মানিকগঞ্জের আম্বিয়া হত্যার মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামী ২১ বছর পর বংশালে গ্রেফতার

প্রকাশিত: ৮:৩৩ অপরাহ্ণ , আগস্ট ১৪, ২০২২

মানিকগঞ্জের সিংগাইর এলাকায় চাঞ্চল্যকর আগুনে পুড়িয়ে আম্বিয়া হত্যা মামলার দীর্ঘ ২১ বছরের পলাতক মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামী আলম’কে রাজধানীর বংশাল হতে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব-৪।

১। র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন, র‌্যাব এলিট ফোর্স হিসেবে আত্মপ্রকাশের সূচনালগ্ন থেকেই বিভিন্ন ধরনের অপরাধ নির্মূলের লক্ষ্যে অত্যন্ত আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করে আসছে। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ নির্মূল ও মাদকবিরোধী অভিযানের পাশাপাশি খুন, চাঁদাবাজি, চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাই চক্রের সাথে জড়িত বিভিন্ন সংঘবদ্ধ ও সক্রিয় সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যদের গ্রেফতার করে সাধারণ জনগণের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে জোড়ালো তৎপরতা অব্যাহত আছে। র‌্যাব-৪ বিগত দিনগুলোতে চাঞ্চল্যকর ও ক্লুলেস হত্যাকান্ডের আসামী গ্রেফতার যেমনঃ সাভারের অধ্যক্ষ মিন্টু চন্দ্র বর্মন হত্যার রহস্য উদঘাটনপূর্বক আসামীদের গ্রেফতার, চাঞ্চল্যকর শাহীন উদ্দিন হত্যা মামলার আসামীদের গ্রেফতার, সাভারের ক্লুলেস ফাতিমা হত্যা রহস্য উদঘাটনসহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ক্লুলেস হত্যা মামলার রহস্য উদঘাটন করে যার প্রেক্ষিতে সার্বিক মূল্যায়নে ২০২১ সালে র‌্যাব-৪ ক্লুলেস অপরাধ রহস্য উদঘাটনে প্রথম স্থান লাভ করে। এছাড়াও র‌্যাব-৪ কর্তৃক কয়েক যুগ ধরে বিভিন্ন পলাতক যাবজ্জীবন কারাদন্ডপ্রাপ্ত বা মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত ছদ্মবেশী বেশ কয়েকজন দুর্র্ধষ খুনী, ডাকাত ও ধর্ষককে গ্রেফতার করে যার মধ্যে চাঞ্চল্যকর গর্ভবতী জুলেখা (১৯) হত্যা মামলার মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামী সিরাজুল (৩৯)’কে ১৯ বছর পর গ্রেফতার, চাঞ্চল্যকর ইদ্রিস হত্যা মামলার মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামী নজরুল ইসলাম (৪২)’কে ০৭ বছর পর গ্রেফতার, মানিকগঞ্জ সদর এলাকার আজহার হত্যা মামলার দীর্ঘ ৩১ বছর বিভিন্ন ছদ্মবেশে পলাতক মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামী মোঃ কাওসারকে রাজধানীর গুলশান এলাকা থেকে গ্রেফতার, চাঞ্চল্যকর গর্ভবতী নিপা ও তার ৩ বছরের মেয়ে জোতি’কে শ্বাসরোধ করে হত্যা মামলায় মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামী জাকির হোসেন (৪৭)’কে গ্রেফতার ছাড়াও মানিকগঞ্জের পোড়রা এলাকা হতে মাদক মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ১০ বছর যাবত পলাতক আসামী মোঃ সেলিম ওরফে বিপ্লবকে গ্রেফতার করা হয়।

২। এরই ধারাবাহিকতায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গতকাল অর্থাৎ ১৩ আগস্ট ২০২২ তারিখ দিবাগত রাতে রাজধানীর বংশাল এলাকায় র‌্যাব-৪ এর একটি চৌকস আভিযানিক দল অভিযান পরিচালনা করে মানিকগঞ্জের সিংগাইর এলাকায় চাঞ্চল্যকর পেট্রোল ঢেলে আগুনে পুড়িয়ে গৃহবধু আম্বিয়া হত্যা মামলার দীর্ঘ ২১ বছরের পলাতক মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামী মোঃ আলম (৪০)’কে গ্রেফতার করতে সমর্থ হয়।

৩। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ ও ঘটনার বিবরণে জানা যায় যে, গ্রেফতারকৃত আসামী মোঃ আলম ও ভিকটিম একই গ্রামের বাসিন্দা। গ্রেফতারকৃত আসামীর সাথে ঘটনার প্রায় ০৩ মাস পূর্বে ২০০১ সালের জুন মাসে মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর থানাধীন আটিপাড়া গ্রামের জনৈক মোঃ মকবুল হোসেন এর মেয়ে ভিকটিম আম্বিয়া বেগম (১৮) এর সাথে পারিবারিকভাবে বিবাহ হয়। বিয়ের সময় ভিকটিমের বাবা সামর্থ্য অনুযায়ী আসবাবপত্র, ইলেক্ট্রনিকস সামগ্রী, নগদ অর্থ ও স্বর্ণালংকার প্রদান করে। কিন্তু আসামী আলম ছিল অত্যান্ত লোভী, ধূর্ত, উগ্র এবং বদমেজাজী। বিয়ের পর থেকেই যৌতুকের দাবিতে প্রায়ই তার নব-বিবাহিতা স্ত্রী ভিকটিম আম্বিয়া’কে মারধর করত। একপর্যায়ে আসামী আলমসহ আসামির বাবা-মা ও নিকট আত্মীয়-স্বজন ভিকটিমের পরিবারের নিকট আরো ৫০,০০০ টাকা যৌতুক দাবি করে। ভিকটিমের বাবা দরিদ্র হওয়ায় ভিকটিম আসামির দাবীকৃত যৌতুকের টাকা দিতে ব্যর্থ হয়। দাবীকৃত যৌতুকের টাকা দিতে না পারায় আসামি ভিকটিমকে বিভিন্ন সময় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করতে থাকে। ভিকটিমের বাবা বিষয়টি জানতে পেরে ধার দেনা করে আসামিকে ১০,০০০ টাকা প্রদান করে। কিন্তু যৌতুকের বাকি টাকা পাওয়ার জন্য আসামী নির্যাতনের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়। এক পর্যায়ে ঘটনার ১০/১২ দিন পূর্বে আসামি ভিকটিমকে মারধর করে ভিকটিমের বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দেয় এবং যৌতুকের ৪০,০০০ টাকা না নিয়ে আসলে তাকে বাড়িতে উঠতে দেবে না বরং মেরে ফেলবে মর্মে হুমকি দেয়। ঘটনার দিন ০৫/০৯/২০০১ তারিখ দিবাগত রাত ১১:৩০ ঘটিকার সময় আসামী আলম ভিকটিমের বাবার বাড়িতে এসে ভিকটিমকে ঘরের বাইরে ডেকে নিয়ে বাড়ি থেকে ৩০০ গজ দূরে ফাঁকা রাস্তায় পৌছালে আসামী আলম ভিকটিমকে চর, থাপ্পর, কিল, ঘুষি মারতে থাকে। এতে করে ভিকটিম একপর্যায়ে মাটিতে লুটিয়ে পরে। তখন আসামী পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সংগ্রহ করে রাখা পেট্রোল ভিকটিমের গায়ে ঢেলে দিয়ে দিয়াশলাই দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। ভিকটিমের চিৎকার এবং আর্তনাদে ভিকটিমের মা-বাবা ও আত্মীয়-স্বজনসহ আশপাশের প্রতিবেশীরা এসে আগুন নিভায় এবং গুরুতর অগ্নিদগ্ধ ভিকটিম আম্বিয়াকে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য প্রথমে সিংগাইরের সেবা ক্লিনিকে নিয়ে যায়। ঘটনাস্থলে উপস্থিত ভিকটিমের বাবা-মা এবং আত্মীয় স্বজন ও সেবা ক্লিনিকে উপস্থিত ডাক্তার-নার্সদের নিকট ভিকটিম জানায় যে, আসামী আলম তাকে মারধর করেছে এবং তার শরীরে পেট্রোল ঢেলে দিয়ে অগ্নি সংযোগ করেছে। রোগীর গুরুতর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে উক্ত ক্লিনিকের চিকিৎসকগণ ভিকটিমকে দ্রæত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করেন। সে অনুযায়ী ঐ রাতেই ভিকটিমকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং চিকিৎসাধীন অবস্থায় ০৬/০৯/২০০১ তারিখ সকাল ০৮:০০ ঘটিকায় ভিকটিম আম্বিয়ার মৃত্যু হয়। পরবর্তীতে রমনা থানা পুলিশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উপস্থিত হয়ে ভিকটিমের মৃতদেহের সূরতহাল রিপোর্ট প্রস্তুুত করে এবং উক্ত হাসপাতালে ভিকটিমের মৃতদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। অতঃপর ০৭/০৯/২০০১ তারিখ ভিকটিমের বাবা মোঃ মকবুল হোসেন বাদী হয়ে সিংগাইর থানায় ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে আসামী আলম, উক্ত আসামির বাবা মোঃ রহিজ উদ্দিন, মা আলেয়া বেগম, আলমের বোন জামাই রবিউল, আলমের চাচাতো নানা আফতাবসহ সর্বমোট ০৫ জনের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করে যার মামলা নং-০৪(১)০১, ধারা-২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন এর ধারা ১১(ক)/৩০। মামলার পর হতে অদ্যবধি আসামী আত্মগোপনে থাকায় থানা পুলিশ মূল আসামী আলমকে গ্রেফতার করতে ব্যর্থ হয়। মামলার তদন্ত শেষে তদন্তকারী কর্মকর্তা আসামী আলমের বিরুদ্ধে বিজ্ঞ আদালতে দ্রæততম সময়ের মধ্যে চার্জশিট প্রদান করেন এবং এজাহারনামীয় বাকি ০৪ জন আসামীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় চার্জশীট থেকে অব্যাহতির আবেদন করেন। পরবর্তীতে চার্জশিটের ভিত্তিতে মানিকগঞ্জ জেলার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন স্পেশাল ট্র্যাইবুনাল এর বিজ্ঞ বিচারক উক্ত মামলার বিচারকার্য পরিচালনা করেন এবং পর্যাপ্ত স্বাক্ষ্য প্রমাণ ও উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে ভিকটিম আম্বিয়াকে হত্যাকান্ডে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকার অপরাধে ৩০/১১/২০০৩ তারিখ চার্জশিটে অভিযুক্ত আসামী আলমকে মৃত্যুদন্ড সাজা প্রদান করেন। পরবর্তীতে ডেথ রেফারেন্সের জন্য মামলা উচ্চ আদালতে গেলে মহামান্য বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ গত ০৬/০৭/২০০৬ তারিখ আসামী আলম এর মৃত্যুদন্ড বহাল রেখে রায় প্রদান করে। উক্ত ঘটনার পর হতে আসামি আলম দীর্ঘ ২১ বছর পলাতক ছিলো।

৪। আসামীর জীবন বৃত্তান্তঃ প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, আসামী ১৯৮২ সালে মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর থানাধীন আটিপাড়া এলাকায় জন্মগ্রহণ করে। চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে সে সবার বড়। সে স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করে। ব্যক্তিগত জীবনে আসামী ০২ টি বিয়ে করেছে। প্রথম স্ত্রী ভিকটিম আম্বিয়াকে আসামী বিয়ের ০৩ মাসের মধ্যে আগুনে পুড়িয়ে নৃশংস ভাবে হত্যা করে এবং এই ঘটনার ০৫ বছর পর পুনরায় ঢাকার বংশাল এলাকায় নিজের নাম ঠিকানা গোপন করে দ্বিতীয় বিয়ে করে। বর্তমানে আসামী আলম তার দ্বিতীয় স্ত্রী সূমী (৩৫)’কে নিয়ে ঢাকার টিকাটুলি এলাকায় বসবাস করে আসছিলো। বর্তমান পরিবারে তার মহিন (১৫) নামের একটি পুত্র সন্তান রয়েছে। ২০০১ সালের পর থেকে আসামী আর কোনোদিন মানিকগঞ্জে যায়নি।

৫। আত্মগোপনে থাকাকালীন সময় আসামীর জীবনযাপনঃ আসামীর বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হওয়ায় এবং ঐ মামলায় সে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত হওয়ায় গ্রেফতার এড়ানোর লক্ষ্যে লোক চক্ষুর আড়ালে সে নিজেকে আত্মগোপন করে। পরিচিত লোকজন থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখার জন্য ঘটনার পর (২০০১ সালে) ঢাকায় চলে আসে। গত ২১ বছর ধরে আসামী আলম এনআইডিতে নিজের নাম ঠিক রেখে বাবা-মায়ের নাম ও ঠিকানা পরিবর্তন করে বিভিন্ন ছদ্মবেশ ধারণ করে পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় আত্মগোপনে ছিল। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় আসামী নিজের পরিচয় গোপন করার জন্য ক্রমাগতভাবে সে পেশা পরিবর্তন করে আসছিলো। প্রথমদিকে সে পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় শ্রমিকের কাজ করতো। পরবর্তীতে সে বাসা ভাড়ার দালালি করে জীবিকা নির্বাহ করতো। তবে গত কিছুদিন যাবৎ সে বংশালে একটি জুতার কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করে আসছিলো।

৬। নতুন ঠিকানায় জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরীঃ আলম নিজের পরিচয় গোপন করার জন্য সে কাজী আলাউদ্দিন লেন, বংশাল, ঢাকা এর ঠিকানায় এনআইডি তৈরি করে এবং নিজের মায়ের নাম পরিবর্তন করে আলেয়া বেগম এর স্থলে জাহানুর বেগম ও বাবার নাম পরিবর্তন করে মোঃ রইস উদ্দিন স্থলে মো ইয়াসিন নাম ব্যবহার করে বসবাস করে আসছিলো।
৭। গ্রেফতারকৃত আসামীকে সংশ্লিষ্ট থানায় হস্তান্তর কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন।

Loading