আজ বাঁশখালী ও চান্দিনা মুক্ত দিবস

প্রকাশিত: ১১:২৭ পূর্বাহ্ণ , ডিসেম্বর ১২, ২০২২

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের বাঁশখালী পাক হানাদার মুক্ত হয় ১২ ডিসেম্বর। চূড়ান্ত বিজয়ের মাত্র ৪ দিন আগে বাঁশখালীতে পাক–হানাদারদের রুখে দিয়ে ১ম বারের মত স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয় পতাকা উত্তোলন করেন মুক্তিকামী জনতা। এর মধ্যে দিয়ে বিজয়ের স্বাদ পায় বাঁশখালীবাসী। যুদ্ধকালীন বিভিন্ন সময়ে বীর মুক্তিযোদ্ধারা বাঁশখালীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসমূহে অভিযান চালিয়ে শত্রুমুক্ত করে।

মুক্তিযোদ্ধারা জানান, বাঁশখালীতে চারটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করা হয়। এই চারটি গ্রুপের হয়ে নেতৃত্ব দেন মুক্তিযোদ্ধা মৌলভি ছৈয়দ ও সাবেক সাংসদ সুলতান উল কবির চৌধুরী, শফিকুর রহমান, ডা. আবু ইউসুফ চৌধুরী ও ছমিউদ্দিন। এর মধ্যে শফিকুর রহমানের গ্রুপে ৩৫ জন, মৌলভি ছৈয়দ ও সুলতান উল কবির চৌধুরী গ্রুপে ৬৫ জন, ডা. আবু ইউসুফ চৌধুরী গ্রুপে ১২ জন এবং ছমিউদ্দিনের গ্রুপে ৩০জন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।

সেইদিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, চট্টগ্রাম জেলার সহ কমান্ডার (অর্থ) মুহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘যতই দেশের বিজয় ঘনিয়ে আসছিল ততই উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় রাজকাররা তাবু গুটিয়ে একজায়গায় একত্রিত হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত তারা গুণাগরির ওয়াপদা বিল্ডিংয়ে ঘাঁটি গাড়ে। এই ঘাঁটিতে ২৫০ থেকে ৩০০জন রাজাকার ছিল।

তিনি বলেন, “মুক্তিযোদ্ধাদের চারটি গ্রুপ একত্রিত হয়ে ১৯৭১ এর ১০ ডিসেম্বর রাজাকারদের ঘাঁটি ওয়াপদা বিল্ডিং এ অ্যাকশন শুরু করে। গোলাগুলির মধ্যে বেশ কিছু রাজাকার অস্ত্রশস্ত্র ফেলে পালিয়ে যায়। তাদের সঙ্গে যুদ্ধ চলে টানা দুইদিন। অবশেষে ১২ডিসেম্বর সকালে ৭৫ জন রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। এরপর ওয়াপদা বিল্ডিংয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। পরে মুক্তিযোদ্ধারাসহ মুক্তিকামী জনতা একত্রিত হয়ে মিছিল সহকারে বর্তমানে বাঁশখালী থানা এলাকায় পতাকা উত্তোলন করেন। এর মধ্যে দিয়েই মূলত হানাদারমুক্ত হয় এই উপজেলা।”

১৯৭১ সালের ১৯ মে পাক হানাদার বাহিনী বাঁশখালীতে প্রথম অভিযান চালায়। এই দিন সকাল ১০টার দিকে বাঁশখালীর পূর্বাঞ্চল এবং হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় পাক হানাদার বাহিনী বিভিন্ন ইউনিয়নের প্রভাবশালী স্বাধীনতা বিরোধীরাসহ শতাধিক সৈনিক ও ১০ ট্রাক সাজোয়া বহর নিয়ে বাণীগ্রাম থেকে শুরু করে নাপোড়া পর্যন্ত চালায় ইতিহাসের জগন্যতম বর্বর, নির্বিচার গণহত্যা ও বাড়ীঘরে অগ্নিসংযোগ। তাদের হিংস্রতায় বাঁশখালীর বিভিন্ন গ্রামে ৯০ জন সংখ্যালঘু নারী–পুরুষকে হত্যা করা হয়।

নিজ এলাকা ও দেশের বিভিন্ন রণাঙ্গণে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছেন বাঁশখালীর আরও ১০ জন বীর সেনানী। এইসব শহীদদের মধ্যে কালীপুর ইউনিয়নের ১৮ জনকে হাত–পা বেঁধে আধমরা অবস্থায় বাঁশখালী ডিগ্রী কলেজের দক্ষিণ পার্শ্বে গর্তে ফেলে নির্মমভাবে হত্যা করে মাটি চাপা দেয়া হয়। এ বধ্যভূমিতে মুক্তিযুদ্ধকালীন গ্রুপ কমান্ডার খোন্দকার মোহাম্মদ ছমিউদ্দীনের উদ্যোগে ১৫ মার্চ ১৯৮৯ তারিখে একটি গণসমাধি ভিত্তিস্থাপন করা হয়। ২৬ মার্চ ১৯৮৯ তারিখে এই গণসমাধির ফলক উন্মোচন করেন বাঁশখালীর তৎকালীন উপজেলা চেয়ারম্যান সুজিত কান্তি সিকদার ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জালাল আহমদ।

বাণীগ্রামে নিহত ২২ জনকে রাতের অন্ধকারে বাণীগ্রাম মধ্য পাড়া পুকুর পাড়ে স্থানীয়দের সহযোগিতায় সমাহিত করা হয়। পরবর্তীতে এই শহীদের স্মরণে ২০১১ সালের ১৬ ডিসেম্বর নাম ফলক সম্বলিত স্মৃতিস্তম্ভ ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন এমএফ কমান্ডার ও সাধনপুর ইউপি চেয়ারম্যান খোন্দকার মোহাম্মদ ছমিউদ্দীন। ২০১২ সালের ২৬ মার্চ এই স্মৃতিস্তম্ভ ফলক উন্মোচন করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক–ই–আজম বীর প্রতীক।

বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও সাধনপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কে এম সালাহ্উদ্দীন কামাল বলেন, “বধ্যভূমি ২টি সংরক্ষণে আমি জেলা প্রশাসক বরাবরে আবেদন করেছিলাম তারই প্রেক্ষিতে সংরক্ষণের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হলে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নের বাস্তবায়ন হবে, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তরুণ প্রজন্ম জানতে পারবে ও শহীদদের আত্মা শান্তি পাবে।”

বাঁশখালীর সাংসদ আলহাজ্ব মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী বলেন, “বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের সকল ধরনের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। তারই প্রেক্ষিতে বাঁশখালীর সকল মুক্তিযোদ্ধারা সরকারের সকল সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি বধ্যভূমিগুলো মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে দৃষ্টিনন্দন বধ্যভূমি নির্মাণের জন্য সকল ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।”

অপরদিকে, ১৯৭১ সালের রক্তঝরা এ দিনে কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত করে এ উপজেলাকে। ময়নামতি সেনা নিবাসে মিত্র বাহিনীর সেলিং এর কারণে ১১ ডিসেম্বর ভোরে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ময়নামতি সেনানিবাস থেকে বরুড়া হয়ে চান্দিনার উপর দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় বিভিন্ন স্থানে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করতে থাকে। আর ওই ঘটনাটি চান্দিনার মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে খবর এলে মিত্রবাহিনীর সহযোগিতায় চান্দিনার মুক্তিযোদ্ধারা মানসিক ভাবে দ্বিগুন শক্তিশালী হয়ে পাকিবাহিনীকে প্রতিহত করতে এগিয়ে যায়। দুপুরে উপজেলা সদরের হারং উদালিয়ার পাড় এলাকায় পাকিস্তানী বাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের মুখোমুখী সংঘর্ষ হয়। ১১ ডিসেম্বর দুপুর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত গোলাগুলির এক পর্যায়ে পাকিস্তানী বাহিনীর গোলাবারুদ শেষ হয়ে গেলে ১২ ডিসেম্বর ভোরে আত্মসমর্পণ করে প্রায় ১৭ শতাধিক পাকিস্তাানী হানাদার বাহিনী। উল্লাসিত মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে ধরে নিয়ে আসে বর্তমান চান্দিনা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে।

অপরদিকে, ১১ ডিসেম্বর হারং উদালিয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের ধাওয়ায় ৬ জন পাকবাহিনী পালিয়ে যাওয়ার সময় করতলা গ্রামের একটি কেওড়াতলায় আটকে যায়। তখন মুক্তিকামী জনতা তাদেরকে দেখে মুক্তিযোদ্ধাদের খবর দিলে মুক্তিযোদ্ধাসহ শতাধিক মুক্তিকামী জনতা তাদেরকে আটক করার সময় পাকিবাহনী চারদিকে গুলি ছুড়তে শুরু করে। এসময় ২ জন মুক্তিযোদ্ধসহ ৪ জন মুক্তিকামী জনতা নিহত হয়। পাকিবাহিনীর গোলাবারুদ শেষ হয়ে গেলে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে নিহত হয় ৬ জন পাকিস্তানী বাহিনী।

রক্তঝরা এ দিনে বীরমুক্তিযোদ্ধারা চান্দিনাতে উত্তোলন করে স্বাধীন বাংলার লাল সবুজের পাতাকা। আজকের দিনটি একদিকে যেমন আনন্দের অপরদিকে স্বজনহারাদের জন্য বেদনার দিন। দীর্ঘ নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের সময় চান্দিনা ও তার আশ-পাশের বিভিন্ন স্থানে খন্ডযুদ্ধ সংগঠিত হয়। এতে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ১০ মুক্তিযোদ্ধাসহ প্রায় শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগে চান্দিনাবাসী আজও গর্বিত। জাতীয় ভাবে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস পালিত হলেও আজকের দিনটি চান্দিনা বাসীর জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। দিবসটি উপলক্ষে চান্দিনাতে মুক্ত দিবস উদযাপিত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীরমুক্তিযোদ্ধা হাজী আবদুল মালেক বাসসকে জানান, সকালে চান্দিনা উপজেলা পরিষদ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বর থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে বর্ণাঢ্য বিজয় র‌্যালি অনুষ্ঠিত হবে।

Loading