পরমতসহিষ্ণুতা হোক আমাদের অনন্য গুণ

প্রকাশিত: ৭:৫২ অপরাহ্ণ , জুন ১৮, ২০২০

ফয়জুল্লাহ আমান

আমাদের দেশের ইলমি অঙ্গনে বেশকিছু ধারা গড়ে উঠেছে। পঠন-পাঠনের পদ্ধতিগত বিভিন্নতা আছে। চিন্তা ও মানসিক দিক থেকেও বেশ বৈচিত্র্য তৈরি হয়েছে।

কিছু প্রতিষ্ঠানে তাসাওফের গুরুত্ব বেশি, কোথাও রাজনীতির গুরুত্ব তুলনামূলক বেশি আবার কোথাও নিরেট পড়াশোনা। রাজনীতি, খানকা ও পড়াশোনা প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিচিত্র পদ্ধতি রয়েছে। দুটি মাদ্রাসার পদ্ধতিতে মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না।

এমন অসংখ্য ধারা গড়ে ওঠার কারণে কারও কারও কাছে মনে হতে পারে এ সব প্রতিষ্ঠানের মাঝে চরম বৈপরীত্য রয়েছে। আসলে বৈপরীত্য নয়; বরং বলা চলে বৈচিত্র্য। এটা আমাদের কওমি মাদ্রাসার সৌন্দর্যই বৃদ্ধি করে। এই বহুত্বকে মেনে নেয়াই কল্যাণকর।

প্রতিটি ধারার নিজস্ব কিছু মূল্যবোধ আছে। আছে আদর্শ। আদর্শহীন জীবন মৃত্যুর চেয়ে মন্দ। প্রত্যেকেরই উচিত একটি জীবন দর্শন নিয়ে চলা। জীবনের কিছু আদর্শ থাকা উচিত প্রত্যেকেরই। প্রত্যেকটি ধারার সে আদর্শ আছে। সবাই হয়ত আদর্শে টিকে থাকতে পারে না। কিন্তু প্রত্যেকের ভেতর সেই চেষ্টা থাকে।

আদর্শ নিয়ে স্বপ্ন থাকতে পারে। কিন্তু যখন এর চর্চা সীমা অতিক্রম করে যায় তখনই সমস্যা দেখা দেয়। চিন্তা-চেতনার বিষয়গুলো জটিল। এ দেশে বহু ধারা তৈরি হওয়ার কারণ এই জটিলতা। সবার চিন্তার ধরন এক হওয়া জরুরি নয়। প্রত্যেকে যার যার মতো করে ভাববে এটাই স্বাভাবিক।

কঠিন এক সময়ে অবস্থান করছি আমরা। এ সময়ে প্রয়োজন আমাদের পরস্পরকে বোঝার। আমাদের সমস্যা হচ্ছে আমরা একে অপরকে বোঝার চেষ্টা করি না। অন্যকে বুঝতে পারলে তাকে সম্মান দেয়া সম্ভব হয়।

আপনি আপনার আদর্শবাদ নিয়ে থাকুন কোনো সমস্যা নেই। এ নিয়ে বাড়াবাড়ি যেন না হয় সেই খেয়াল রাখা উচিত। ইসলাম আমাদের বিনয় নম্রতা ও ভালোবাসার শিক্ষা দেয়। এমনকি ব্যক্তি যখন ইসলামের একনিষ্ঠ প্রচারক তখনও।
মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ঐ ব্যক্তির চেয়ে উত্তম কথা আর কার হতে পারে, যে মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকে এবং সৎ কাজ করে আর বলে, আমি তো একজন সাধারণ মুসলমান। (সূরা ফুসসিলাত)

প্রতিটি মুসলিমকে এ গুণ অর্জন করতে হবে। যত বড় আমলওয়ালা হোক, তাকওয়ার অধিকারী হোক, নিজেকে অত্যন্ত সাধারণ মানুষের মতো মনে করা শিখতে হবে। সাধারণ হয়ে বাঁচার চেষ্টা করতে হবে।

অসাধারণ হওয়ার নেশা পেয়ে বসলেই যত সমস্যা। অন্যদের চেয়ে আলাদা এক অবস্থান খুঁজতে গিয়ে আপনি যেন নিজেকে পতনের শিকার না করেন সে দিকে খেয়াল রাখবেন।

আপনি যে আদর্শ লালন করেন তা নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে আয়াতে উল্লেখ- বিনয়ী কোমল মনোভাব আপনার কখনও হবে না। আদর্শ নিয়ে একটা গৌরব জন্ম নিবে। নিজের শ্রেষ্ঠত্ব বোধ পেয়ে বসবে। এটাকেই অহঙ্কার বলে।

অহঙ্কার পতনের মূল। চিরাচরিত সত্য এ কথা। যেই মুহূর্তে কোনো আদর্শবাদী ব্যক্তি নিজের ব্যাপারে এমন ভাবতে শুরু করে, সেই মুহূর্ত থেকেই তার পতন আরম্ভ হয়।

হজরত মুজাদ্দিদ আলফে সানি রহ. তার মাকতুবাতে লিখেছেন, একজন কাফেরের চেয়ে অধম মনে করতে হবে নিজেকে, কুকুর ও শূকরের চেয়ে নিকৃষ্ট জ্ঞান করতে হবে, তা না হলে প্রকৃত সালিক হওয়া যাবে না।

অন্যের প্রতি ঘৃণা ছড়িয়ে কখনও সত্য সুন্দরের প্রচারক হওয়া যায় না। বিদ্বেষী মনোভাব নিয়ে শয়তানকে খুশি করা যাবে, আল্লাহকে নয়।

রাসূল সা. স্পষ্ট বলেছেন, বাশশিরু ওয়া লা তুনাফফিরু… তোমরা ঘৃণা ছড়িয়ো না। মানুষকে কেবল সুসংবাদ দাও।

চেতনার দ্বন্দ্বে আমরা অনেক সময় অতিরঞ্জন করে ফেলি। এই অতিরঞ্জনের কারণে আমাদের মনের ভাবনা কঠোর হয়ে যায়। বিপরীত পক্ষের প্রতি চরম বিরূপতা চলে আসে। তাদের দেখলেই মালউন মাগজুব মনে হয়। আর নিজেকে তখন শতভাগ সঠিক চেতনা ও আদর্শে মজবুত বলে বিশ্বাস হতে থাকে।

রাসূল সা. ইরশাদ করেন, লাই ইউশাদদাদ দিনা আহাদুন ইল্লা গালাবাহু… ধর্মের বিষয়ে কেউ কঠোর হলে পরাস্ত হবে। আল্লাহ ক্লান্ত হন না, তোমরা ক্লান্ত হয়ে যাবে।

অমুসলিম বা নাস্তিকদেরকে ধর্মের ভেতর ফিরিয়ে আনতে অবশ্যই কোমল আচরণ করতে হবে। তাদের প্রতি দরদ দিয়ে আপনার সত্যের আহ্বান পৌঁছে দিতে হবে। চরম বিদ্বেষ দিয়ে আপনি তাদের মন জয় করতে পারবেন না।
মুসলমানদের বিভিন্ন ফেরকার সঙ্গেও কঠোর আচরণ করে উপকার তো কিছু নেই। ভালোবাসা দিয়ে মন জয় করার কৌশল আমাদের অর্জন করতে হবে।

একটা সীমা পর্যন্ত বিরোধিতা ঠিক আছে। সীমা অতিক্রম করলে আর ঠিক থাকে না। সে ভুল পথে আছে বুঝলাম। তাকে শোধরানোর পথ তো আপনাকে খোলা রাখতে হবে।

সবচেয়ে নিকৃষ্ট জীব শয়তান। সেই শয়তানের বিরোধিতায়ও পবিত্র কুরআনের ভাষা দেখুন। বিরোধিতা কত বেশি করবেন তার একটা পরিমাপও এখান থেকে আপনি বুঝতে পারবেন।

পুরো জীবনটা যেন অন্যের ছিদ্রান্বেষণে শেষ না হয়ে যায়। ইতিবাচক কাজ না করে কেবল প্রতিবাদ-প্রতিরোধ-প্রতিউত্তর সমাজের স্বাভাবিকত্ব নষ্ট করে।

আপনার চিন্তা-চেতনা শতভাগ ঠিক। সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু এ চিন্তা-চেতনা প্রতিষ্ঠার জন্য নিজের নৈতিকতা বিসর্জন দেয়া ঠিক নয়।

এ কথা ভাবা যে, সর্বোচ্চ মূল্য না দিলে সত্য প্রতিষ্ঠা হবে না, খুব নির্বুদ্ধিতার। চেতনা প্রতিষ্ঠার জন্য ছোট-খাটো দুর্নীতির আশ্রয় নিতে হবে শয়তান আপনাকে এমন প্ররোচনা দিবে। ভালো করে বুঝে রাখুন, সত্যের খাতিরে নীতিহীন হওয়ার অর্থ হচ্ছে নফসানিয়াত অনুপ্রবেশ করেছে আপনার ভেতর অবচেতনে।

হক ও হাক্কানিয়াতের উপর আস্থা রাখুন। সত্য তার নিজস্ব দীপ্তিতে দেদীপ্যমান। আপনি নিজের কাজ করে যান। নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য এতটা ভাবতে হবে না।

নিজের আখেরাতের ফিকির করুন। অন্যদের রক্ষার চিন্তা করতে গিয়ে নিজের ধর্ম নষ্ট করছেন না তো? একটু ভাবুন। সবাইকে সম্মান দিতে শিখুন। সবার মাঝে ছড়িয়ে দিন ভালোবাসা। হৃদয়ের বদ্ধ অর্গল খুলে দিন।

মুক্ত বাতাস আপনাকে পরিচ্ছন্ন করবে। উদার মনের চেয়ে সুন্দর কিছু আল্লাহ সৃষ্টি করেননি। আপনি ইচ্ছা করলেই আপনার মন আরেকটু সুন্দর করতে পারেন। আরেকটু সতেজ সপ্রাণ হতে পারি আমরা সবাই।

মনে রাখবেন হিংসা-বিদ্বেষ ও ঘৃণায় পূর্ণ অন্তরকে সজীব বলা যায় না। অতীতে কে কী করেছে তা না ঘেঁটে আসুন, আমরা একটি নির্মল সুন্দর আগামী রচনা করি। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমীন।

Loading