চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা মূল্যহীন কথাগুলো – সৌমেন ধর

প্রকাশিত: ৬:৩০ অপরাহ্ণ , জুন ২০, ২০২২

মনে আছে নিশ্চয় সকলের চট্টলগৌরব এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর শেষ নির্বাচনের কয়েকদিন আগে বৃষ্টি হচ্ছিলো লাগাতার। নির্বাচনের মাত্র কয়েকদিন আগের এক রাতে আমরা নগরীর হামজারবাগ আতুরার ডিপো এলাকার সভা শেষ করে ফিরছিলাম তার বাসায়। গাড়িতে চালক ছাড়া আমি আর তিনি। সারা রাস্তা জুড়ে কয়েক ফুট পানি, আলো আঁধারিতে বৃষ্টিও হচ্ছিলো। গাড়ির সাইরেন বাজছিলো একনাগারে। তিনি ড্রাইভার মানিককে বললেন- অ বাজি পিঁ পিঁ বন্ধ গরছুনা। মাইনষে মারিবু ত (অ বাপ পিঁ পিঁ বন্ধ কর না। লোকে মারবে ত)। এরপর তিনি আমাকে বললেন- আঁরে কাডি চাক্তাই খালঅত ভাআই দিলেঅ পানি যাইবু না ? ( আমাকে কেটে চাক্তাই খালে ভাসিয়ে দিলেও পানি কি যাবে ?) তার সেই প্রশ্নটি এখনো মনে গেঁথে আছে। তার মানে কি চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতার সংকট নিরসনযোগ্য নয়…? এমন তো নয়- তবে যুগে যুগে কালে কালে এই সংকট জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। দেশপ্রেমিক যে সেনাবাহিনী সর্বক্ষেত্রে সাফল্য ছিনিয়ে আনে তাদেরও এক্ষেত্রে অসহায়ত্ব প্রকাশ পাচ্ছে। শুধু এই একটি খাতেই হাজার হাজার কোটি টাকা প্রতিটা সময়েই বরাদ্ধ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। কেন ? এই প্রশ্নটা এক শব্দের হলেও উত্তর দিতে হবে হাজার হাজার শব্দে। তাই সেই উত্তর আপাতত আমিও এখানে দিতে চাইনা। বরং আরো কয়েকটা প্রশ্ন ছুড়ে দিতে চাই। আর সেগুলো হলো- আমরা যে ড্রেণেজ সিস্টেমের কথা বলি চট্টগ্রাম নগরীতে তা কি বাস্তবসম্মতভাবে রয়েছে ? সিডিএর বহুল আলোচিত মাস্টার প্ল্যান গেলো তারপর এলো ডেপ বা ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান। সেইসব প্ল্যাণের কতোটা কি হলো। মহিউদ্দিন চৌধুরী বার বার করে বলতেন- কর্ণফুলির কার্যকর ড্রেজিং এর কথা। তিনি বলতেন- শহরের যেসব খালগুলো কর্ণফুলির সাথে যুক্ত হয়েছে সেই সংযোগ স্থানগুলোতে পর্যাপ্ত এবং নিয়মিত ড্রেজিং এর কথা। আমরা জানি সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বাড়ছে আর সেই সাথে পলি জমে এবং নানাভাবে ভরাট হচ্ছে কর্ণফুলি। তাহলে পানি নামবে কি করে। কর্ণফুলির সর্বশেষ ড্রেজিং এর কাজ যাকে দেয়া হয়েছিল সেই প্রতিষ্ঠান এতোটাই হরিলুট করেছিলো যে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। মহিউদ্দিন চৌধুরী মেয়রের পদ হারিয়েও একবার দলবল নিয়ে গেছিলেন চাক্তাই এবং ওমর আলী ঘাট সংলগ্ন এলাকায়। গিয়ে শাসিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য কিছুই হলো না…
আমরা কি এই জলাবদ্ধতার জন্য নগরবাসীকে দায়ী করছি ? কারা এই চাক্তাই খালকে সারাবছর অপচনশীল নানাকিছু ফেলে পায়ে হাঁটার পথ বানিয়ে রাখছে সেই প্রশ্ন কি তুলছি ? শহরের ভেতর দিয়ে আঁকা বাঁকাভাবে এরকম একটি খাল বয়ে বয়ে যাওয়ার পরও পানি নামছে না কেন। খালের পাড়ের বাজার দোকান গুলো সকল আবর্জনা ফেলছে এই খালে। কোন কোন বাসা বাড়ি ভবন থেকে এই খালে নষ্ট হয়ে যাওয়া ভাঙা খাট আসবাব লেপ তোষকও ফেলতে দেখা গেছে। মাছ বেপারিরা তাদের কর্কশিটের বক্সগুলো ফেলছে এই খালে, অগনিত প্লাস্টিক পলিথিন আসছে কোত্থেকে ? কারা ফেলছে ? এসব কি সিটি কর্পোরেশন – সিডিএ এসে ফেলে যাচ্ছে। অজস্র ভবন হচ্ছে। খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে কোনটারই সুচিন্তিত কোন ড্রেণেজ সিস্টেম নাই। যদি স্যাটেলাইটে চট্টগ্রাম শহরের ভেতর দিয়ে বয়ে খালটির অস্তিত্ব খোঁজা হয় দেখা যাবে কোথাও কোথাও খালের অস্তিত্ব গায়েব। সর্বশেষ সেনাবাহিনী জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজ শুরু করে চাক্তাই খাল থেকে মাটি আর বর্জ্য অপসারণ করে যাওয়ার পর আবারও ভরাট হয়ে যাচ্ছে। অথচ স্বাভাবিক পানি প্রবাহে দেখা যায় জোয়ার ভাটা এখনো রয়েছে এই খালে। আর সেই জোয়ারের পানিতে অনেক অঞ্চল বর্ষামুক্ত মৌসুমেও তলিয়ে যেতে দেখা যায়। অজস্র স্থাপনার কারণে খালতো চোখেই পড়েনা। আর এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে গেলে আসে নানা রক্তচক্ষুর হুঙ্কার। তার মানে মানুষ এই দুর্দশা থেকে মুক্তি পাক তা যেন এই নগরবাসীই চাইছেনা। কখনো তো এমনও দেখা যায় বর্ষার আগে কর্পোরেশন খাল থেকে টনকে টন আবর্জনা তুলে সেসব আবার খালের পাড়েই রেখে যাচ্ছে। এবং তুলে নেয়ার আগেই সেসব গিয়ে পড়ছে খালে। বেশ আগে এই খালের তলা পাকা করা হয়েছিলো- পরে দুইপাশে রিটেইনিং ওয়ালও দেয়া হয়েছিল। সেসব কোথায় কতোটা অক্ষত আছে, তা কি দেখার কেউ নেই। কারা এসব করছে শাস্তি কি কেউ পাচ্ছে। এই মুহুর্তে সবার আগে দরকার পুরো নগরীতে এই খালের গতি প্রবাহ স্বাভাবিক রেখে প্রয়োজনে পাড়ে পাড়ে সিসিটিভি বসিয়ে মনিটরিং করা এবং অবৈধ দখলকারী আর আবর্জনা নিক্ষেপকারীদের কঠিন শাস্তি দেয়া। একসময় যে খাল দিয়ে কর্ণফুলি থেকে নানা পণ্যবাহী সাম্পান ঢুকে যেতো এই নগরীর ভিতর দিয়ে সেই চিত্র আর দেখা যায়না কেন ? এর জন্য কি প্রকৃতি দায়ী ? উন্নত দেশে হলে হয়তো শহরের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া এরকম একটি স্রোতস্বিনী স্রোতধারাকেই স্বাস্থ্যকর পর্যটন অবকাঠামোতে রূপ দিতো। হ্যাঁ এটা ঠিক এ অবস্থার সুযোগে সংশ্লিষ্ট তদারককারী সংস্থাগুলোও সুযোগ নিচ্ছে অনিয়ম, অবহেলা আর দুর্ণীতি স্বেচ্ছাচারিতার। এসব এখানেও লিখে শেষ করা যাবেনা। নগর পরিকল্পনাবিদরা মতামত দেন। তাদেরকে ডেকে বেশ ভালো খাইয়ে ভালো ভালো পরিকল্পনা আর মতামত নেয়া হয়। কিন্তু বস্তুত পরিকল্পনার পরী আকাশে উড়ে যায় আর কল্পনাপ্রবণ নগরবাসী নিজেদেরকে সিঙ্গাপুরবাসী ভেবে বর্ষায় লুটোপুটি খেতে থাকেন।
* ফুটনোট : ছবিতে দেখা যাচ্ছে চাক্তাই খাল যেন পেলিথিনের ভাগার, খালে আবর্জনার স্তর পুরো হয়ে গাছপালা গজিয়েছে, আর বর্ষায় খাল এবং রাস্তা একাকার হয়ে গেছে। আরেকটিতে দেখা যাচ্ছে কর্ণফুলি আর চাক্তাই খালের সংযোগস্থলে পলি জমাটের দৃশ্য। এরকম অসংখ্য ফুটেজ আমার মতো আরো কারো কারো রয়েছে বলে মনে করি।
#সৌমেন_ধর

Loading