করোনার বিদায় সংবর্ধনা?

প্রকাশিত: ১১:৩২ পূর্বাহ্ণ , আগস্ট ২২, ২০২০

বাংলাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া সবই খুলে গেছে৷ সেপ্টেম্বরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও খুলে দেয়ার প্রস্তুতি চলছে৷ অথচ করোনার সংক্রমণ কিন্তু কমছে না৷ বরং বাড়ছে৷ কিন্তু টেস্ট কমিয়ে দেয়া হয়েছে৷মৃত্যুহারও অন্তত এক মাস ধরে একই রকম আছে৷ পাশাপাশি প্রত্যন্ত অঞ্চলে করোনা ছড়িয়ে পড়ছে৷ স্বাস্থ্যবিধি মানা নিয়ে নানা কথা হলেও তা লোকজন তেমন মানছেন না৷ আর গণপরিবহণে স্বাস্থ্যবিধি না মানায় পরিবহণ মালিকরা এখন বাস বোঝাই করে যাত্রী নেয়ার অনুমতি চাচ্ছেন৷ যদিও বাস্তবে তা-ই নিচ্ছেন৷ ভাড়া নিচ্ছেন অর্ধেক সিট খালি রাখার সেই পুরনো শর্তে দ্বিগুণ৷ টেস্ট কমানোর পর করোনা হাসপাতালও কমিয়ে দিতে চাইছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়৷ স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘বাংলাদেশে ভ্যাকসিন লাগবে না৷ করোনা এমনিতেই চলে যাবে৷ সংক্রমণ অনেক কমে গেছে৷’’

করোনাকে বাংলাদেশে ‘বিদায় সংবর্ধনা’ দেয়ার সব আয়োজনই যেন সম্পন্ন৷ তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়, স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় বিদায় সংবর্ধনা দিতে পারে, কিন্তু করোনা কি বিদায় নেবে?

এরইমধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করোনা ব্রিফিং বন্ধ হয়ে গেছে৷ জাতীয় টেকনিক্যাল কমিটি অবশ্য এর বিরোধিতা করেছে৷ এখন শুধু সংবাদবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয় স্বাস্থ্য অধিপ্তরের ওয়েব সাইটে৷ তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, বৃহস্পতিবারও ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে করোনায় মারা গেছেন ৪১ জন৷ আর এ পর্যন্ত করোনায় মোট মারা গেছেন তিন হাজার ৮২২ জন৷ ২৪ ঘণ্টায় ১৪ হাজার ৫৯টি নমুনা পরীক্ষা করে দুই হাজার ৮৬৮ জন শনাক্ত হয়েছেন৷ এ পর্যন্ত মোট শনাক্ত হয়েছেন দুই লাখ ৮৭ হাজার ৯৫৯ জন৷বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রথম রোগীর মৃত্যু হয় গত ১৮ মার্চ, প্রথম রোগী শনাক্ত হয়েছিল গত ৮ মার্চ৷ এখন পর্যন্ত মোট নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ১৪ লাখ সাত হাজার ৫৫৬টি৷

বৃহস্পতিবার ২৪ ঘণ্টায় শনাক্তের হার ২০ দশমিক ৪ শতাংশ এবং এ পর্যন্ত শনাক্তের হার ২০ দশমিক ৪৬ শতাংশ৷ শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থ হয়ে ওঠার হার ৫৮ দশমিক ৬৯ শতাংশ এবং মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৩৩ শতাংশ৷বর্তমানে কোয়ারান্টিনে আছেন ৪৭ হাজার ৭৬৪ জন৷ আইসোলেশনে আছেন ৬৫ হাজার ৩৬ জন৷

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যই বলছে বাংলাদেশ এখনো করোনা কমার কোনো লক্ষণ নেই৷ বরং টেস্ট কম করার পরও সংক্রমণ বাড়ছে৷ এখনো নির্ভরযোগ্য জরিপ হয়নি৷৷ অ্যান্টিবডি টেস্ট শুরু হয়নি৷ বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)-র মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, ‘‘স্বাস্থ্যমন্ত্রী কিসের ভিত্তিতে বললেন যে বাংলাদেশ থেকে করেনা চলে গেছে আমরা তা জানি না৷ আমাদের কাছে বিজ্ঞানভিত্তিক কোনো তথ্য নেই যে বলবো করোনা কমছে৷ মন্ত্রীর মতো কথা বললে চলবে না৷ আমাদের কথা বলতে হবে তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে৷ আর সেজন্য যে গবেষণা প্রয়োজন তা এখানে হয়নি৷’’

বাংলাদেশে ছোট একটি গবেষণা হয়েছে৷ আইইডিসিআর এবং আইসিডিডিআর,বি করেছে৷ ঢাকায় ১২ হাজার মানুষের ওপর তারা গবেষণা করেছে৷ তাতে দেখা গেছে, ঢাকার শতকরা ৯ ভাগ মানুষ করোনায় আক্রান্ত৷ ঢাকার ১২ হাজার মানুষের মধ্যে জরিপ করে সিদ্ধান্তে আসা যায় না বলে মনে করেন এই চিকিৎসক৷

বাংলাদেশে ২৫ মার্চ থেকে করোনা প্রতিরোধে সাধারণ ছুটি দেয়া হয়৷ এরপর তা বাড়িয়ে বাড়িয়ে ৩১ মে পর্যন্ত করা হয়৷ তারপর সব কিছু ধীরে ধীরে খুলে দেয়া হয়৷ যদিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সাধারণ ছুটি বহাল আছে৷

করোনা নিয়ে সবচেয়ে জটিল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল পোশাক কারখানায়৷ বারবার নানা ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে৷ সাধারণ ছুটি প্রত্যাহারের পর করোনার হটস্পট চিহ্নিত করে লকডাউনের কাজও করা হয়৷ ঢাকার পূর্ব রাজাবাজার এবং ওয়ারীসহ ঢাকার বাইরে কয়েকটি এলাকায় ঢাকঢোল পিটিয়ে ২১ দিনের লকডাউন করা হলেও তার ফল অজানা৷ আর এখন সেটাও করা হচ্ছে না৷ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, ‘‘সব কিছু স্বাভাবিক হয়নি, স্বাভাবিক করা হচ্ছে নির্দেশ দিয়ে৷ আমাদের কাছে করোনা কমার কোনো তথ্য নেই৷ আমরা করোনায় শুধু উল্টো পথে নয়, আমাদের সামনে বিপর্যয় অপেক্ষা করছে৷ শীত আসছে৷ পরিস্থিতি কী হয় বলা যায় না৷’’

করোনা ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসক এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কোনো মতামত নেয়া হচ্ছে না৷ তারা কোনো মতামত দিলে তা উপেক্ষা করা হচ্ছে-এমন অভিযোগও রয়েছে৷ জাতীয় টেকনিক্যাল কমিটিকে নামে মাত্র রাখা হয়েছে৷ সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন আমলারা৷ ১৮ আগস্ট স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নতুন একটি কমিটি করেছে যার নাম ‘করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ গ্রুপ’৷ এই কমিটিতে কোনো চিকিৎসক বা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ নেই৷ সবাই আমলা৷

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী মনে করেন, ‘‘করোনা নিয়ে এ পর্যন্ত যতগুলো সিদ্ধান্ত হয়েছে তার কোনোটিই সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়নি৷ আমাদের যখন যেটা করা প্রয়োজন সেটা করিনি৷ করেছি উল্টোটা৷’’

তিনি বলেন, ‘‘গবেষণায় দেখা গেছে শুধু ঢাকায় করোনা সংক্রমিত রোগী ১৮ লাখ৷ তাহলে সারাদেশে কত? আমি ধারণা করি এখন টেস্ট কমিয়ে রোগী কম দেখানোর একটা প্রবণতা আছে৷ কিন্তু তাতে কি করোনা দূর হবে?’’
তার মতে, কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা না নেয়ায় বাংলাদেশে করোনা প্রলম্বিত হবে৷ পৃখিবীর বিভিন্ন দেশে করোনা পিক-এ গিয়ে তারপর নেমে এসেছে৷ কিন্তু বাংলাদেশে দীর্ঘ সময় ধরে সংক্রমণ একই আছে, কমছে না৷ মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে৷ এটা বিপর্যয়ের দিকে যেতে পারে বলে তিনি মনে করেন৷ DW

Loading