নবীকে কটূক্তি ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’ নয় : ইউসিএইচআর

রাসূল (সা.) অবমাননা শাস্তিযোগ্য অপরাধ

প্রকাশিত: ১২:২৭ অপরাহ্ণ , নভেম্বর ১৪, ২০২০

ডানা ইশরাত

দ্য ইউরোপিয়ান কোর্ট অব হিউম্যান রাইট্স (ইসিএইচআর) সর্বসম্মতভাবে আদেশ দিয়েছেন যে, ইউরোপের সরকারগুলো তাদের নাগরিকদের নবী মোহাম্মদ (সা.)কে আক্রমণ ও কট‚ক্তি করার জন্য জরিমানা বা কারাবাসের দন্ড দিতে পারে। ইউরোপিয়ান আদালত বলেছেন, যারা নবীর (সা.)-এর ওপর অবমাননাকর আক্রমণ করে, যা বিদ্বেষকে উৎসাহিত করতে এবং ধর্মীয় শান্তিকে ঝুঁকিতে ফেলতে সক্ষম, তাদের ৪৮০ ইউরো মাঝারি জরিমানা হতে বা ৬০ দিনের কারাদন্ড হতে পারে।

ইসিএইচআর জানিয়েছেন, ‘এ জাতীয় কার্যকলাপ মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অনুমোদিত সীমা অতিক্রম করে এবং হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অপমান করা উদ্দেশ্যমূলক বিতর্কের অনুমতিসীমা অতিক্রম করে এবং বিদ্বেষ উস্কে দিতে পারে এবং ধর্মীয় শান্তি ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।’ ইসিএইচআরের বিবৃতিতে এও নিশ্চিত করা হয়েছে যে, আদালতের গৃহীত সিদ্ধান্তটি মানবাধিকার বিষয়ক ইউরোপীয় কনভেনের ১০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করে এবং লঙ্ঘন করে না।

ইউরোপে মোহাম্মদ (সা.) নিয়ে কট‚ক্তির জন্য জরিমানা বা কারাবন্দি করা মত প্রকাশের স্বাধীনতা লঙ্ঘন নয়। কারণ এ ধরনের আক্রমণ একটি উদ্দেশ্যমূলক বিতর্কের অনুমতিসীমা ছাড়িয়ে যায় এবং মুসলমানদের মধ্যে ন্যায়বিচারের ক্রোধ জাগ্রত করতে পারে এবং নিঃসন্দেহে মোহাম্মদ (সা.)-এর ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক প্রসঙ্গ এবং ধর্মীয় ইতিহাস বিবেচ্য। আদালত বলেছেন যে, ন্যায়সঙ্গত আক্রোশ জাগিয়ে তুলতে সক্ষম ধর্ম সম্পর্কে এমন বিবৃতি সহিষ্ণুতার চেতনার হিংসামূলক লঙ্ঘন এবং তাই বিরত করা আবশ্যক। অথবা, আরও স্পষ্টভাবে বললে, যারা ঐতিহাসিক অজ্ঞতা বা ধর্মীয় কুসংস্কারের দিক থেকে মোহাম্মদ (সা.)কে কট‚ক্তি করেন তাদের এখন জরিমানা বা কারাবাস হতে পারে।

উল্লেখ্য, বাক-স্বাধীনতা নিয়ে স্কুলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের উপকণ্ঠের মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক স্যামুয়েল প্যাটি হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর কার্টুন প্রদর্শন করলে গত ১৬ অক্টোবর এক চেচেন কিশোর স্যামুয়েলকে হত্যা করে। এরপর দক্ষিণের নাইস শহরে ৩ চার্চ যাত্রীকে ছুরি মেরে হত্যা করা হয়। এ হামলার মূল সন্দেহভাজন এক তিউনিসিয়ান পরে পুলিশ অফিসারদের দিকে ‘আল্লাহু আকবর’ বলে চিৎকার করেন।
এ ঘটনার পর ফ্রান্সের পুলিশ দেশটির অন্তত ৫০টি মসজিদ এবং মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় সাড়াশি অভিযান চালায়। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ হত্যাকান্ডলোর জন্য তার দেশের উগ্র মুসলিমদের দায়ী করেন। তিনি একই সঙ্গে ঘোষণা করেন যে, ফ্রান্সে এ ধরনের ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ অব্যাহত থাকবে। এ নিয়ে সমগ্র মুসলিম বিশ্বে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।

এ নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে বিশ্বব্যাপি সমালোচনার ঝড় উঠলেও ফ্রান্সের বাক স্বাধীনতার ও ধর্ম নিরপেক্ষতার আইন ল্যাচিটির কারণে অনুসরণ করে ইসলামের সমালোচনাকারীদের পক্ষে শক্ত অবস্থান নেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ। তবে, ইউএইচসিআর’র নির্দেশনার ফলে মুসলিমদের জন্য প্রতিবাদের একটি ইতিবাচক পথ তৈরি হয়েছে।
রাসুল (সা.)-এর অবমাননা সর্বকালে সবদিক থেকে ধিক্কারযোগ্য। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কেউ ব্যঙ্গবিদ্রুপ কিংবা কটাক্ষ করলে মুসলিমদের হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয়। তবে, এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদরা অতি আবেগী না হয়ে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষাকে অনুসরণ করতে আহ্বান করেছেন। তারা বলেছেন যে, ইসলাম শান্তির ধর্ম। নবী করিম (সা.) বারবার শত্রুদের দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হলে আল্লাহ তায়ালা বলেছিলেন, ‘হে নবী আপনি একবার বলুন, আমি এ সমগ্র জাতিকে ধ্বংস করে দেব। কিন্তু দয়াল রাসূল (সা.) ধ্বংস না চেয়ে তাদের হেদায়েত কামনা করেছিলেন।’

পবিত্র কোরআন থেকে জানা যায়, সব নবী-রাসুলের সময়ই এক দল লোক এমন থাকতো যারা আল্লাহর প্রেরিতদের অবমাননা করতো। কিন্তু বাহ্যিকভাবে তাদেরকে কোন শাস্তি দেয়ার আদেশ আল্লাহপাক দিয়েছেন এমন কোনো শিক্ষা পাওয়া যায় না। মহানবী (সা.) এর বিরুদ্ধে কাফেরদের কট‚ক্তির পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ আদেশ দিয়েছেন, ‘লোকে যা বলে, তাতে তুমি ধৈর্য ধারণ কর এবং সৌজন্য সহকারে এগুলোকে পরিহার কর।’ (সুরা মুজ্জাম্মিল: ১০)

বিশ্বনবীকে কটাক্ষ করার ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং রাসুলুল্লাহকে (সা.) শিক্ষা দিয়েছেন, ‘আমি তো জানি, তারা যা বলে তাতে তোমার অন্তর সঙ্কুচিত হয়; সুতরাং তুমি তোমার প্রতিপালকের সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর এবং তুমি সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হও; তোমার মৃত্যু উপস্থিত না হওয়া পর্যন্ত তুমি তোমার প্রতিপালকের ইবাদত কর।’ (সুরা হিজর: ৯৭, ৯৮ ও ৯৯)

আল্লাহর দৃষ্টিতে সবচেয়ে বড় অপরাধ হলো, শিরক করা বা আল্লাহর সমকক্ষ দাঁড় করানো। কিন্তু এক্ষেত্রেও ইসলাম পরমসহিষ্ণু। এ অপরাধ সত্তে¡ও এ অপরাধের জাগতিক কোন শাস্তির বিধান নেই বরং মানুষ যাদেরকে আল্লাহ তায়ালার সমকক্ষ দাঁড় করিয়েছে তাদেরকে পর্যন্ত মন্দ বলতে বা গালমন্দ করতে আল্লাহ নিষেধ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহকে ছেড়ে যাদেরকে তারা ডাকে তাদেরকে তোমরা গালি দিও না। কেননা তারা সীমালঙ্ঘন করে অজ্ঞানতাবশত আল্লাহকেও গালি দেবে। এভাবে আমি প্রত্যেক জাতির দৃষ্টিতে তাদের কার্যকলাপ সুশোভন করেছি; অতঃপর তাদের প্রতিপালকের নিকট তাদের প্রত্যাবর্তন। অনন্তর তিনি তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে অবহিত করবেন।’ (সুরা আনআম: ১০৮)

নবীর অবমাননা করার ধৃষ্টতার পরিপ্রেক্ষিতে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘তাদের যখন বলা হত, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, তখন তারা ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করত এবং এরা বলত, আমরা কি এক উন্মাদ কবির কথায় আমাদের উপাস্যদেরকে পরিত্যাগ করব?’ (সুরা সাফফাত: ৩৬)।
বিশ্বনবীর (সা.) বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ের কটূক্তি সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আরো উল্লেখ আছে, ‘এরা বিস্ময়বোধ করছে যে, এদেরই নিকট এদেরই মধ্য হতে একজন সতর্ককারী এসেছে এবং কাফেররা বলে, ‘এ তো এক জাদুকর, মিথ্যাবাদী।’ (সুরা সাদ: ০৪) এরপরেই আল্লাহ তায়ালা আদেশ দিয়েছেন, ‘এরা যা বলে তাতে তুমি ধৈর্য ধারণ কর। আর প্রবল শক্তির অধিকারী আমাদের বান্দা দাউদকে স্মরণ কর। নিশ্চয় সে আল্লাহর দিকে সব সময় বিনত থাকতো।’ (সুরা সাদ: ১৭)

উপরোক্ত আয়াতগুলোতে কাফেররা মহানবীকে (সা.) উন্মাদ এবং যাদুগ্রস্থ ব্যক্তি (নাউযু বিল্লাহ) বলা সত্তে¡ও আল্লাহ তায়ালা তাদের বিরুদ্ধে জাগতিক কোন শাস্তি বিধানের কথা উল্লেখ করেননি এবং পূর্বের নবীদের (আ.) ক্ষেত্রেও আল্লাহ তায়ালার একই আদেশ ছিলো। মূলত রাসুল অবমাননার কাজটি এমন গর্হিত এক অপরাধ যার শাস্তি আল্লাহ স্বয়ং নিজ হাতে রেখেছেন আর অপর দিকে তিনি তার রাসুলকে ধৈর্য ও উপদেশ প্রদানের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। ## ইনকিলাব

Loading