চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ভালো

প্রকাশিত: ১০:১১ পূর্বাহ্ণ , অক্টোবর ২২, ২০২১

৭৭৩ কোটি টাকার এই প্রকল্পের মধ্যে চীনের অনুদান ৫২১ কোটি, বাংলাদেশ সরকার ২৩১ চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সব সময় ভালো সম্পর্ক বলে জানালেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে যারা সহযোগিতা করেন তাদের সঙ্গে অবশ্যই আমাদের একটা ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠবে এটা খুবই স্বাভাবিক। চীনের সঙ্গে আমাদের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। গতকাল ‘বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টার’ উদ্বোধন করে তিনি এ মন্তব্য করেন। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের প্রসঙ্গ তুলে ধরে তিনি বলেন, ১৯৫২ সালে জাতির পিতা প্রথম চীন ভ্রমণ করেন। তার (বঙ্গবন্ধু) নয়া চীন ভ্রমণ বইটা যদি আপনারা পড়েন তাহলে জানতে পারবেন চীন সম্পর্কে। তখনকার সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশটি কিভাবে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছিল সেই বিষয়গুলো চমৎকারভাবে তিনি লিখে গেছেন। এরপর তিনি (বঙ্গবন্ধু) যখন মন্ত্রী ছিলেন ১৯৫৭ সালে আবার চীন ভ্রমণ করেন। কাজেই চীনের সঙ্গে আমাদের সব সময় একটা ভালো সম্পর্ক রয়েছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে আধুনিক স্থাপত্যের প্রদর্শনী কেন্দ্র উদ্বোধন করেন। আর পূর্বাচল প্রান্তে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ও ঢাকায় কর্মরত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিংসহ অন্যান্যরা উপস্থিত ছিলেন।
ব্যবসায়ীদের নতুন নতুন বাজার খোঁজার আহবান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেন আমরা বিনিয়োগ করতে পারি সে বিষয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাদের ব্যবসায়ীরা যেন বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ করতে পারেন ভবিষ্যতে সেই সুযোগটা সৃষ্টি করব। আমাদের দেশে যেমন বিনিয়োগ হবে তেমনি আমরা অন্য দেশেও যেন বিনিয়োগ করতে পারি সেজন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। কারণ আমরা উন্নয়নশীল দেশ হয়ে গিয়েছি। কাজেই আমাদের শিল্প উদ্যোক্তারা বিদেশে বিনিয়োগ করবে, সেই সুযোগটাও আমরা সৃষ্টি করতে চাই।
প্রধানমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে বলেন, আমাদের রফতানি আয় বাড়ানর জন্য যেটা সবচেয়ে বড় প্রয়োজন সেটা হলো আমাদের পণ্য বহুমুখীকরণ করা। আমরা এখন একমুখী, একটা কিছুর উপরেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। যেমন আমাদের পোশাকশিল্প। তিনি বলেন, আমাদের রফতানি টিকেয়ে রাখতে হলে নিজস্ব প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে হবে। আমি আমাদের ব্যবসায়ীদের বলব, যখন আপনারা পণ্য উৎপাদন করবেন সেটা সময়ের চাহিদার সঙ্গে মিলিয়ে উন্নত মানের পণ্য উৎপাদন করতে হবে। সেখানে কিন্তু কৃপণতা করলে চলবে না। সেটা যদি আপনারা করতে পারেন তাহলে বাজারে টিকে থাকতে পারবেন। আর আমাদের যত শিল্পখাত আছে তাদের এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে, সেই বিষয়ে আমি আপনাদের বলতে পারি, আমাদের সরকারের পক্ষ থেকে যত ধরনের সহযোগিতা প্রয়োজন সেই সহযোগিতাটা আপনারা পাবেন। সেটা আমরা আপনাদেরকে দেব। কিন্তু আপনাদের নিজস্ব উদ্যোগটাও থাকতে হবে। আর আমাদের দেশের পণ্যের বৈচিত্রকরণটাও সম্ভব। যেমন এখন আমরা আইসিটি অর্থাৎ ডিজিটাল ডিভাইস প্রস্তুত করছি এবং এই ক্ষেত্রে বিনিয়োগও আসছে। আমি মনে করি এই ডিজিটাল ডিভাইসগুলো হবে একসময় সবচেয়ে বড় রফতানি পণ্য। কাজেই সেখানে আমাদের একটা বড় সুযোগ রয়েছে। এসময় অন্যান্য পণ্যের পাশাপাশি পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়া শিল্পসহ অন্যান্য রফতানিমুখি পণ্যগুলোর উপরেও জোর দিতে ব্যবসায়ীদের প্রতি আহবান জানান। প্রধানমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের নতুন নতুন বাজার খোঁজার আহবান জানিয়ে বলেন, আমাদের শুধু একমুখী হলে হবে না। কোন দেশে কোন পণ্যের চাহিদা বেশি সেটাও ঠিক করতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য দিয়েই কিন্তু উন্নতি হয়। কাজেই সেই ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগটা সৃষ্টি করার জন্য আমরা এই সেন্টারটি (বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টার) তৈরি করেছি। বাংলাদেশের পণ্য নিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের জন্য রফতানি মেলার আয়োজন, সোর্সিং ফেয়ার আয়োজন এবং বাংলাদেশি পণ্যের ক্রেতা আকর্ষণের জন্য বছরব্যাপী বাণিজ্য প্রতিনিধি দলের সম্মেলন আয়োজনসহ দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারে বাণিজ্য মেলার আয়োজন করতে পারবেন, সেই সুযোগটাও সকলের ক্ষেত্রে সৃষ্টি হবে। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টার একটা স্থায়ী জায়গা আপনাদের হলো। কাজেই সংশ্লিষ্ট সকলকে আহবান জানাব, এই জায়গাটি যেন সুরক্ষিত থাকে এবং ভালো থাকে সেই দিকে সবাই দৃষ্টি দেবেন। এটা এখন আমাদের নিজস্ব সম্পদ হলো। স্থায়ী সম্পদ হলো। কাজেই আপনারা সেই সম্পদ যথাযথভাবে ব্যবহার করবেন এবং রক্ষা করবেন।

বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ অর্থায়নে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) পূর্বাচল নিউ সিটি প্রজেক্ট এরিয়ায় এই ‘বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টার কন্ট্রাকশন প্রজেক্ট’ গ্রহণ করে। ২০১৫ সালে রাজউকের পূর্বাচলে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর অনুক‚লে সরকার প্রথমে ২০ একর এবং পরে আরও ৬ দশমিক ১ একর জমি বরাদ্দ দেয়।
চীনের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) মালিকানায় পূর্বাচলে ২০ একর জায়গার ওপর এটি নির্মিত হয়েছে। নির্মাণে মোট ব্যয় হয়েছে ৭৭৩ কোটি টাকা। যার মধ্যে চীনের অনুদান ৫২১ কোটি, বাংলাদেশ সরকারের ২৩১ কোটি ও ইপিবি নিজস্ব তহবিল থেকে ২১ কোটি টাকার অর্থায়ন রয়েছে। এতে একেকটি ফ্লোরের আয়তন ৩৩ হাজার বর্গমিটার, বিল্ডিংয়ের ফ্লোরের আয়তন ২৪ হাজার ৩৭০ বর্গমিটার, এক্সিবিশন হলের আয়তন ১৫ হাজার ৪১৮ বর্গমিটার। এক্সিবিশন হলে ৮০০টি বুথ রয়েছে, প্রতিটি বুথের আয়তন ৯ দশমিক ৬৭ বর্গমিটার। দোতলা পার্কিং বিল্ডিংয়ের মোট পার্কিং স্পেস ৭ হাজার ৯১২ বর্গমিটার। যেখানে ৫০০টি গাড়ি রাখা যাবে আর এক্সিবিশন বিল্ডিংয়ের সামনের খোলা জায়গায় আরো ১ হাজার গাড়ি পার্কিং করার সুযোগ আছে।

এছাড়া রয়েছে ৪৭৩ আসনবিশিষ্ট ১টি মাল্টি-ফাংশনাল হল, ৫০ আসনবিশিষ্ট ১টি কনফারেন্স কক্ষ, ৬টি সভাকক্ষ, ৫০০ আসনবিশিষ্ট ক্যাফেটেরিয়া, শিশুদের খেলার স্পেস, নামাজের কক্ষ, অফিসকক্ষ ২টি, মেডিক্যাল কক্ষ, ১৩৯টি টয়লেট, বিল্ট ইন পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেম, নিজস্ব ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট, সিসিটিভি কন্ট্রোল কক্ষ ইত্যাদি। আধুনিক প্রদর্শনী কেন্দ্রটির নিজস্ব পানি শোধনাগার, সিসিটিভি কন্ট্রোল রুম, ইন্টারনেটের জন্য ওয়াইফাই সিস্টেম, একটি আধুনিক ঝর্ণা ও রিমোট-কন্ট্রোলড প্রবেশ দ্বার রয়েছে।

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, চীন সরকারের সহায়তায় আন্তর্জাতিক মানসম্মত দৃষ্টিনন্দন ‘বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টার’র নির্মাণ কাজ দ্রæত সম্পন্ন হয়েছে। যা করোনার সময় একটি দুরূহ কাজ ছিল, তারপরও সেটা সম্ভব হয়েছে। পণ্য পরিচিতি ও বহুমুখী করতে নতুন নতুন বাজার খুঁজে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের ব্যাপক পণ্যমেলার আয়োজন ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলায় যোগদানে রফতানিকারকদের সহায়তা দেওয়া ও বিভিন্ন রফতানি পণ্যে আর্থিক সহায়তা দেওয়ায় দেশের রফতানি উত্তরোত্তর বাড়ছে। তিনি আরো বলেন, নবনির্মিত ‘বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টারে’ সারা বছর পণ্য ও সেবাখাত ভিত্তিক মেলা আয়োজন, ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে পণ্য পরিচিতি-বিষয়ক আলোচনা, মতবিনিময়ের সুযোগ সৃষ্টি করে প্রদর্শনী কেন্দ্রটি একটি বিজনেস খাতে পরিণত হবে। এর আগে আমরা বছরে একবার মেলা করতাম। এখন স্থায়ী জায়গা হওয়ায় সারা বছর ধরে বিভিন্ন সংগঠন এটা ব্যবহার করতে পারবে, তাদের পণ্য দেখাতে পারবে। যার ফলে সারা বছর ধরেই আমরা এক্সিবিশন সেন্টারের উপকারিতা পাব।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব তপন কান্তি ঘোষ, বাংলাদেশে চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বক্তব্য রাখেন। পূর্বাচল নিউ সিটি প্রজেক্ট এরিয়ায় মূল অনুষ্ঠানস্থলে মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাবৃন্দ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাবৃন্দ এবং দেশি-বিদেশি আমন্ত্রিত অতিথিরা উপস্থিত ছিলেন।

সম্পর্ক জোরদারের তাগিত
এদিকে অন্য এক আন্তর্জাতিক ওয়েবাইনারে বাংলাদেশকে দরিদ্র্যমুক্ত করতে এবং দেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের তালিকায় নিয়ে যাওয়ার যে লক্ষ্যে বর্তমান সরকারকে চীনের কৌশল গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। ‘দারিদ্র্য বিমোচন: বাংলাদেশ ও চীনের অভিজ্ঞতা’ শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক ওয়েবাইনারে চীনের সাথে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরো জোরদারের লক্ষ্যে দুই বছর মেয়াদী ২৫ সদস্যের অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-চায়না এলামনাই (অ্যাবকা)- এর কার্যনির্বাহী কমিটি ঘোষণা করা হয়। চীনে নিযুক্ত সাবেক বাংলাদেশী রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফায়েজ আহমদকে সভাপতি এবং সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডক্টর মো: সাহাবুল হককে সাধারণ সম্পাদক করে এই কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়।

অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন সহযোগী চীনের কাছ থেকে যেমন অনেক কিছু শেখার আছে, তেমনি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ অত্যন্ত দ্রæততার সাথে যে উন্নয়ন ও অগ্রগতি সাধন করছে তা থেকেও অন্য দেশগুলোর জন্য অনেক শিক্ষনীয় বিষয় রয়েছে। বাংলাদেশ চীনের মধ্যে বিদ্যমান গভীর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উল্লেখ করে দীপু মনি বলেন, সাধারণত দুই দেশের কুটনৈতিক সম্পর্কের ৪৬ তম বার্ষিকী নিয়ে অনেকেই কথা বলেন। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি এই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরো বহুদিনের পুরোনো। দুই দেশের সম্পর্কের গোড়া অন্তত আরো দুই হাজার বছরের পুরোনো। তিনি বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক খাতে চীনের ব্যাপক সহযোগিতার প্রশংসা করে বলেন, ভবিষ্যতে এই সম্পর্ক আরো জোরদার হবে।

অনুষ্ঠানে চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বাংলাদেশকে দরিদ্রমুক্ত করতে শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্বের প্রশংসা করেন এবং বাংলাদেশের এই অগ্রগতিতে বন্ধুপ্রতীম দেশ চীনেরও অনেক আন্তরিক সহযোগিতা ছিল বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থী এখন তাদের বিদেশে উচ্চ শিক্ষার জন্য চীনকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। বর্তমানে প্রায় ১২ হাজার বাংলাদেশী চীনে অধ্যয়ন করছে। চীনে উচ্চতর শিক্ষা নিয়ে দিশে ফিরে এখন বাংলাদেশের বহু ডাক্তার, শিক্ষক এবং ইঞ্জিনিয়ার দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে অসাধারণ ভ‚মিকা পালন করছেন। তিনি চায়নার আদলে বাংলাদেশ থেকে দরিদ্রতা দূর করতে সু-পরিকল্পিত দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের ওপর জোর দেন।

Loading