সর্বনাশের নাম আইস

প্রকাশিত: ৯:২০ অপরাহ্ণ , মে ১১, ২০২৩

বাংলাদেশে সর্বনাশা মাদক আইস এ আসক্তের সংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে এর চোরাচালান৷ এখন মিয়ানমার থেকে কক্সবাজারে এনে ঢাকাসহ সারাদেশে এই আইস নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বিক্রি হচ্ছে৷

বেশি দামের কারণে উচ্চ ও মধ্যবিত্ত তরুণেরাই এর প্রধান ক্রেতা৷ আর কক্সবাজারের পুরানো ইয়াবা চোরচালানিরা এখন আইসের চোরাচালনিতে যুক্ত হয়েছে৷

বাংলাদেশের কক্সবাজার এলাকায় ১০ দিনের মাথায় ভয়াবহ মাদক আইসের (ক্রিস্টাল মেথ) বড় দুইটি চালান ধরা পড়েছে৷ আর এতে ধারণা করা হচ্ছে বাংলাদেশে আইস প্রবেশের নতুন রুট এখন মিয়ানমার৷
স্থানীয় সূত্র দাবি করছে যারা আগে কক্সবাজার এলাকায় ইয়াবা চোরাচালানে যুক্ত ছিলেন তারাই এখন আইস চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন৷ এর পরিবহণের সঙ্গে রোহিঙ্গারা যুক্ত থাকলেও মুল চোরাকারবারিরা এদেশীয়৷ গত ৬ মে আইসের সবচেয়ে বড় চালান আটক হয় কক্সবাজারের উখিয়াল পালংখালি এলাকা থেকে৷ র‌্যাবের একটি দল চারজন মাদক কারবারিসহ ২৪ কেজির ওই চালানটি আটক করে৷ এর আগে ২৬ এপ্রিল ওই পালংখালি সীমান্ত এলাকা থেকেই ২১ কেজি ৯০ গ্রামের আরেকটি চালান আটক করে বিজিবি৷ তারা তিনজন মাদক চোরাকারবারিকেও আটক করে৷ আর ১০ এপ্রিল বিজিবি টেকনাফের হ্নীলা এলাকার নাফ নদী থেকে প্রায় দুই কেজি আইস উদ্ধার করে৷ অভিযানের সময় নৌকা থেকে দুই মাদক কারবারি পালিয়ে মিয়ানমারে চলে যায়৷

৬ মে আইসের সবচেয়ে বড় চালান ধরা পড়ার পর র‌্যাব জানায়, ওই চালান বাংলাদেশের জন্যই আনা হয়৷ চালানটি মিয়ানমার থেকে চা-পাতার বস্তায় করে বাংলাদেশে আনা হয়৷ এটা বিভিন্ন পর্যায়ে ভাগ হয়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি হতো৷ ওই ঘটনায় আটক চারজনের একজন পুলিশের চাকরিচ্যুত সদস্য৷ আর বিজিবি ২১ কেজির যে চালানটি আটক করে তা প্রথম রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মজুত করা হতো বলে জানিয়েছেন বিজিবি৷ সেখান থেকে এটা দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হতো৷ জানা গেছে আইসের সবচেয়ে বড় খুচরা বাজার ঢাকা শহর, এর পরেই চট্টগ্রামের অবস্থান৷ এর দাম অনেক বেশি হওয়ায় সাধারণত উচ্চ ও মধ্যবিত্ত ঘরের তরুণরাই এর প্রধান ক্রেতা৷ ঢাকায় এখন এক গ্রাম আইস ১০-১২ হাজার টাকায় বিক্রি হয়৷ আর ঢাকাসহ সারাদেশে আইসের হোম ডেলিভারি ও অনলাইন মার্কেটিং নেটওয়ার্ক রয়েছে৷
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর জানায়, গত চারমাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ তারা আইসের মোট নয়টি বড় চালান আটক করেছে৷ মিয়ানমার সীমান্তবর্তী জেলা কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া থেকে এইসব বড় চালান আটক করা হয়৷ এতে স্পষ্ট যে আইসের চোরাচালান বাংলাদেশে বাড়ছে এবং মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আইস আসছে৷ ২০২০ সালে দেশে আইস উদ্ধার হয়েছিল ৬৫ গ্রাম৷ তবে ২০২১ সালে হয় ৩৬ কেজি ৭৯৪ গ্রাম৷ ২০২২ সালে ১১৩ কেজি ৩৩১ গ্রাম, আর চলতি বছরের প্রথম চার মাসে ৬৬ কেজি৷ কিন্তু উদ্ধারের চেয়ে অনেক বেশি আইস ঢুকছে৷ কারণ জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ বিষয়ক সংস্থা বলছে যত মাদক একটি দেশে ঢোকে তার সর্বোচ্চ ১০ ভাগ উদ্ধার হয়৷

স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় যে, কক্সবাজারের যে শতাধিক মাদক কারাবারিরা ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে আত্মসমর্পণ করেছিলো তারা সবাই এখন মুক্ত৷ তারাই এখন এই আইস চোরাকারবারে যুক্ত হয়ে পড়েছে৷ আগে যারা ইয়াবা চোরাচালান করতেন তারাই এখন আইস চোরাচালানে জড়িত হয়ে পড়েছেন৷ শুরুতে তারা ইয়াবার সঙ্গে অল্প আইস আনতেন এখন চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় তারা পুরোপুরি আইসের দিকে ঝুঁকছেন৷

কক্সবাজারের মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারি পরিচালক মোহাম্মদ সিরাজুল মোস্তফা বলেন, “আমরা ২০২১ সালে কক্সবাজার এলাকায় প্রথম চোরাচালানের আইস আটক করি৷ এরপর থেকেই এর কক্সবাজার এলাকায় আইসের চোরাচালান বাড়ছে৷ মিয়ানমার থেকে ইয়াবার মতো আইসও আসে৷ ওখানে এখন আইস মাদককে বাংলাদেশে পাঠাতে উৎসাহিত করা হচ্ছে৷ বাংলাদেশে এর দাম অনেক হলেও মিয়ানমারে বাংলাদেশের বাজার ধরার জন্য এর দাম কমিয়ে রাখা হচ্ছে৷”

তিনি জানান, “আগে যারা ইয়াবা চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তারাই আইস চোরাচালানে যুক্ত হয়েছেন৷ এটা বহন করা সহজ এবং লাভও বেশি৷”

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এখন মিয়ানমারে সামরিক সরকার ফলে আমাদের সঙ্গে মাদক চোরচালান দমনে আলোচনা কম হয়৷ তাদের ভিতর থেকেই বাংলাদেশে মাদক চোরাচালান উৎসাহিত করা হয়৷ আমরা জানতে চাইলে অস্বীকার করে৷”

তার কথা, “এখন ইয়াবার মতোই মিয়ানমারেই আইস তৈরি হয়৷ এটা ইয়াবার মতোই অ্যামফিটামিন গোত্রের৷ এই গোত্রের মাদক তারা অনেক দিন ধরেই বানাচ্ছে৷ থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়াও মিয়ানমার থেকে আইস যায় বলে আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে৷ এখন ইয়াবার জায়গা আইস দখল করে নিচ্ছে৷ যারা ইয়াবা আসক্ত তারাও আইসে ঝুঁকছেন৷ আইস দিয়ে নতুন মাদকাসক্তও হচ্ছেন৷ কারণ এর তীব্রতা ইয়াবার চেয়ে ১০০ গুণ বেশি৷ আইসের চোরাচালান এবং আসক্তের সংখ্যা দুইটিই বাড়ছে৷” অধিদপ্তরের ঢাকা অফিসের একজন কর্মকর্তা জানান, ঢাকায় চন্দন নামে একজন আইসের বাজার গড়ে তোলেন৷ গত বছরের নভেম্বরে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ পরে তার গ্রুপের আরো ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ তাদের কাছ থেকে যে তথ্য পাওয়া গেছে তাতে ঢাকায় ভয়াবহ আকারে আইস ছড়িয়ে পড়ছে৷
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, “২০১৯ সালে আমরা ন্যাশনাল সার্ভে করেছিলাম৷ তাতে দেখা গেছে মাদক গ্রহণকারীর মধ্যে শীর্ষে আছে গাঁজায় আসক্তরা৷ এরপর পরেই আছে অ্যামফিটামিন মানে ইয়াবা এবং আইস৷ আইস আসলে ইয়াবার উন্নত সংস্করণ৷ এখানে একটি বিষয় আছে, আইসের দাম অনেক বেশি তাই এটা সবার পক্ষে নেয়া সম্ভব নয়৷ তবে আমরা দেখছি আইসের ব্যবহার ও ভয়াবহতা বাড়ছে৷ ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে উচ্চবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত তরুণরা এই মাদকে ব্যাপকভাবে আসক্ত হচ্ছে৷”

তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, “আইসের প্রতিক্রিয়া ইয়াবার চেয়েও ভয়াবহ৷ এটায় আসক্ত হলে অবসাদ ও বিষন্ন্তা তৈরি হয়, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হার্টফেইল করতে পারে৷ যৌন অক্ষমতা তৈরি হয়৷” – ডয়েস ভেলে

Loading