সেতুর চেয়েও বড়

প্রকাশিত: ৯:২৩ পূর্বাহ্ণ , জুন ২৫, ২০২২

ওবায়দুল কবির :

বিশ্বের কোন প্রকল্প নিয়ে এত আলোচনা হয়নি। পড়তে হয়নি এত প্রতিরোধের মুখে। এত ষড়যন্ত্র, অভিযোগ, নেতিবাচক বক্তব্য, গুজব-যেন রূপকথার গল্প। আবার কখন যে নেতিবাচক বক্তব্য ধীরে ধীরে ইতিবাচক হয়ে উঠেছে, ‘তোমার’ থেকে হয়ে গেছে ‘আমাদের’, শুরু হয়েছে কৃতিত্ব নেয়ার প্রতিযোগিতা, তাও এক বিস্ময়। পদ্মা সেতুর কথাই বলছি। এটি শুধু একটি রড-কংক্রিট-ইস্পাতে নির্মিত সেতু নয়, সেতু থেকে আরও বড় কিছু। বাঙালীর আবেগ, উন্নত জীবনের স্বপ্ন, উন্নয়নের উপাখ্যান, অনন্য ভালবাসা, আরও অনেককিছু। আজ এই বহুল আলোচিত সেতুর উদ্বোধনের দিন। কোটি কোটি মানুষের আবেগ ও প্রত্যাশার দ্বার উন্মোচন। এক সাহসী রাষ্ট্রনায়কের দৃঢ় অঙ্গীকার ও স্বপ্ন পূরণের গল্প।

অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন নিয়ে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী, নোবেল জয়ী আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব, রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী, কে নেই এই সংশয়বাদীদের তালিকায়। ২০১৮ সালে ২ জানুয়ারি ছাত্রদলের এক অনুষ্ঠানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘সরকার পদ্মা সেতুর স্বপ্ন দেখাচ্ছে। আওয়ামী লীগ আমলে এই সেতু হবে না। জোড়াতালি দিয়ে বানানো হচ্ছে। এই সেতুতে কেউ উঠবে না, রিস্ক আছে।’ সেতু নির্মাণ শেষ, ঠিক হলো উদ্বোধনের দিনক্ষণ। এবার খালেদা জিয়ার দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দাবি করে বসলেন, ২০০৪ সালে নাকি পদ্মা সেতুর প্রথম ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। শুধু একদিকে নয়; পদ্মার দুইদিকেই নাকি ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিল। মির্জা ফখরুল আরও বলেন, ‘পদ্মা সেতু কারও পৈত্রিক সম্পত্তি না। রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টার উদ্যোগে করা হয়েছে, এটি সবার।’ লন্ডনে প্রবাসী বিএনপির সাজাপ্রাপ্ত নেতা দাবি করেন জাইকার প্রাক সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর ২০০৩ সালে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করেছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। তখন সেতুর সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার কোটি টাকা। শেখ হাসিনার সরকার নাকি ৫০ হাজার কোটি টাকায় এই সেতু নির্মাণ করেছেন এবং এই অর্থ দিয়ে নাকি একডজন সেতু নির্মাণ সম্ভব ছিল। অঙ্কের হিসাবে এটি খুবই গরমিল। সম্প্রতি বিএনপির এক নেত্রী জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে দাবি করেছেন, পদ্মা সেতুর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। তখন সেতুর নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার কোটি টাকা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কোন্ নেতার বক্তব্য মানুষ গ্রহণ করবে?

একজন সংবাদকর্মী হিসাবে কিছু তথ্য দেয়া সমীচীন বলে মনে করছি। ১৯৯৮ সালে বঙ্গবন্ধু যমুুনা সেতু উদ্বোধনের পরই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উন্মত্ত পদ্মার ওপর সেতু নির্মাণের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। একাধিক অনুষ্ঠানে তিনি তার ইচ্ছের কথা ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু সেতু দেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন শুরু করেছে। পদ্মা নদীর ওপর সেতু নির্মাণ করতে পারলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষেরও ভাগ্য পরিবর্তন হয়ে যাবে।’ শুরু হয় স্বপ্ন বাস্তবায়নের কাজ। প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের মাধ্যমে পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হয় ১৯৯৯ সালে। সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাাপন করা হয় ২০০১ সালের ৪ জুলাই মাওয়া প্রান্তে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে উপস্থিত হয়ে সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাাপন করেন। সংবাদকর্মী হিসেবে সেদিনের সেই অনুষ্ঠান কভার করার সৌভাগ্য হয়েছিল। আষাঢ়ের শেষ বিকেলে সেদিন বৃষ্টি ছিল না। আকাশে ছিল ছেঁড়া মেঘ আর ভূমিতে প্রচন্ড তাপদাহ। এর মধ্যেও হাজার হাজার মানুষ এসেছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক অসম্ভব স্বপ্নযাত্রার সাক্ষী হতে। অসম্ভব মনে হচ্ছিল তখন অনেকের কাছেই। কেউ বলেছিলেন এটি শুধুই নির্বাচনী ঘোষণা। কারও মনে হয়েছিল স্বপ্নবিলাসী রাষ্ট্রনায়কের অলীক চিন্তা। আজ একুশ বছর পর সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন হওয়ার পর আবার বিতর্ক শুরু হয়েছে। যারা বিরোধিতা করেছিলেন, তারাই আজ নিজেদের কৃতিত্ব তুলে ধরে ‘সবার সেতু’ দাবি করছেন।

তখন দেশে নির্বাচনের ডামাডোল। মাত্র কয়েকদিন পরই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন শেখ হাসিনার নেতৃত্বের আওয়ামী লীগ সরকার। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদকে ১৫ জুলাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শপথ নেয়ার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট তখন নানা অজুহাতে আন্দোলনের চেষ্টা করছে। এমন এক উত্তেজনাকর পরিস্থিাতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। শুরুতে অর্থের সংস্থান ছিল না। প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসী শেখ হাসিনা সেদিন বলেছিলেন, শীঘ্রই অর্থের সংস্থান করে সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হবে। সে সুযোগ অবশ্য তিনি আর পাননি। পহেলা অক্টোবর নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় এসে সব ভেস্তে দিয়েছিল।

তখন যোগাযোগমন্ত্রী ছিলেন আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। জাতীয় ঐকমত্যের সরকারের ধারণায় জাতীয় পার্টি নেতা আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে মন্ত্রী করা হয়েছিল। প্রাক সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে সেতুর দৈর্ঘ্য নির্ধারণ করা হয় ৬ দশমিক ৩ কিলোমিটার। সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছিল সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। সেতুর বাস্তবায়ন কাল ধরা হয়েছিল ২০০৮। সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তের পুরনো ফেরিঘাটে। সেখানে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা শেষে প্রধানমন্ত্রী চলে যান দুই কিলোমিটার দূরে কুমারভোগ চন্দ্রের মাঠে। আওয়ামী লীগ এই মাঠে আয়োজন করেছিল বিশাল সমাবেশের। মোহাম্মদ মহিউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে সেই জনসভায় বক্তৃতা করেছিলেন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, আমির হোসেন আমু, আবদুুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদসহ কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দ।

ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, জাপান সফরের সময় সে দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমি বাংলাদেশে দুটি সেতুতে অর্থ বরাদ্দের অনুরোধ জানিয়েছি। একটি রূপসা এবং অপরটি পদ্মা। এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক পদ্মা সেতুর প্রাক সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের অর্থ দিয়েছে। জাপান সরকারও অর্থের সংস্থানে আশ্বাস দিয়েছে। দুটি সাহায্য এখন আমাদের হাতে আছে। বাকি টাকাও সংস্থান হয়ে যাবে। ক্ষমতার পালাবদলে সেদিন আর তার অর্থ জোগাড় করা হয়ে ওঠেনি। নির্বাচনী প্রচারে বিএনপির নেতারা দাবি করেছিলেন, পদ্মা সেতু শুধু আওয়ামী লীগের নির্বাচনী স্ট্যান্টবাজি। এর কোন কাজই তারা করে যায়নি।

বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় এসে পদ্মা সেতু নিয়ে নানা ঘটনার জন্ম দেয়। তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার নানা ধরনের উষ্মা এবং বাঁকা বক্তব্যে পদ্মা সেতুর ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে ওঠে। শুরু করা হয় সেতুর স্থান নিয়ে বিতর্ক। শেখ হাসিনা যে স্থানে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন সে স্থানে সেতু নির্মাণ সম্ভব নয় বলে বিতর্কের জন্ম দেন স্বয়ং যোগাযোগমন্ত্রী। এ নিয়ে চলে নানামুখী আলোচনা। ক্ষমতার পাঁচ বছর অর্থ জোগাড় দূরের কথা সেতুর স্থানই নির্ধারণ করতে পারেনি চারদলীয় জোট সরকার। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষ সময়ে আবারও পদ্মা সেতু নির্মাণের চিন্তা করা হয়েছিল। জাইকার সঙ্গে তাদের বৈঠকও হয়েছিল। বিদায় নেয়ার সময় ঘনিয়ে এলে তারা আর এই কাজে এগোতে পারেনি।

২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবারও উদ্যোগ নেন তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের। সেতুর অর্থায়নে চুক্তি হয় বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে। শুরু হয় ষড়যন্ত্র। সেতু নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হয়। ২০১৩-২০১৪ সাল শেষ হয় এই দুর্নীতি বিতর্কে। শেষ পর্যন্ত পদ্মা সেতুর অর্থায়ন প্রত্যাহার করে নেয় বিশ্বব্যাংক। একই সঙ্গে অর্থ প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয় অন্য উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলো। তৈরি হয় সঙ্কট। অভিযোগের প্রেক্ষিতে সরিয়ে দেয়া হয় তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে।

আওয়ামী লীগ সরকারের টালমাটাল অবস্থা। সাহসী সিদ্ধান্ত নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতুর করার ঘোষণা দেন। সেদিন তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণ কার্যক্রমে কোথাও দুর্নীতি হয়নি। এই ষড়যন্ত্র একদিন উন্মোচিত হবে।

সম্প্রতি জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী এই ষড়যন্ত্রের রূপ উন্মোচন করেন। তিনি বলেন, ‘ড. ইউনুস গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদটি রক্ষার জন্য হিলারি ক্লিনটনকে দিয়ে বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে এই পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধ করায়। নিজের স্বার্থে তিনি দেশের এত বড় ক্ষতি করেছেন। পাঠানো সকল ই-মেইল দুদকের কাছে। পদ্মা সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে আমার ওপর অনেক চাপ এসেছিল। আমার ছেলেমেয়ে ও বোনের ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করা হয়। স্টেট ডিপার্টমেন্ট জয়কে বলেছিল, তোমার মাকে বলো তোমার বিরুদ্ধে অডিট করা হবে। জয় বলেছিল, আমি মাকে এটা বলতে পারব না। আমি বলেছি, যত তদন্ত আছে করতে পারো, আমি কোন অন্যায় করিনি। সততা এবং বাংলাদেশের জনগণ হচ্ছে আমার শক্তি। আমি কাউকে ভয় পাই না। দেশের মানুষের মাথা হেঁট হোক সে কাজ আমি কোনদিন করব না। বিশ্বব্যাংককে বলেছি, কোন টাকা ছাড় হয়নি তাহলে দুর্নীতি হলো কোথায়? আমি তাদের কাছে ডকুমেন্ট চেয়েছিলাম। তারা একটা কাগজও দিতে পারেনি। আমার ওপর চাপ এলো অমুককে গ্রেফতার করতে হবে, তমুককে বাদ দিতে হবে ইত্যাদি। আমি বলেছিলাম, আমার কোন অফিসারকে বা কাউকে আমি অপমান করতে দেব না। আপনাদের টাকা লাগবে না। পারলে নিজেরা করব, না পারলে করব না। আমাকে ভয় দেখানো হয়েছে, যদি এটা না হয় আপনার নির্বাচনের কি হবে? জবাবে বলেছি, জনগণ ভোট না দিলে ক্ষমতায় আসব না, তবুও কোন অন্যায় সহ্য করব না। তারা ভেবেছিল আমি সারেন্ডার করব। আমি শেখ মুজিবের মেয়ে এটা মনে রাখা উচিত ছিল। শেখ হাসিনা কখনও অন্যায়ের কাছে মাথানত করিনি, করবেও না। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করব এবং সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করে দিলাম। তখন সকলের টনক নড়ল। বাংলাদেশকে সবাই সমীহ করতে শুরু করল। জাতির পিতা বলেছিলেন, কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না। কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারে নাই, পারবেও না ইনশাআল্লাাহ।’

শেখ হাসিনার এই সিদ্ধান্তে হতবাক হয়েছিল দেশের মানুষ। বিশ্বব্যাংক-আইএমএফসহ সকল দাতা সংস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে কিভাবে এমন সাহসী সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। কিছুটা হতবাক এবং বিস্মিত তাঁর নিজ দলের নেতারাও। শেখ হাসিনা আর পেছন ফিরে তাকাননি। মানুষের ওপর অতিরিক্ত করের বোঝা না চাপিয়ে, কারও কাছ থেকে কোন সহযোগিতা না নিয়ে দেশের নিজস্ব সম্পদ থেকে অর্থায়নের মাধ্যমে চলতে থাকে পদ্মা সেতুর কাজ। ২০১২ সালের ২৯ জুন বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে দেয় বিশ্বব্যাংক। জুলাই মাসে মন্ত্রিসভার বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় নিজস্ব তহবিল দিয়েই পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হবে। ২০১৫ সালের ১২ জানুয়ারি মূল সেতুর নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৭ সালে সেতুর কাজ অনেকটা দৃৃৃৃৃৃৃশ্যমান হলে মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে যে পদ্মা সেতু হচ্ছে। খুলে যায় অনেক জট। সমালোচনাকারীদের মুখে ছাই দিয়ে ষড়যন্ত্রের সকল জাল ছিন্ন করে পদ্মা সেতু আজ বাস্তব। এটিই হচ্ছে পদ্মা সেতুর বাস্তব ইতিহাস।

এক স্বপ্নচারী রাষ্ট্রনায়কের সাহসী সিদ্ধান্ত আজ বাস্তবায়ন হয়েছে। শেখ হাসিনার চ্যালেঞ্জ আর ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তার বিজয় হয়েছে। পরাজয় ঘটেছে বিশ্বব্যাংকের মিথ্যে অহমিকার। পরে অবশ্য বিশ্বব্যাংকও স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে পদ্মা সেতু নির্মাণে তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করে তারা ভুল করেছিল। ২০১৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. কৌশিক বসু ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘১০ বছর আগেও কেউ ভাবতে পারেনি বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থে এত বড় একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারবে।’ ২০১৭ সালে কানাডার আদালত পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতি মামলায় বিশ্বব্যাংকের দেয়া তথ্যকে অনুমানভিত্তিক, গালগল্প এবং গুজবের বেশিকিছু নয় বলে রায় দেয়। বাংলাদেশ কলঙ্কমুক্ত হয়।

১৯৯৮ সালে বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বদলাতে শুরু করে উত্তর জনপদের মানুষের ভাগ্য। গত ২৪ বছরে রাজশাহী এবং রংপুর বিভাগের সকল জেলার দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। উত্তরাঞ্চলের মানুষ ভুলে গেছে মঙ্গার (দুুর্ভিক্ষ) কথা। চৈত্র কিংবা কার্তিকের মঙ্গা আর উত্তরাঞ্চলের মানুষকে কাঁদায় না। বাসন্তিদের জাল পরানোর গল্প আজ ভিন্ন। উল্টোদিকে অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে বরিশাল বিভাগের মানুষ এখনও দেশের অন্য জেলাগুলো থেকে দরিদ্র। এইসব এলাকা থেকে ঢাকায় পণ্য নিয়ে আসতে সময় লাগে কমপক্ষে ২৪ ঘণ্টা। পদ্মা সেতু হলে তিন-চার ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাওয়া যাবে। উত্তর জনপদের মানুষের মতই দিন বদলের স্বপ্ন দেখছে দক্ষিণের ২১ জেলার মানুষ। তাদের এলাকায় গ্যাস যাবে, শিল্পায়ন হবে। দ্রুত পণ্য পরিবহন করা গেলে ভাল দাম মিলবে। কর্মচাঞ্চল্যে ভরে উঠবে দক্ষিণের ব্যবসা-বাণিজ্য। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি হবে। উন্নত হবে জীবনযাত্রার মান। এগিয়ে যাবে বাংলাদেশও। প্রমানিত হবে পদ্মা সেতু নিছক সেতুই নয়, সেতুর চেয়ে অনেক বড় কিছু। কোটি মানুষের ভাগ্য বদলে দিতে পারে যে সেতু, সেটিকে শুধু ‘বড়’ বললেও যেন কম বলা হয়।

লেখক- ডেপুটি এডিটর, জনকণ্ঠ

Loading