কম খেয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছে মানুষ

প্রকাশিত: ৯:০৪ পূর্বাহ্ণ , আগস্ট ১৩, ২০২২

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের লাগামহীন দামের সাথে আর পেরে উঠছে না সাধারণ মানুষ৷ কম খেয়ে, এক বেলা না খেয়ে অথবা ঋণ করে চলছেন তারা৷

বিশ্লেষকরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে দারিদ্র্য আরো বাড়বে৷ তাদের কথা, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় নতুন করে তৃতীয় দফায় নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার ঢেউ চলছে৷ গত কয়েকদিনে সব পণ্যের দাম গড়ে শতকরা ৩০ ভাগ বেড়েছে৷

প্রতিনিয়ত দাম বাড়ছে

এখন প্রতিদিনই পণ্যের দাম বাড়ছে৷ ফার্মের মুরগির ডিমের ডজন তিন দিনের ব্যবধানে এখন ১৫০-১৫৫ টাকা৷ তিন দিন আগে ছিল ১২৫ টাকা৷ প্রতিটি ডিমের দাম এখন ১৩ টাকারও বেশি৷

কলাবাগানের মুদি দোকানদার মিন্টু মিয়া জানান, ‘‘হয়তো দুই-এক দিনের মধ্যে একটি ডিমের দাম ১৫ টাকা হবে৷” তিনি জানান, এখন সবচেয়ে কম দামের স্বর্ণা মোটা চালের দামও ৫৩-৫৫ টাকা৷ এর চেয়ে কমদামে বাজারে আর কোনো চাল নেই৷ সয়াবিন তেলের দাম লিটারে কোথাও কোথাও ২০ টাকা বেড়ে গেছে৷ সরকারের বেঁধে দেয়া ১৮৫ টাকা দামে আর সয়াবিন তেল পাওয়া যায় না৷ চাল, ডাল, চিনি, দুধ সব পণ্যের দামই গত দুই-তিন দিনে কেজিতে পাঁচ থেকে ১০ টাকা করে বেড়েছে বলে জানান মিন্টু মিয়া৷

এদিকে ভোজ্য তেলের সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন আমদানিকারকরা৷ তাই বাজারে সংকট তৈরি হয়েছে৷ তারা দাম শতকরা ২০ ভাগ বাড়ানোর দাবি করেছেন৷

কাঁচাবাজারেরও একই অবস্থা৷ ১২০ টাকা কেজির শিম বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকায়, ৭০ টাকার গাজর ১২০ টাকায়৷ টমেটোর দাম কেজিতে ৫০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকায়৷ গত কয়েক দিনের ব্যবধানে কেজিতে শাকসবজির দাম বেড়েছে ১০ থেকে ৪০ টাকা৷

যেভাবে চলছে মানুষ

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এস এম আলমগীর হোসেন শুক্রবার সকালে বাজারে গিয়ে অনেকটা বিমর্ষ হয়ে পড়েন৷ তিনি তার সব পণ্যই আগের চেয়ে পরিমাণে কম কিনতে বাধ্য হন৷ ৫০ হাজার টাকা বেতনের এই চাকুরে চার সদস্যের পরিবার নিয়ে কীভাবে টিকে থাকবেন তা ভাবতে পারছেন না৷ গত তিন বছরে তার বেতন বাড়েনি৷ তিনি বলেন, ‘‘এক সপ্তাহ আগে ঢেঁড়সের কেজি আমি কিনেছি ৫০-৫৫ টাকায়, আজকে (শুক্রবার) সকালে বাজারে গিয়ে দেখি দাম ৬০-৭০ টাকা৷ শসা কেজিতে ১০ টাকা বেড়েছে৷ টমোটের কেজি ১০০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে৷ সব ধরনের মাছের দাম কেজিতে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা বেড়েছে৷ গরুর মাংস, মুরগির মাংসের দাম বেড়েছে৷ পাঁচ লিটারের সয়াবিন তেলের দাম বোতলের গায়ে লেখা আছে ৯১০ টাকা৷ কিন্তু বিক্রি হচ্ছে ৯৯৭ টাকায়৷ ১০০ টাকা বেড়ে গেছে৷”

আলমগীর হোসেন বলেন, ‘‘এই পরিস্থিতিতে আমাকে ব্যয় কমাতে হচ্ছে৷ যেমন আগে প্রতি সপ্তাহে শুক্রবার আমাদের পরিবারে আমরা গরুর মাংস খেতাম৷ এখন দুই সপ্তাহে একবার খাই৷ মুরগির মাংস সপ্তাহে তিন দিন খেতাম, এখন খাই একদিন৷ মাছ খাওয়াও কমিয়ে দিয়েছি৷ এখন বাচ্চাদের জন্য দুধ কেনাসহ সব কিছুই আগের চেয়ে কম কিনছি৷”

স্কুল শিক্ষিকা সুমাইয়া করিম বলেন, ‘‘সংসারের খরচ মেটাতে এত দিন ঋণ করেছি৷ বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে ধার নেয়া ছাড়াও বেতনের বিপরীতে ব্যাংক থেকে ঋণ করেছি করোনার সময়৷ আশা করেছিলাম পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে শোধ করতে পারব৷ কিন্তু জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর এখন পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে৷ সব কিছুর দাম অনেক বেড়ে গেছে৷ এখন আমি পড়েছি মহাবিপদে৷ ঋণও শোধ করতে পারছি না৷ ধার দেনা করার আর কোনো জায়গাও নেই৷ কী করব আর ভেবে পাচ্ছি না৷”

কতটা দাম বেড়েছে, মানুষ টিকে আছে যেভাবে

কনজ্যুমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, ‘‘জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর এই কয়েক দিনে প্রতিটি নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম গড়ে শতকরা ৩০ ভাগ বেড়েছে৷ আর এটা সাধারণ মানুষকে চরম সংকটের মধ্যে ফেলেছে৷ মানুষ কম খেয়ে অথবা এক বেলা না খেয়ে টিকে আছে৷ আবার এখন যে ঋণ করে সামাল দেবে তাও পাওয়া যাচ্ছে না৷”

তার কথা, ‘‘জ্বালানি তেলের দামের কারণে সব কিছুর দামই বাড়ছে৷ কিন্তু যতটা বাড়ার কথা তার চেয়ে অনেক বেশি বাড়ছে৷ সব পর্যায়ের ব্যবসায়ীরাই সুযোগ নিচ্ছে, সবজি দোকানদার থেকে শুরু করে সবাই৷ চাল আমদানির সুযোগ দেয়ার পরও চালের বাজারে সংকট তৈরি করা হয়েছে চাল মজুদ করে৷ ভোজ্য তেলেও তাই করা হচ্ছে৷ বাজার মনিটরিং বলে কিছু আছে বলে মনে হয় না৷”

দারিদ্র্য বাড়বে

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘‘জ্বালানি তেলের দামের সাথে যে পরিবহন ভাড়া বেড়েছে তা অতিরিক্ত৷ ফলে এর প্রভাব সবখানে পড়েছে৷ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যসহ কৃষিপণ্যের দাম বাড়ছে৷ তবে ইউক্রেন যুদ্ধসহ বিশ্ব পরিস্থিতি যা, সেই তুলনায় বাংলাদেশে বেশি দাম বাড়ছে৷ কারণ এখানে বাজারে তেমন মনিটরিং নেই৷ জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর পরিবহন মালিকরা ইচ্ছে মতো ভাড়া বাড়িয়েছেন৷ সেটা নিয়ন্ত্রণ করা গেলে পরিস্থিতি এত খারাপ হত না৷”

তার কথা, ‘‘গত এক, দেড় বছরে এটা তৃতীয় দফায় মূল্য বৃদ্ধির ঢেউ৷ এই সময়ে গড়ে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ৬০ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে৷ এটা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে এর প্রভাবে দারিদ্র্য আরো বাড়বে৷”

ড. মোয়াজ্জেম মনে করেন, ‘‘জ্বালানি তেলের এভাবে নজিরবিহীন দাম বাড়ানো কোনোভাবেই ঠিক হয়নি৷ এটা অন্যভাবেও ম্যানেজ করা যেত৷ এখন পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারকে ডিজেলসহ জ্বালানি তেলের দাম কমাতে হবে৷”

প্রসঙ্গত বাংলাদেশে করোনার কারণে তিন কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন৷ আর গত জুন মাসে পিপিআরসি এবং ব্র্যাকের এক যৌথ গবেষণায় বলা হয়েছে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে নতুন করে আরো ২১ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়েছেন৷ DW

Loading