টিকা নিতে অনীহা

দায়িত্বশীলদের এগিয়ে আসার পরামর্শ

প্রকাশিত: ১২:৩৭ অপরাহ্ণ , জানুয়ারি ২৪, ২০২১

সাধারণ মানুষের বিভ্রান্তি দূর করতে বাংলাদেশে দায়িত্বশীলদের আগে টিকা নেয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা, যদিও শুরুতে ‘তরুণদের’ টিকা দিয়ে পর্যবেক্ষণের পরিকল্পনা করছে সরকার৷
একজন নার্সকে প্রয়োগের মাধ্যমে আগামী ২৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে কোভিড-১৯ টিকাদান কার্যক্রম শুরু হচ্ছে৷ পরদিন ঢাকার পাঁচটি হাসপাতালে কয়েকশ’ জনকে টিকা দেয়ার পরিকল্পনা৷ এরপর ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে সারাদেশে টিকাদান শুরু হবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য সচিব আব্দুল মান্নান৷ তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৭ জানুয়ারি টিকা দেয়ার কার্যক্রম ভার্চুয়ালভাবে উদ্বোধন করবেন৷ কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে প্রথম টিকা দেওয়া হবে একজন নার্সকে৷ এছাড়া আরও ২৪ জনকে টিকা দেওয়া হবে৷ এদের মধ্যে করোনাভাইরাসের সময় কাজ করা সম্মুখযোদ্ধা স্বাস্থ্যকর্মী, বীর মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক, চিকিৎসক এবং সাংবাদিকরা থাকবেন৷ পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে সারাদেশে টিকা কার্যক্রম চালু করা হবে৷

এরইমধ্যে ভারত উপহার হিসেবে ২০ লাখ ডোজ টিকা পাঠিয়েছে৷ আসছে চুক্তির মাধ্যমে কেনা টিকার চালানও৷ কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে বিভিন্ন অঙ্গনে টিকা নিয়ে মানুষের অনীহা ও সন্দেহ প্রকাশ পাচ্ছে৷ বিষয়টিকে সরকার কিভাবে দেখছে? জানতে চাইলে স্বাস্থ্য সচিব আব্দুল মান্নান বলেন, ‘‘এখানে বিভ্রান্তি বা অনীহার কিছু নেই৷ সরকার এই টিকা ফ্রি দিচ্ছে৷ যারা নিতে আগ্রহী হবে শুধু তাদেরই দেওয়া হবে৷ কাউকে জোর করে টিকা দেওয়া হবে না৷ পাশাপাশি দেশে সংক্রমণ তো কমে গেছে৷ এখন মানুষ মনে করছে, টিকা ছাড়াই যদি সুস্থ্য থাকা যায় তাহলে টিকা নেওয়ার দরকার কী? এ কারণেও হয়তো মানুষের মধ্যে টিকার প্রতি আগ্রহ কিছুটা কমেছে৷’’টিকা নিয়ে এই অনাগ্রহ লক্ষ্য করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলামও৷ তিনি বলেন, ‘‘হঠাৎ করেই মানুষের মধ্যে আগ্রহ কেন কমে গেল সেটা বুঝতে পারছি না৷ তবে আমার মনে হয়, দায়িত্বশীলরা বিভ্রান্তি দূর করতে পারেন৷ তারা যদি আগে টিকা নেন তাহলে সাধারণ মানুষের মধ্যে ইতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হবে৷ তখন তারাও টিকা নিতে আগ্রহী হবে৷’’

টিকা দেয়ার জন্য প্রাথমিকভাবে পাঁচটি হাসপাতালকে চিহ্নিত করা হয়েছে৷ এরমধ্যে আছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে টিকা দেওয়া হবে৷ জানা গেছে, ২৮ জানুয়ারি এসব জায়গায় ৪০০ থেকে ৫০০ জনের উপর টিকা প্রয়োগ করা হবে৷ তাদেরকে এক সপ্তাহ পর্যবেক্ষণে রাখার পর সারাদেশে টিকাদান শুরু হবে৷ টিকা বিতরণের পরিকল্পনাও ইতোমধ্যে করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য সচিব৷

কিন্তু অনীহা আর বিভ্রান্তির কারণে সরকারের পরিকল্পনা কতটা বাস্তবায়িত হবে তা নিয়েও আলোচনা চলছে৷ শুধু বাংলাদেশ নয় যেসব দেশে টিকা কার্যক্রম চালু করা হয়েছে সবখানেই শুরুতে টিকা নিয়ে জনগণের সন্দেহের বিষয়টি গণমাধ্যমগুলোতে উঠে এসেছে৷ তা দূর করার জন্য অনেক দেশে শুরুতে দায়িত্বশীল বা সরকার প্রধানদের টিকা নেয়ার নজিরও দেখা গেছে৷ডক্টরস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) সাবেক মহাসচিব ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন বলেন, ‘‘করোনার টিকা যেহেতু নতুন এসেছে, তাই মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি থাকাটাই স্বাভাবিক৷ আমরা যেমনটা দেখি, ইপিআই’র টিকা যখন দেওয়া হয়, তখন প্রধানমন্ত্রী একটি শিশুকে টিকা খাইয়ে এটার উদ্বোধন করেন৷ এভাবে এখানেও যদি দায়িত্বশীলরা আগে টিকা নেন, তাহলে মানুষের আস্থার সংকট দূর হবে৷ অর্থমন্ত্রী প্রথমে টিকা নিতে আগ্রহ দেখালেও স্বাস্থ্যমন্ত্রী কিন্তু এখন পর্যন্ত কিছুই বলেননি৷ অথচ উনারই তো আগে ঘোষণা দেওয়া উচিৎ ছিল যে, তিনিই প্রথম টিকা নেবেন৷’’ তার মতে এমন উদ্যোগ নেয়া হলে মানুষের মধ্যে আস্থাহীনতা দূর হয়৷ তিনি মনে করেন অক্সফোর্ডের টিকার মান নিয়ে হয়তো প্রশ্ন নেই, কিন্তু কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে৷ এই টিকা নেওয়ার পর শতভাগ নিরাপদ থাকা যাবে, এমন কথা কেউ বলতে পারবেন না৷ কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তো আছেই৷

বিশেষজ্ঞরা যেটা বলছেন, দায়িত্বশীলরা আগে টিকা নিলে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি কমবে, সরকারি পরিকল্পনায় কি এমন কিছু আছে? জানতে চাইলে স্বাস্থ্য সচিব আব্দুল মান্নান বলেন, ‘‘প্রথমদিন আমরা চাচ্ছি অপেক্ষাকৃত তরুণদের দিতে৷ এই তরুণের ক্যাটাগরিতে হয়তো অর্থমন্ত্রী পড়বেন না বা ষাটোর্ধ্ব যারা তারা পড়বেন না৷ আমরা যখন ট্রায়ালে যাব তখন যারা যারা আগ্রহ প্রকাশ করবেন তাদের দেয়া যেতে পারে৷’’ সেকারণে অর্থমন্ত্রী যে টিকা নেওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছেন সেখানে হয়তো প্রথমে তাকে টিকা দেওয়া যাবে না৷ দ্বিতীয় ধাপে তিনি টিকা পেতে পারেন বলে উল্লেখ করেছেন সচিব৷ ভারত সরকারের উপহার হিসেবে গত বৃহস্পতিবার সেরাম ইনস্টিটিউটে তৈরি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ২০ লাখ ডোজ টিকা দেশে পৌঁছে৷ আগামী দু’একদিনের মধ্যেই দেশে আরও ৫০ লাখ করোনা টিকা আসবে বলে জানিয়েছেন বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হাসান পাপন৷ শনিবার তিনি জানান, ‘‘ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে চুক্তির তিন কোটি ডোজ টিকা আমদানির চুক্তি হয়েছে৷ আগামী দুই-একদিনের মধ্যেই চুক্তির প্রথম চালান ৫০ লাখ টিকা বাংলাদেশে আসবে৷’’

প্রথম সারির যোদ্ধা হিসেবে সাংবাদিকরাও পাবেন এই টিকা৷ জাতীয় প্রেসক্লাব ইতিমধ্যে যারা টিকা নিতে চান তাদের নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু হয়েছে৷ সাংবাদিকদের মধ্যে টিকা নেওয়ার আগ্রহ কেমন? জানতে চাইলে ক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, ‘‘সিনিয়রদের মধ্যে আগ্রহ ব্যাপক৷ ইতিমধ্যে শতাধিক সাংবাদিকের একটি তালিকাও প্রস্তুত করা হয়েছে৷ এদের সবাই বয়স্ক৷ তরুণদের মধ্যে আগ্রহ তুলনামূলক কম৷’’ তরুনদের মধ্যে আগ্রহ কম কেন, জানতে চাইলে প্রেসক্লাব সভাপতি বলেন, ‘‘এখানে তরুণরা চান আগে সিনিয়রদের দেওয়া হোক৷ তারপরই তারা টিকা নেবেন৷ কারণ সিনিয়রদেরই তো আগে প্রয়োজন৷’’

এদিকে শনিবার দেশে করোনা ভাইরাসে আরও ২২ জনের মৃত্যুতে বাংলাদেশে মৃতের সংখ্যা ৮ হাজার ছাড়িয়েছে৷ অন্যদিকে ২৪ ঘণ্টায় নতুন রোগী শনাক্তের সংখ্যা এপ্রিলের পর প্রথম পাঁচশ’র নিচে নেমে এসেছে৷ সব মিলিয়ে দেশে করোনা ভাইরাসে মোট মৃতের সংখ্যা আট হাজার তিন জনে দাঁড়িয়েছে৷ ## DW

Loading