করোনায় বদলে গেছে এবারের ঈদ প্রকাশিত: ৮:১৬ পূর্বাহ্ণ , মে ২৫, ২০২০ কয়েক বছর আগে এক প্রকাশক বন্ধুকে মালপত্রের সঙ্গে রিকশাযানে চেপে বসা দেখে তাকে ডেকে গালমন্দ করেছিলাম। চোখ বড় করে বলেছিলাম, মানইজ্জত রাখলে না। তুমি আলাদা একটা রিকশায় যেতে পারতে, ভ্যানে মালপত্রসহ উঠেছ! প্রকাশক বন্ধুটি সরলতার সঙ্গে বলেছিল, সামনে ঈদ, একশ’ টাকা সাশ্রয় করতে পারলে ঈদে ব্যয় করা যাবে। তার জবাব মনঃপূত হয়নি, মনে মনে গালি দিয়েছিলাম। এবার করোনাকালে ঈদের আগে আরেক প্রকাশক বন্ধু ঢাকায় টিকে থাকতে না পেরে মালপত্র সহযোগে একটা ট্রাক অনেক কষ্টে ঋণ করে ভাড়া নিয়ে পরিবারসহ গ্রামের বাড়ি রওনা হয়েছিল। পথিমধ্যে পদ্মার পাড় থেকে পুলিশ তাদের ঢাকায় ফিরিয়ে দেয়। তার মানইজ্জত রক্ষা তো দূরের কথা, জীবনরক্ষার প্রেসক্রিপশনও আমার কাছে নেই। করোনা সব বদলে দিয়েছে। চিরায়ত সমাজব্যবস্থা, ধ্যান-ধারণা, আন্তরিকতা, দর্শন সবকিছু। মানুষ করোনাকালে নতুন করে পরিচিত হচ্ছে চারপাশের পরিবেশের সঙ্গে। প্রতিনিয়ত মানুষ স্বগতোক্তি করছে জীবন এমন ছিল না, জীবন এমন হওয়ার নয়। বাঙালি একবেলা না খেয়ে থাকতে পারে কিন্তু আড্ডা ছাড়া একটা দিন- স্রেফ ভাবা যায় না। কর্মব্যস্ত জীবনে যখন বছর ঘুরে ঈদের কয়েকদিনের ছুটি সঞ্চয় হয় তখন আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব মিলে কী জম্পেশ আড্ডাই না হয়! ঈদের সেই বিরামহীন আড্ডার ভেতর কী রুচি, স্বাদ, পুষ্টিই না আছে! বিশ্ব মুসলিমের সবচেয়ে বড় উৎসব ঈদ। পৃথিবীতে বসবাসরত প্রত্যেক জাতির মানুষের মধ্যে বিশেষ দিনকে উপলক্ষ করে উৎসবের রেওয়াজ প্রাচীনকাল থেকেই। সাম্প্রতিককালে ঈদ শুধু সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসব নয়; বরং ঈদ একটি বাণিজ্যিক বিশালতা নিয়েও সমাসীন। গত বছরের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ঈদের অর্থনৈতিক লেনদেন দেড় লাখ কোটি টাকা। আমাদের মতো নিুমধ্যম আয়ের দেশে একটা উৎসবকে কেন্দ্র করে এত টাকার লেনদেন ভাবা যায়! সম্প্রতি করোনায় দীর্ঘমেয়াদি লকডাউনে মানুষ শুধু কর্মহীনই হয়নি, হয়েছে উপার্জনহীন, সর্বোপরি স্বপ্নহীন। সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণি যারা সম্মান, অধিকার ও কর্তব্যসচেতন তারা এখন জীবন-জীবিকা নিয়ে ঘোর অমানিশায় পতিত। লাগাতার তিন মাস আয়বিহীন থাকায় মধ্যবিত্তের মানইজ্জত তো গেছেই, এখন আবরু রক্ষা করা কঠিন। এমন দুমনা সময়ে ঈদ দিতে পারছে না মানুষের মাঝে আনন্দের বার্তা। দেশের সব মানুষের জন্য এমন নিরানন্দের ঈদ আগে আসেনি। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ও ঈদ এসেছিল। নতুন স্বপ্নে নতুন দেশের কামনায় সে ঈদে দুর্যোগ থাকলেও স্বাধীনতার সূর্যের হাতছানি ছিল। মুক্তিযুদ্ধের ঈদের দিন সমরে ভুরুঙ্গামারীতে শহীদ হয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা আশরাকুস সামাদ (বীরউত্তম)। মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গন থেকে প্রকাশিত বিপ্লবী বাংলাদেশ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে ‘ঈদের চাঁদ রক্তের সমুদ্রে একবার ঈদ রক্ততিলক শপথের দিন’ শিরোনামে লেখা হয়- অনেক স্মৃতির স্বাক্ষর নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে হারিয়ে গেল একটা বছর। এলো আবার ঈদ। মিলনের ঈদ। প্রতি বছরের মতো এবারও বাংলাদেশে ঈদ এসেছে কিন্তু আসেনি আনন্দ। বাংলাদেশে যে বিদ্রোহের আগুন জ্বলছে, শতশিখা বিস্তার করে বাংলার তরুণ শক্তি আজ দুর্বার, দুর্জয়, স্বৈরাচার আর শোষণের বিরুদ্ধে। বাংলার দামাল ছেলেরা আজ ঘরছাড়া। এবার বাংলার তরুণ শক্তির প্রতিজ্ঞা, যে চাঁদ রক্তের সমুদ্রে ছাড়িয়ে গেছে সে চাঁদকে মুক্ত করে তবেই ঈদ উৎসব পালন করব। মুক্তিযুদ্ধের ঈদ প্রত্যয় পূরণ হয়েছিল। কিন্তু এবার করোনার ঈদ কি আমাদের জন্য শুভবার্তা বয়ে আনবে? মানুষের চোখে-মুখে আজও আগামী দিনের অনিশ্চয়তার ছাপ। অন্য বছর রমজান মাস রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের শেষে ঈদ আনন্দে সমগ্র দেশকে ভাসালেও এ বছর ঈদের কোনো উত্তাপ নেই। বরং ঈদ-পরবর্তী দেশের গতি-প্রকৃতি কোন দিকে যায় সেটাই দেখার বিষয়। সরকার করোনার অর্থনৈতিক মন্দায় টিকে থাকতে শিল্প, কৃষিসহ অনেক সেক্টরে প্রণোদনা দিচ্ছে। মানুষকে খাদ্য সহায়তা দিচ্ছে। অসচ্ছল পরিবারের জন্য ৫০ লাখ রেশন কার্ড ও ৫০ লাখ পরিবারকে এককালীন ২৫০০ টাকা প্রদান করেছে। সীমিত সামর্থ্য নিয়ে আমাদের সরকারের উদ্দেশ্য লোকপ্রিয়। কিন্তু যাদের হাতে বণ্টনের মহান দায়িত্ব তারা অধিকাংশ মহাচোর। করোনার মৃত্যুর সংখ্যার সঙ্গে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে খবর আসছে রিলিফের চাল, তেল ও নগদ টাকা চোর চেয়ারম্যান-মেম্বারদের তালিকা। বাঙালি মুসলমানের শুধু ঈদ নয়, রমজান মাস এলেই বাড়তি খরচের হাত প্রশস্ত হয়। মানুষ সামর্থ্যরে বাইরে গিয়েও খরচ করে আনন্দ নিয়ে। দেশের উচ্চবিত্তের প্রায় এক লাখ পরিবার ঈদকে উপলক্ষ করে ভারত, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে কেনাকাটার জন্য পাড়ি জমায়। এবার করোনা উচ্চ, মধ্য ও নিুবিত্ত সবার ঈদ আনন্দ সংকোচন করেছে। করোনার ঈদ অবস্থার কতটা নিুগামী করে সেটাই দেখার বিষয়। এটা এমন এক ভয়াবহ সংক্রামক ব্যাধি, যা আক্রান্ত ব্যক্তির কাছাকাছি এলে রক্ষে নেই। সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করে চলতে হয়। করোনা পরিস্থিতিতে এবার ঈদের জামাতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নামাজ পড়া, কোলাকুলি করা, বয়োজ্যেষ্ঠদের কদমবুচি করা উচিত হবে না বোধহয়। এতে সংক্রমণ বাড়তে পারে। তাহলে আমাদের বহমান ঈদ সংস্কৃতি ও লোকাচার করোনার কারণে কি পাল্টে যাচ্ছে? ঈদে এবার ভোগ্যপণ্য থেকে শিল্প পণ্য ও সেবার ব্যবসায়ীদের ঈদটা কতটা নিরানন্দের ভাবা যায়? সুকুমার মন নিয়ে যে গায়ক ঈদকে সামনে রেখে অ্যালবাম রিলিজ করে, যে নাট্যশিল্পী নাটক তৈরি করে, যে গল্পকার গল্প লেখে, যে প্রকাশক বই প্রকাশ করে, যে চলচ্চিত্রকার সিনেমা বানায়- এদের সবার সৃজন ও অর্থযোগ দু’দিকেই করোনার কারণে ভাটার টান। সবচেয়ে বড় মন্দ বিষয় হচ্ছে, ঈদকে কেন্দ্র করে মানুষের মনে কোনো আনন্দের হিল্লোল নেই। পত্রিকায় প্রকাশ, দেশের ৪ কোটি শ্রমিক ঈদ করবে বেতন বোনাস ছাড়াই। সরকার ঘোষিত ৫ হাজার কোটি টাকার তহবিল থেকে ঋণ পেলেও খোদ বিজিএমইএ ও বিকেএমইএভুক্ত অর্ধেকের বেশি কারখানা বেতন দেয়নি। পোশাক কারখানার শ্রমিকরা করোনার ঝুঁকি নিয়ে বকেয়া বেতন-বোনাসের জন্য রাস্তায় আন্দোলন করছে। জীবনের ঝুঁকি যতই থাক জীবনকে বাঁচিয়ে রাখতে হয় প্রতিদিন পেটে অন্ন দিয়ে । করোনা ক্রান্তিকালের এবারের ঈদ আনন্দ, সৌহার্দ্য ও যোগাযোগের জন্য ইতিবাচক নয়। তবু প্রকৃতির নিয়মেই ঈদ এসেছে। আমাদের প্রার্থনা থাকবে ঈদকে উপলক্ষ করে স্রষ্টা যেন করোনার হাত থেকে আমাদের একটু করুণা করেন। খান মাহবুব : প্রাবন্ধিক; খণ্ডকালীন শিক্ষক, মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শেয়ার অতিথি কলাম বিষয়: করোনায় বদলে গেছে এবারের ঈদ