবজীবনের সবকিছুই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে, আক্রান্ত হবে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে কৃষি। মানুষের মৌলিক যে চাহিদা সেই খাদ্য হচ্ছে সবচেয়ে বেশি হুমকির সম্মুখিন।

মন্ত্রী বলেন, ইন্টার গর্ভমেন্টাল কমিটি অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইজিসিসি) তাদের মূল্যায়ন প্রতিবেদনে জানিয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুরোর মধ্যে বাংলাদেশ ষষ্ঠ অবস্থানে। এই সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী দেশগুলো এ ব্যাপারে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

কৃষিমন্ত্রী বলেন, এখানে একটি বিষয় সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে যে, জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে খারাপ প্রভাব ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। যেটা আমরা ভেবেছিলাম তার চেয়ে অনেক বেশি দ্রুত এটি হচ্ছে এবং অনেক বেশি দৃশ্যমান। এই দিকটা নিয়ে আলোচনা হয়েছে এবং ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য কী ধরণের কর্মকৌশল হবে, কী ধরণের কর্মসূচি হবে এবং গ্রাউন্ড লেভেলে কী ধরণের অ্যাকশন কর্মসূচি নেয়া হবে এবং এখানে এফএও’র কী ভূমিকা হবে? তাদের কৌশল কী, তারা কিভাবে এপিআরসি’র দেশগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সহযোগিতা করবে। সেগুলো নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে এবং ঢাকা সম্মেলনের সুপারিশ এবং চূড়ান্ত রিপোর্ট যেটি গ্রহণ করা হয়েছে সেটিতে এই বিষয়টি এসেছে।

আব্দুর রাজ্জাক বলেন, কোভিড-১৯ এর যে প্রভাব সেটি আমাদের অর্থনীতির উপর ব্যাপকভাবে পড়েছে। কৃষির উপরেও পড়েছে। তবে বাংলাদেশে যে ধরণের প্রভাব পড়তে পারত সেই মাত্রায় পড়েনি। প্রধানমন্ত্রী তার যোগ্য নেতৃত্ব ও দৃঢ়তার কারণে আমরা কোভিড-১৯ ভালোভাবে মোকাবেলা করেছি।

তিনি বলেন, অনেকেই বলেছিল বাংলাদেশে খাদ্য সংকট হবে, দুর্ভিক্ষ হবে, খাদ্য নিয়ে একটা সংকট তৈরি হবে। ইনশাল্লাহ , খাদ্য নিয়ে তেমন সংকট হয়নি।

তিনি বলেন, চালের দাম, খাদ্যের দাম কিছুটা বেড়েছে। শাকসবজির দাম বেড়েছে। এগুলো নিয়ে সরকার খুবই সতর্ক। একে বিবেচনায় নিয়ে সরকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে খাদ্য শস্যের দাম কিভাবে মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখা যায়।

কৃষিমন্ত্রী বলেন, স্টেইট অভ এগ্রিকালচার এন্ড ফুড নিয়েও আলোচনা হয়েছে। কি অবস্থায় আছে এবং কিভাবে এটি মোকাবেলা করা হচ্ছে। কোভিড-১৯ এর কারণে চালের উৎপাদন কমে গেছে। বিভিন্ন দেশে পটাশিয়ামের খনি, টিএসপির খনি এগুলোতে শ্রমিকরা কাজ করে নাই। কিন্তু বেতন নিয়েছে। যার পলে অস্বাভাবিকভাবে সারের দাম বেড়ে গেছে।

তিনি বলেন, দুইটা দিক আলোচনা হয়েছে। একটি হচ্ছে- এই অতিমারির পর কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থাকে অব্যাহত রাখা, এটাকে সাসটেইন করা। দ্বিতীয়টি হচ্ছে-সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোকে আরও শক্তিশালী করা। সে ব্যাপারে ডাব্লিউএফপি, এফএও, কৃষি সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলো এজন্য চেষ্টা করবে। কিভাবে খাদ্য সাহায্য বাড়ানো যায়, বিভিন্ন দরিদ্র এলাকায় মানুষ যাতে খাদ্য সংকটে না পড়ে, তাদের যেন কষ্ট না হয় এই বিষযগুলো আলোচনা হয়েছে।

কৃষিমন্ত্রী জানান, আরেকটি বিষয় গুরুত্ত্বসহকারে আলোচনা হয়েছে । সেটি হল ডিজিটালাইজেশন। সায়েন্স, ইনোভেশন এবং টেকনোলজির উপর গুরুত্ত্ব দেওয়া হয়েছে। কৃষির উৎপান বাড়ানোর জন্য আরো নতুন নতুন জাত আবিস্কার করা। প্রযুক্তি আবিস্কার করা। শুধু আবিস্কার করলেই হবে না, এগুলো এলাকায় নিয়ে যেতে হবে। কৃষককে প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে।

টেকনোলজিগুলো শুধু আবিস্কার করলে হবে না। সেগুলোকেও মাঠে নিয়ে যেতে হবে এবং কিভাবে এর ব্যবহার করা হবে সেটাও দেখতে। সে বিষয়ে এফএও কি ভূমিকা রাখবে, এখানে এফএও’র সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রয়েছে। এগুলো নিয়ে কথা হয়েছে।

আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা স্যালাইন এলাকাগুলোতে কিভাবে ফসল ফলানো যায়। এছাড়া মৎস্য, প্রাণী সম্পদ, পোল্ট্রি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

ডিজিটালাইজেশনের উপর গুরুত্ত্ব দিয়ে বলা হয়েছে, উৎপাদন পর্যায়ে চাষিকে প্রযুক্তির মাধ্যমে মোবাইলে পরামর্শ দেওয়া। উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যন্ত মাকেটিংটাকে কিভাবে ডিজিটাল করতে পারি সে নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

আমরা বাংলাদেশ থেকে একটা প্রস্তাব দিয়েছি। যে এফএও আঞ্চলিক (এপিআরসি) পর্যায়ে একটা ডিজিটাল অ্যাপ করে। যার মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া দেশসমূহকে প্রযুক্তি দিয়ে সাহায্য করা যায়।

তিনি জানান, কৃষিতে গবেষণা ও উদ্ভাবনের জন্য একটি ‘ বিশেষ ফান্ড’ গঠনের জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এ সম্মেলনে এটিকে চূড়ান্ত রিপোর্টের মধ্যে গ্রহণ করা হয়েছে।

আব্দুর রাজ্জাক জানান, মানুষ, প্রাণি ও পরিবেশের স্বাস্থ্য রক্ষায় ‘‘ওয়ান হেলথ অ্যাপ্রোচ’’ গ্রহণ করা হয়েছে। ওয়ান হেলথ অ্যাপ্রোচ গড়ে তুলতে অগ্রাধিকার চিহ্নিতকরে রিপোর্ট চূড়ান্ত করা হয়। জুনোটিক বা প্রাণি থেকে মানুষে সংক্রমিত রোগের প্রকোপ দিনদিন বেড়ে চলেছে। চলমান কোভিড এর অন্যতম উদাহরণ। এ অবস্থায় এ অঞ্চলে ওয়ান হেলথ অ্যাপ্রোচ গড়ে তুলতে সম্মত হয়েছে দেশগুলো।

তিনি জানান, ভালো পরিবেশেই শুধু ভালো জীবনযাপন করা সম্ভব। এজন্য এশিয়া প্যাসিফিকে যে খাদ্য যতটা পাওয়া যাচ্ছে সেটা যেন নিরাপদ এবং পুষ্টিকর হয়-সেটা নিশ্চিত করতে সকল দেশ একমত রয়েছে।

Loading