দালালদের দৌরাত্ম্য

টিকার এসএমএস ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে

প্রকাশিত: ১১:১২ পূর্বাহ্ণ , সেপ্টেম্বর ২, ২০২১

স্বপ্না চক্রবর্তী ॥

দিন যত বাড়ছে করোনার টিকা পেতে মানুষের আগ্রহ বেড়েই চলেছে। ফলে প্রতিদিনই বাড়ছে টিকা পেতে নিবন্ধিতদের সংখ্যা। কিন্তু সেই তুলনায় টিকার মজুদ এত না থাকায় টিকার এসএমএস আসতে মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হচ্ছে মানুষকে। কেউ কেউ আবার অভিযোগ করছেন টিকা কেন্দ্রগুলোতে এসএমএস না আসার কারণ খুঁজতে গেলে দাবি করা হচ্ছে টাকা। টাকা দিলে আগে আগে এসএমএস পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবেন তারা। শুধু তাই নয় বেশি টাকা দিলে পছন্দের কোম্পানির টিকাও পাইয়ে দেয়ার অঙ্গীকার দেন তারা। সরবরাহের তুলনায় এ বিপুল সংখ্যক টিকাপ্রত্যাশীর তাই পোহাতে হচ্ছে চরম দুর্ভোগ। কেউ কেউ বলছেন দালালদের দৌরাত্ম্যে ভেঙ্গে পড়েছে টিকার এসএমএস ব্যবস্থা। এখনই কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে এ অবস্থা ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।

স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট ও চীনের সিনোফার্মের সঙ্গে ক্রয়চুক্তির টিকার পাশাপাশি ভারত ও চীন সরকারের উপহার এবং কোভ্যাক্সের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত ৩ কোটি ২৩ লাখ ৫৯ হাজার ৯০০ ডোজ টিকা পাওয়া গেছে। এরপর ৩০ আগস্ট রাতে এসেছে চীন থেকে সিনোফার্মের আরও ২০ লাখ টিকা। কিন্তু এর মধ্যে মঙ্গলবার পর্যন্ত, টিকা পেতে জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর দিয়ে নিবন্ধন করেছেন ৩ কোটি ৭১ লাখ ৬৬ হাজার ৪৭৯ জন। পাসপোর্টের নম্বর দিয়ে নিবন্ধিত হয়েছেন আরও ৪ লাখ ৪৮ হাজার ৬৭৯ জন।

এ বিপুলসংখ্যক টিকাপ্রত্যাশীর সবাইকেই টিকার আওতায় নিয়ে আসার আশ^াস স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকসহ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সবাই দিলেও এ আশ^াসের ওপর কতটা নির্ভর করা যায় তা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে সাধারণ মানুষের মনে।

মেহেরুন্নেসা মৌ। আগস্টের ৩ তারিখ টিকা পেতে সরকারী নির্ধারিত ‘সুরক্ষা এ্যাপ’ এ নিবন্ধন করেন। দেশের বাইরে উচ্চ শিক্ষায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। সব কাগজপত্র ঠিকঠাক হয়ে গেছে। যে কোন সময় ডাক পেতে যাচ্ছেন স্বপ্নের পথে যাত্রার। কিন্তু বৈশি^ক মহামারীকালে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাতায়াতের অন্যতম শর্ত থাকে করোনা টিকা গ্রহণের। আর তাই টিকা পেতে নিবন্ধন করেন তিনি। কিন্তু অপেক্ষার প্রহর যেন আর কাটে না। এক দিন, দুই দিন করে পুরো আগস্ট মাস কেটে গেলেও এখনও পাননি তিনি টিকার এসএমএস।

একই অবস্থা কামরুল ইসলামের। কসমেটিকস্ ব্যবসায়ী কামরুলের করোনার কারণে প্রায় দুই বছর বন্ধ ছিল ব্যবসায়িক সব কার্যক্রম। লকডাউন তুলে নেয়ার পরে পুরোদমে নেমেছেন ক্ষতি পুষিয়ে নিতে। কিন্তু ব্যবসার প্রয়োজনীয় মানসম্মত প্রসাধনী আনতে যেতে হবে পাশর্^বর্তী দেশ ভারতে। ভারতের সীমান্ত খুলে দেয়া হয়েছে। কিন্তু নিবন্ধনের প্রায় দেড় মাস কেটে গেলেও পাচ্ছেন না করোনার টিকা। ফলে ভারত যাওয়াও বন্ধ। এদিকে নতুন পণ্য না থাকায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলা রাখলেও নিয়মিত ক্রেতাদেরও পছন্দের সামগ্রী সরবরাহ করতে পারছেন না তিনি। দিনের পর দিন বাড়ছে ক্ষতির পরিমাণ।

এদিকে টিকার এসএমএস পেতে একটি টিকা কেন্দ্র থেকে ৫০০ টাকা দাবি করো হয়েছে বলে অভিযোগ করেন মিরপুরের বাসিন্দা রহমত উল্লাহ। প্রায় এক মাস আগে নিবন্ধন করলেও টিকার এসএমএস পাননি তিনি। কারণ জানতে কেন্দ্রে গেলে প্রথমে এসএমএস আসার পরই টিকা নিতে আসার কথা বললেও পরে একজন নির্জনে ডেকে নিয়ে বলেন ৫০০ টাকা দিলে এসএমএস পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবেন। যদি সিনোফার্মের টিকা নিতে না চান তাহলে মডার্না বা ফাইজারের টিকার ব্যবস্থাও তিনি করে দেবেন, তবে এ জন্য টাকার পরিমাণ বেশি লাগবে বলেও জানান।

অভিযোগ পাওয়া গেছে, রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের টিকাদান কর্মসূচী নিয়েও। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের এক কর্মী জানান, এখানে টিকাদান কর্মসূচীর নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিতরা টাকার বিনিময়ে লাইনে না দাঁড়িয়েই টিকা নেয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, প্রবাসীদের পছন্দের টিকা দিতেও টাকা নিচ্ছেন। কেউ কেউ আবার টিকাগ্রহীতাদের এসএমএস পাওয়ার ব্যবস্থা করার কথা বলেও টাকা দাবি করছেন। বিষয়টি হাসপাতালের পরিচালকের কানেও এসেছে বলে জানান খোদ পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ এ কে এম মুজিবুর রহমান। তিনি বলেন, আমরা নজরদারি রাখছি। যদি কেউ হাতেনাতে ধরা পড়েন তাহলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ইতোমধ্যে আমরা এক নিরাপত্তাকর্মীকে তার দায়িত্ব থেকে পরিবর্তন করে দিয়েছি।

একই অবস্থা রাজধানীর মুগদা হাসপাতারেও। লাইন ছাড়াই টিকা গ্রহণের ব্যবস্থাসহ পছন্দের কোম্পানির টিকা পেতে দালাল রয়েছে বলে অভিযোগ করেন খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা বিপ্রজিত বাপ্পা। তিনি বলেন, দুই দিন আগে আমার স্ত্রীকে টিকা দেয়াতে নিয়ে এসেছিলাম। সে একটু অসুস্থ থাকায় অস্থির হয়ে উঠছিল। এমন সময় পাশ থেকে একজন এসে কানে কানে বলল, ভাই ১০০০ টাকা দেন। লাইনে দাঁড়াতে হবে না। আমি তো অবাক!

টিকা প্রদানে কাকে বেশি অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে এমন প্রশ্নের উত্তরে একটি টিকা কেন্দ্রের প্রধান এবং ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট টিবি হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডাঃ আয়েশা আক্তার জনকণ্ঠকে বলেন, যারা আগে নিবন্ধন করেছেন এবং যাদের বয়স ৬০ বছরের বেশি, টিকা ও এসএমএস দেয়ার ক্ষেত্রে তাদের অগ্রাধিকার দেয়া হয়। টিকার জন্য বিপুল সংখ্যক মানুষ নিবন্ধন করেছেন। কিন্তু টিকা কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা সেই তুলনায় অনেক কম। তিনি বলেন, এক কেন্দ্রে হয়তো টিকা দেয়ার সক্ষমতা ৫০০, কিন্তু প্রতিদিন নিবন্ধনই করছেন ৫ থেকে ৭ হাজার মানুষ। ফলে বাকিগুলো জমতে থাকে।

তবে নিবন্ধিতদের সবাইকে টিকা দেয়া হবে বলে জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। সম্প্রতি তিনি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, আমরা একবারেই সবাইকে টিকা দিতে পারব না। আমরা সাধ্যমতো টিকা কিনে আনার চেষ্টা করছি। সবাই টিকা পাবেন। ধৈর্য্য ধরতে হবে। তিনি বলেন, টিকা নিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতি চলছে। বড় বড় দেশগুলো তাদের জনসংখ্যার ৪ থেকে ৫ গুণ বেশি টিকা বানিয়ে মজুদ করেছে। আমরা মৃত্যুর হার কমাতে চাই। শুধু সরকার পারবে না, সবাইকে প্রয়োজন। নিজেদের সুরক্ষা নিজেদের করতে হবে। বাসে-ট্রেনে গাদাগাদি করা চলবে না। তাহলে আবার সংক্রমণ বাড়বে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, টিবি, পক্স আগে মানুষের ছিল না। প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে অসুখগুলো আসে, এখনও আসছে। আমরা জানি যে করোনা কোন একটি প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে এসেছে। স্মল পক্স প্রতিরোধ করা গেছে। কোন এক সময় করোনাও মোকাবেলা করা সম্ভব হবে। আমরা বিভিন্ন মাধ্যম থেকে ভ্যাকসিন পাচ্ছি। কোভ্যাক্স থেকে আমরা ভ্যাকসিন পাচ্ছি, নিজেরাও কিনছি। ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দিতে হলে ২৬ থেকে ২৭ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন প্রয়োজন হবে। একসঙ্গে এত ভ্যাকসিন আমরা পাব না, রাখতেও পারব না। আমরা চেষ্টা করছি, যখন যেটা পাওয়া যায় আনার জন্য।

জনগণকে টিকা নেয়ার ক্ষেত্রে ধৈর্য্য ধরার পাশাপাশি টিকা পেতে দালাল ধরার প্রয়োজন নেই বলে মন্তব্য করেছেন করোনা প্রতিরোধে গঠিত জাতীয় কারিগরি কমিটির সদস্য এবং স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক ডাঃ ইকবাল আর্সনালও। তিনি বলেন, করোনার সংক্রমণ এখন নি¤œমুখী। মানুষের মধ্যে যথেষ্ট সচেতনতা তৈরি হয়েছে বলেই এটি সম্ভব হয়েছে। ভ্যাকসিন দেয়া হচ্ছে। যেহেতু সরবরাহ কম তাই অনেকেরই এসএমএস পেতে দেরি হচ্ছে। তবে ধৈর্য্য ধরুন। বিভিন্ন মাধ্যম থেকে টিকা আনার চেষ্টা চলছে। সবাই টিকা পাবেন। কাউকে টিকা পেতে দালালের শরণাপন্ন হতে হবে না। মানুষের সচেতনতা খুব জরুরী।## জনকন্ঠ

Loading