২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় আহতদের দুঃসহ জীবন

শরীরে স্পিøন্টার নিয়ে ১৮ বছর ধরে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই

প্রকাশিত: ৯:৩৬ পূর্বাহ্ণ , আগস্ট ২০, ২০২২

‘জোড়াতালি দেয়া হাত-পা নিয়ে বেঁচে আছি। সেই মৃত্যু-রক্তস্রোতের ভয়ঙ্কর স্মৃতি আজও আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। পঙ্গুত্বের জীবন যে কী কষ্টের, কী যে ভয়াবহ- সে কথা পঙ্গু না হলে জানা যায় না। আমার সুন্দর জীবনটা হারিয়ে গেছে। দেহে বিঁধে থাকা হাজারও গ্রেনেডের ঘাতক স্পিøন্টারের সঙ্গেই আমাদের নিত্য বসবাস। বিভীষিকাময় সেই ভয়াল দিনটির কথা মনে হলে এখনও মৃত্যু যেন হাতছানি দেয়।

বিভীষিকাময় ঘটনাটির নারকীয় স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়ায় সবসময়। মাথা, বুক, দুই পা, পেট-সর্বাঙ্গে বিঁধে আছে অসংখ্য ঘাতক স্পিøন্টার। শরীরের যেখানেই হাত দেই সেখানেই ঘাতক গ্রেনেডের স্পিøন্টার। মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করেই চলছে আমাদের নিত্যজীবন।

শুক্রবার জনকণ্ঠের কাছে এভাবেই আবেগজড়িত কণ্ঠে ১৮টি বছর ধরে সর্বাঙ্গে বিঁধে থাকা ২১ আগস্টের গ্রেনেডের স্পিøন্টারের তীব্র যন্ত্রণায় পঙ্গুত্ব নিয়ে বেঁচে থাকার কথা জানালেন মহিলা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ও সাবেক জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য নাসিমা ফেরদৌসী।

দীর্ঘদিন ধরেই তাকে চলতে হয়েছে হুইল চেয়ারে। এরপর স্ট্রেচার কিংবা লাঠি অবলম্বন। এখন কিছুটা নিজ থেকে হাঁটতে পারলেও শরীরে বিঁধে থাকা হাজারও স্পিøন্টারের তীব্র যন্ত্রণা তাকে প্রতিনিয়ত ভোগায়। গোটা শরীর জোড়াতালি, ক্ষত-বিক্ষত। কিন্তু মনোবল ও সাহস এতটুকু হারাননি। জীবনন্মৃত হয়ে বেঁচে থাকা নাসিমা ফেরদৌসী তাকে একবার এমপি করে মূল্যায়ন করায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি যেমন কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন, ঠিক তেমনি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মূল নায়ক তারেক রহমানসহ ঘাতকদের বিচারের রায় দ্রুত কার্যকরের দাবি জানিয়েছেন দৃঢ়কণ্ঠেই।

বলেন, খালেদা জিয়া ও তারেকের নির্দেশে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্যই এই ভয়াল গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। হামলার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি আমাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা না করতেন তবে যেটুকু পায়ের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারছি, তাও পারতাম না। জার্মানিতে চিকিৎসার সময় ডাক্তাররা কিছু ওষুধ, থেরাপি ও ব্যায়াম দিয়েছে। অপারেশন করে স্পিøন্টার বের করতে গেলে যেটুকু হাঁটতে পারছি সেটুকুও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাই শুধু কিছু ওষুধ আর থেরাপি চলবে যতদিন বেঁচে থাকব।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনাসহ পুরো আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বে শূন্য করতে পরিচালিত এই ভয়াল গ্রেনেড হামলার ঘটনাটি দেখতে দেখতে ১৮টি বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার বীভৎস ও ভয়াল স্মৃতি এতটুকু ম্লান হয়নি সর্বাঙ্গে বিঁধে থাকা স্পিøন্টারের তীব্র যন্ত্রণায় পঙ্গুত্ব নিয়ে জীবন্মৃত অবস্থায় বেঁচে থাকা আওয়ামী লীগের শত শত নেতাকর্মীর।

সেই মৃত্যু-ধ্বংস-রক্তস্রোতের ভয়ঙ্কর স্মৃতি আজও তাদের তাড়া করে। তারা জীবিত থেকেও যেন মৃত। প্রত্যেকের শরীরেই বীভৎস ক্ষতের চিহ্ন। বরং জীবনযন্ত্রণা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে তাদের আরও শক্ত করে। স্পিøন্টারের বিষক্রিয়ায় শরীরেও দেখা দিয়েছে নানা উপসর্গ। প্রতিনিয়ত মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করে এখনও বেঁচে আছেন আহত নেতাকর্মীরা।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ দলীয় কার্যালয়ের সামনে আওয়ামী লীগের সমাবেশে ভয়াবহ এই গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। এতে নারী নেত্রী আইভি রহমানসহ ২২ নেতাকর্মী নিহত এবং পাঁচ শতাধিকেরও বেশি নেতাকর্মী আহত হন। এই নারকীয় বীভৎস হামলার ঘটনার বিচার হলেও রায় এখনও কার্যকর হয়নি।

২১ আগস্টের সেই ভয়াল গ্রেনেড হামলায় আহত অধিকাংশ নেতাকর্মীর অনুভূতি প্রায় একই রকম। সময়ের সঙ্গে কষ্টের তীব্রতা এতটুকুও কমেনি তাদের। এই ভয়াবহ রাজনৈতিক জিঘাংসার শিকার অনেকেই আজ পঙ্গু। কেউ চলৎশক্তিহীন। কেউ হারিয়েছেন দৃষ্টিশক্তি। অনেকে প্যারালাইস হয়ে হুইল চেয়ারে চলাফেরা করছেন, অনেকের জীবনেই এখন ক্র্যাচই চলাফেরার নিত্যসঙ্গী। অনেকেরই শরীরে রয়ে গেছে অসংখ্য স্পিøন্টারের অস্তিত্ব।

অনেকেরই শরীরে দগদগে ক্ষতের চিহ্ন জানান দিচ্ছে সেই ভয়াল দিনের মরণছোবলের বীভৎসতা। পঙ্গুত্বের অভিশাপ নিয়ে জীবন্মৃত অবস্থায় বেঁচে থাকা আওয়ামী লীগের বেশকিছু নেতাকর্মীর সঙ্গে আলাপকালে তারা অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে গত ১৮টি বছর ধরে তাদের দুঃসহ জীবন-যাপনের করুণ অবস্থার বর্ণনা দেন।

নাসিমা ফেরদৌসী আরও বলেন, নেত্রী (শেখ হাসিনা) তার মতো অসংখ্য আহত মানুষের জন্য অনেক করেছেন, অনেক দিয়েছেন। এখনও করে যাচ্ছেন। আন্দোলন-সংগ্রামে তাদের অবদানের মূল্যায়ন করতে গিয়ে আমার মতো কাউকে কাউকে জাতীয় সংসদের এমপি পর্যন্ত করেছেন। সেজন্য বঙ্গবন্ধু কন্যার প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবেন তারা। তবে একটাই দুঃখ এখনও এ ভয়াল হত্যাকা-ের বিচারের রায় এখনও কার্যকর হয়নি। মাস্টারমাইন্ড তারেক রহমানের ফাঁসি হওয়া উচিত ছিল। আমরা চাই ঘাতক এবং হামলার মূল পরিকল্পনাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হোক।

নাসিমা ফেরদৌসীর মতো অসংখ্য আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সর্বাঙ্গে বিঁধে থাকা গ্রেনেডের স্পিøন্টারের দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়েই দলীয় কর্মকা-ে সরব রয়েছেন। রাজপথের সাহসী মহিলা নেত্রী ও সাবেক সংসদ সদস্য সাহিদা তারেক দিপ্তীও ২১ আগস্ট ভয়াল গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত হন। দেশ-বিদেশে চিকিৎসার পর এখনও তার হাত-পাসহ দেশের সর্বাঙ্গে দু’শরও বেশি স্পিøন্টার বিঁধে রয়েছে।

এই স্পিøন্টারের কারণেই শরীরজুড়ে অসহ্য যন্ত্রণার পাশাপাশি সারাদেহে জ্বালাপোড়া করে, ডানপায়ের আঙ্গুলগুলো বাঁকা হয়ে গেছে। চিকিৎসকরা বলছেন, অন্য আহতদের মতো দিপ্তীর শরীরে থাকা স্পিøন্টারগুলো রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে।

নাসিমা-দিপ্তী-রুমা-পারভীনদের মতো আওয়ামী লীগের অনেক জ্যেষ্ঠ ও প্রবীণ নেতারাও দেশে ঘাতক গ্রেনেডের স্পিøন্টার নিয়েও রাজনীতির মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আফম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য ইকবাল হোসেন এমপি, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক পংকজ দেবনাথ এমপিসহ বেশ কজন নেতা-মন্ত্রী ও এমপির দেহেও বিঁধে অসংখ্য ঘাতক স্পিøন্টার।

আমৃত্যু তাদের মতো সকল নেতা-কর্মীকেই এই জীবনযন্ত্রণা ভোগ করেই পথ চলতে হবে। শুধু তারাই নন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তৎকালীন আওয়ামী লীগের অধিকাংশ শীর্ষ নেতাকেই গ্রেনেড হামলায় আহত হয়ে যন্ত্রণা দগ্ধ রাজনৈতিক জীবন চালাতে হচ্ছে। গ্রেনেডের যন্ত্রণা নিয়েই মৃত্যুবরণ করেছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, প্রবীণ নেতা আবদুর রাজ্জাক, বিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও ঢাকার প্রথম মেয়র মোহাম্মদ হানিফকে।

জীবনযন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকলেও ওই ভয়াল গ্রেনেড হামলায় আহত নেতাকর্মীরা এখন ন্যায়বিচার পাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। যে দলটিকে নিশ্চিহ্ন করতে ঘাতকরা গ্রেনেড নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, সেই দলটি টানা তৃতীয়বারের মতো ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। গ্রেনেডের আঘাতে যে ক্ষত সৃষ্টি করেছে, ছন্দপতন ঘটিয়েছে স্বাভাবিক জীবনের- তাদের সবারই এখন প্রত্যাশা- বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার হয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও চলছে। এখন দ্রুত ২১ আগস্টের ঘাতকদের বিরুদ্ধে আদালতের রায় কার্যকর করা হোক।

ভয়াল গ্রেনেড হামলায় মৃত্যুজাল ছিন্ন করে প্রাণে বেঁচে গেলেও স্পিøন্টার তাদের পিছু ছাড়েনি। দীর্ঘ ১৮টি বছর পেরিয়ে গেলেও এসব মানুষের দুর্ভাগ্য পিছু ছাড়েনি। আমৃত্যু এমন জীবনযন্ত্রণা ভোগ করতে হবে, এটা ভেবেই অসহায়-বেদনার্ত আহাজারি প্রতিটি আহতদের মাঝে। কারোর চোখ নেই, কেউ কানে শোনেন না। কেউ হাত-পা বাঁকা করে সব সময় চলাফেরা করছেন, শরীর সোজা করে এখনও শুতে পারেন না অনেকেই। এমনকি তাদের দেহে একটু স্পর্শ করলেই ব্যথায় চিৎকার দিয়ে ওঠেন।

এমনি দেহে সাড়ে তিন শ’রও বেশি স্পিøন্টার নিয়ে রাজনীতি ও পেশা চালিয়ে যাচ্ছেন এ্যাডভোকেট উম্মে রাজিয়া কাজল। কলকাতার পিয়ারলেস হাসপাতালে অপারেশন করে দেহ থেকে মাত্র ৩৫-৩৬টি স্পিøন্টার বের করা সম্ভব হয়েছে। ওষুধের ওপরই তার জীবন চলা। আহত অনেক নেতাকর্মীই আলাপকালে তাদের দুঃসহ জীবনযাত্রার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুলেননি। তারা বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক্ষেত্রে মায়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।

২০০৪ সালের ২১ আগস্টে এই ভয়াল গ্রেনেড হামলার পর তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী থাকা অবস্থাতেও শেখ হাসিনা আহত সবার দেখভাল করেছেন, গুরুতর আহতদের দফায় দফায় বিদেশ পাঠিয়ে উন্নত চিকিৎসা করিয়েছেন। ক্ষমতায় আসার পরও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নিজ উদ্যোগে এবং বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের মাধ্যমে আহতদের চিকিৎসা, ওষুধপত্রসহ আর্থিক নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে যাচ্ছেন। তবে সবার কণ্ঠেই ছিল ২১ আগস্টের ঘাতকদের প্রতি তীব্র ঘৃণা-ধিক্কার। – জনকন্ঠ

Loading