সিলেট ছেড়ে করিমগঞ্জ যেভাবে ভারতের অংশ হলো — ড. অরুণ দত্তচৌধুরী

প্রকাশিত: ১:৫১ অপরাহ্ণ , জানুয়ারি ২৮, ২০২২
সিলেটের একটি মহকুমার নাম ছিল করিমগঞ্জ। এখন আর সিলেটের সঙ্গে নেই। সাতচল্লিশের দেশ ভাগের সময় এই মহকুমাটি কেটে রেখে দেওয়া হয় ভারতে। ব্রিটিশ আমলে বৃহত্তর সিলেট জেলা পাঁচটি মহকুমা নিয়ে গঠিত ছিল। যথা- সিলেট সদর, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ ও করিমগঞ্জ। করিমগঞ্জকে সিলেটের সঙ্গে রাখার চেষ্টার সঙ্গে জড়িত এক স্বদেশপ্রেমী মহান ব্যক্তির অজানা সংগ্রামের কথা আজ বলব।
অনেকে জানেন, অনেকে জানেন না ইতিহাসের কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা। দু-তিন সপ্তাহ আগে ‘আনন্দ বাজার’-এর জম্পেশ আড্ডায় এল প্রসঙ্গটি। শুরু হয়েছিল সিলেটের আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে। আড্ডায় আমরা শিলচরবাসী সিলেটিরা নিজেদের মধ্যে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলছিলাম । লক্ষ্য করি, এই প্রজন্মের এক কলকাতাবাসী লেখিকা দীর্ঘক্ষণ হা করে তাকিয়ে আছেন। একজন তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, এই কথোপকথনের কিছু কি তিনি বুঝতে পেরেছেন? বললেন, একটুও না। বিন্দুবিসর্গও বোঝেননি। কথায় কথা বাড়ে। একপর্যায়ে মনে হলো, কারও কারও ধারণা—সিলেট মনে হয় বাংলার অংশই ছিল না। বাইরে থেকে এনে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। আমি সুযোগটি নিলাম, এই ফাঁকে ছোট-খাটো একটা বক্তৃতা দিয়ে দিলাম। বক্তৃতার সারকথা হলো : “সিলেট বাংলারই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ । ১৯০৫ সালে ব্রিটিশরা বঙ্গভঙ্গ করে, বাংলাকে ভাগ করে ফেলে, যার প্রতিবাদ রবীন্দ্রনাথও করেছিলেন। ওই সময় তুলনামূলক অনুন্নত আসামের প্রশাসনিক সুবিধার জন্য বাংলা থেকে সিলেটকে কেটে আসামের সঙ্গে জুড়ে দেয় ব্রিটিশরা। শিক্ষায়-সম্পদে সিলেট তখন অগ্রসর ছিল। আসামের সচিবালয়ের প্রাণশক্তি ছিলেন সিলেটীরা। সিলেটকে আসামের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া তখন মেনে নিতে পারেননি বাঙালিরা, প্রতিবাদ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ এ নিয়ে কবিতাও লিখেছিলেন—‘বাংলার রাষ্ট্রসীমা হতে নির্বাসিতা তুমি সুন্দরী শ্রীভূমি’।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় সিলেটকে নিয়ে গণভোটের আয়োজন করা হয়। ভারত না পাকিস্তান, সিলেট কার সঙ্গে যাবে—এ প্রশ্নে অনুষ্ঠিত গণভোটে সিলেটের জনগণ রায় দেন, তারা পাকিস্তানের সঙ্গে যাবেন। এ গণভোটের ফলে সিলেট আবার ফিরে এল বাংলায়। তবে সম্পূর্ণ এল না, অঙ্গহানি ঘটল। এটা ঘটল র‌্যাডক্লিফের বদৌলতে অর্থাৎ কথিত কারসাজিতে । ব্রিটিশরা যখন সিদ্ধান্ত নেয়, ভারত-পাকিস্তান দুটি আলাদা রাষ্ট্র বানিয়ে তারা ভারতবর্ষ ছেড়ে যাবে, তখন দুটি রাষ্ট্রের সীমানা নির্ধারণের জন্য স্যার সিরিল র‌্যাডক্লিফের নেতৃত্বে কমিশন গঠন করা হয়। তারা চিহ্নিত করে সীমানা। সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ ছাড়াও তখন সিলেটের আরেকটি মহকুমা ছিল, যার নাম করিমগঞ্জ। র‌্যাডক্লিফের সিদ্ধান্তের ফলে করিমগঞ্জসহ সাড়ে তিনটি থানা রেখে দেওয়া হয় ভারতে। এ গুলো এখন ভারতের অংশ।
আড্ডার এক তরুণ লেখক আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন, এই ইতিহাস তিনি জানতেন না। আজ তার ভুল ভাঙল। সাতচল্লিশে দেশ ভাগের সময় করিমগঞ্জ মহকুমার এসডিপিও (মহকুমা পুলিশ কর্মকর্তা) ছিলেন মোহাম্মদ আবদুল হক ওরফে এম.এ. হক (০১.০১.১৯১৮-০৬.০৪.১৯৯৬)। তাঁর কাছ থেকে শোনা ঘটনাই আজ বলব।
এম.এ. হককে আপনারা অনেকেই চিনেন । তিনি বাংলাদেশের ভূমিমন্ত্রী ছিলেন । ডিআইজিপি হিসেবে তাঁর ব্যাপক পরিচিতি ছিল। ঢাকাস্থ জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতিও ছিলেন। ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা দখলের পর যেসব পদস্থ দেশপ্রেমী অফিসারকে চাকরিচ্যুত করে এম. এ. হক ছিলেন তাদের একজন । তাঁর বাড়ি ও সংসদীয় এলাকা ছিল জকিগঞ্জ, যার অন্য পারেই করিমগঞ্জ। এম.এ. হকের মেয়ে ফারহানা হক বাংলাদেশ টেলিভিশনের ইংরেজি সংবাদ পাঠিকা, আরেক মেয়ে রেহানা আশিকুর রহমান সংগীতশিল্পী।
প্রায় চার দশক আগের কথা। আমি তখন আসামের আর.কে. নগর কলেজের অধ্যক্ষ। বিভিন্ন পত্রিকার উপসম্পাদকীয়তে আমার বহুমাত্রিক প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশ হতো। উল্লেখ্য আমার আদি বাড়ি সিলেটের জকিগঞ্জের বীরশ্রীতে । জনাব এম. এ. হকের সাথে আমার আমেরিকায় আলাপ,পরিচয় ও হৃদ্যতা । ১৯৮২-তে আমার দাদু ভারতবর্ষের সেরা আইসিএস, স্বদেশপ্রেমী বাঙালি, জকিগঞ্জের সূর্যসন্তান গুরুসদয় দত্ত (১০.০৫.১৮৮২-২৫.০৬.১৯৪১)-এর জন্মশতবার্ষিকী পালন করবে জকিগঞ্জবাসী। আয়োজক ও পৃষ্ঠপোষক জনাব এম. এ. হক। একদিন এম.এ. হকের ফোন পেলাম। তিনি এ উপলক্ষে একটা স্মরণিকা বের করবেন, গুরুসদয় সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কতগুলো তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের নিমিত্তে সরকারি সফরে আসাম তথা করিমগঞ্জ আসছেন। তাঁর সঙ্গে যেতে হবে বিভিন্ন স্থানে । নির্দিষ্ট দিনে তিনি আসলেন এবং তাঁর জন্য নির্ধারিত সরকারি জিপে সঙ্গী হলাম আমি । চলতে চলতে শুরু হলো বিভিন্ন আলোচনা। দারুণ ভালো লাগল এম.এ. হকের সিলেটভিত্তিক ঐতিহাসিক গল্প । কত অজানা বিষয়ে কথা বললেন । ভুলে গেলাম অন্য সবকিছু।
জকিগঞ্জের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে স্রোতস্বিনী কুশিয়ারা। ওপারে জকিগঞ্জ, এপারে করিমগঞ্জ। র‌্যাডক্লিফের বদৌলতে দুই দেশের সীমানা হচ্ছে নদীর মধ্যস্রোত । তীব্র স্রোতে নদী ভাঙছে ওপার, আর গড়ছে এপার। অর্থাৎ বাংলাদেশ হারাচ্ছে ভূমি, লাভবান হচ্ছে ভারত । নদী গ্রাস করছে বাংলাদেশের ভূমি, সেই ভূমি জেগে উঠছে ভারতে। সীমানা যেহেতু নদীর মধ্যস্রোত, তাই সব লাভ ভারতের। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান ও ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীনতা লাভ করে । ওই সময় এম.এ. হক করিমগঞ্জ মহকুমার এসডিপিও ছিলেন।
বন্ধুবৎসল অমায়িক ব্যাক্তিত্বের অধিকারী এম.এ. হক বললেন, তিনি এক সপ্তাহ পর্যন্ত করিমগঞ্জকে তাঁর দখলে রেখেছিলেন। পরে ভারতীয় বাহিনী চলে আসায় তাঁকে বিদায় নিতে হয়।
এম.এ. হক ১৪ আগস্ট করিমগঞ্জ মহকুমা পুলিশ কার্যালয়ে পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করেন এবং সিলেটে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ঘন ঘন তারবার্তা পাঠাতে থাকেন সামরিক সাহায্য পাঠানোর জন্য । ওই সময় সিলেটের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (ডি.সি.) ছিলেন সিলেটেরই লোক ছইওদ নবীব আলী । বিয়ানীবাজারের আলীনগর গ্রামে তাঁর বাড়ি। এম.এ. হক বললেন, “প্রতিদিন আমি অপেক্ষায় থাকি, এই এল বুঝি ফোর্স। না, আসে না। এভাবে একদিন/দুদিন করে সাত দিন কেটে গেল। এ দিকে ভারতীয় বাহিনী চলে এল করিমগঞ্জ শহরে। আমি তখন নিরুপায়। আর কিইবা করতে পারি। মহকুমা পুলিশ কার্যালয় থেকে পাকিস্তানের পতাকাটা নামিয়ে গুটিয়ে নিলাম। তারপর চলে এলাম এপারে অর্থাৎ পাকিস্তানে। এভাবেই অবসান ঘটল এই অধ্যায়ের।”
করিমগঞ্জ, রাতাবাড়ি, পাথারকান্দিসহ সিলেটের সাড়ে তিনটি থানা রয়ে গেল ভারতে। ওই সময় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (ডি.সি.) ছইয়দ নবীব আলী কেন সাড়া দেননি —সে প্রসঙ্গে জনাব এম. এ. হকের ভাষ্য হলো — ‘আসামের গান্ধী-নেহরুবাদী কংগ্রেসী নেতৃবর্গ ও ব্রিটিশ কর্তারা পারস্পরিক যোগসাজশের মাধ্যমে ছইয়দ নবীব আলী ডি.সি.-কে গোপনে বশীভূত করে রেডক্লিফকৃত সীমানা বুজারতপত্রে তার স্বাক্ষর নিয়ে তা আগেই জায়েজ করে রেখেছিলো ।” তাই, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছইয়দ নবীব আলী করিমগঞ্জে দায়িত্বরত মহকুমা পুলিশ কর্মকর্তা জনাব এম.এ. হকের তারবার্তাকে ইচ্ছাকৃতভাবে আমলে না নিয়ে দেশবাসীকে প্রবঞ্চিত করেছিলেন। স্বদেশপ্রেমী জনাব এম.এ. হক বাংলাদেশের এরশাদ সরকারের ভূমিমন্ত্রী থাকাকালে জকিগঞ্জ সীমান্তে কুশিয়ারা নদীর স্বত্ব নিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সফল হন। তিনি করিমগঞ্জ সফরকালে আমরা সিলেটিদের সাথে এক বৈঠকী আড্ডায় ছইয়দ নবীব আলীর দেশদ্রোহী উক্ত ঘটনার উল্লেখ করে দুঃখ প্রকাশ করেন এবং পরিশেষে বললেন, “সেদিন যদি জেলাপ্রশাসক ছইয়দ নবীব আলী মাতৃভূমির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা না করে আমার চাহিদামতো সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন তাহলে পবিত্র সিলেটভূমির মানচিত্র অক্ষুণ্ণ রাখা অসম্ভব ছিল না।” এই হচ্ছে শ্রীভূমি সিলেটের অঙ্গহানির অপ্রকাশিত ইতিহাস।
——————————–
[লেখক: ড. অরুণ দত্তচৌধুরী (১৯.১১.১৯৩৬-২৮.০২.২০১০)। ইতিহাস-ঐতিহ্য গবেষক, ভূতপূর্ব অধ্যক্ষ, আর.কে. নগর কলেজ, আসাম, ভারত। তারিখ : ১৫.০৭.২০০৭, শিলচর।)

Loading